ধর্ম ও সুশাসন by এ এম এম শওকত আলী
২০০১ সালের ১ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জাতিকে একটি উপহার দিয়েছিলেন। মাইলফলকসম একটি রায়ের মাধ্যমে এ আদালত ফতোয়ার মাধ্যমে দণ্ড প্রদানকে বেআইনি ঘোষণা করেন। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করে ওই ব্যক্তিরা, যারা ফতোয়ায় বিশ্বাসী।
আপিলের যুক্তি, ফতোয়া ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এ কারণেই ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা যাবে না। হাইকোর্টের রায়ের যুক্তি ছিল, বাংলাদেশ সংবিধানে ফতোয়া-প্রথার স্বীকৃতি নেই। বিষয়টি নিঃসন্দেহে স্পর্শকাতর এবং জটিল_কারণ এটা ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে সংবিধানবহির্ভূত কোনো নিয়ম-আচার আইনসিদ্ধ নয়। সংবিধানই হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। সুশাসনের রূপরেখা এবং অনুসরণীয় বিষয়াবলি সংবিধানেই বলা আছে, যা রাষ্ট্রের তিন অঙ্গসহ নাগরিকরাও মানতে বাধ্য। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের কোনো না কোনো গ্রামে ফতোয়ার অজুহাতে শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে। যে বিষয়টি দৃশ্যমান তা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা ফতোয়ার মাধ্যমে প্রদত্ত দণ্ডে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। কিছু ক্ষেত্রে নির্যাতনের মাত্রাধিক্যের কারণে দণ্ডিত নারীরা মৃত্যুবরণও করেছেন। এ ধরনের মৃত্যুকে বিচারবহির্ভূত হত্যা হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করেন।
বর্তমানে সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়াটি চলমান। বলা যায়, প্রায় শেষপর্যায়ে। এ নিয়ে ইসলামপন্থী দল ও সংবিধানে বিশ্বাসী দলের মধ্যে বিতর্কও চলছে। এ বিতর্কেরও একটি স্পর্শকাতর বিষয় হলো, ধর্মনিরপেক্ষতা, যা মূল সংবিধানে ছিল এবং আবারও ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে দু-দুটি সামরিক শাসনের ফলে সংবিধানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি স্বীকৃতি লাভ করে। সাংবিধানিক সংশোধনী প্রক্রিয়ায় চলমান বিতর্কে এ বিষয়টিও ক্ষমতাসীন সরকার মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ সামরিক শাসনামলের ধর্ম-সংক্রান্ত বিষয় সংবিধানে অক্ষুণ্ন থাকবে। একই সঙ্গে থাকবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। এ নিয়েও কিছু বিতর্ক হয়েছে। কিছু আদর্শিক ব্যক্তির মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মের স্বীকৃতি একই সঙ্গে সংবিধানে থাকলে তা হবে সাংঘর্ষিক। বর্তমানে ফতোয়া-সংক্রান্ত চলমান আইনি লড়াই নিঃসন্দেহে সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ, এ লড়াইয়ের মূল বিষয়বস্তু শাসনব্যবস্থায় ধর্মের অনুপ্রবেশ। ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী নাগরিকদের আশঙ্কা, এর ফলে সুশাসন ব্যাহত হবে। কারণ ফতোয়ার নামে যেসব দণ্ড প্রদান করা হচ্ছে, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই নামান্তর। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের বিচারিকপ্রক্রিয়া সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। এ বিষয়ে কিছু প্রখ্যাত আইনজীবী এ যুক্তিই সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছেন। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন যে পবিত্র কোরআনেই ফতোয়ার স্বীকৃতি রয়েছে এবং এ প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের ধারা এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ না হলেও বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রতিবাদীদের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র দুটি দল বা গোষ্ঠী ফতোয়া-প্রথা বিলুপ্ত হলে তীব্র আন্দোলনের হুমকি প্রদান করেছে ইতিমধ্যেই। এর মধ্যে একটি দল নরম-গরম সুরেই অভিমত ব্যক্ত করেছে। তাদের কড়া যুক্তি হলো, এ বিষয়টি নির্ধারণ করার কোনো ক্ষমতাই কোনো আদালতের নেই। নরম যুক্তির মধ্যে এ কথাও বলা হয়েছে যে ফতোয়ার নামে যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, তা তারা সমর্থন করে না। তবে অতীতের কোনো ঘটনা সম্পর্কে তারা কোনো প্রতিবাদ করেনি। কেন করেনি তা স্পষ্ট নয়। অন্য গোষ্ঠীটি তীব্র আন্দোলনেরই কথা বলেছে। প্রথমোক্ত দলটি এ কথাও বলেছে যে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার জন্য ফতোয়া বিলুপ্ত করা সমর্থনযোগ্য নয়।
আসলেই কি ফতোয়াজনিত ঘটনাপ্রবাহ কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা? সব ঘটনাই কি পুলিশের নজরে আসে বা পুলিশ আমলে নিয়ে আইনি-প্রক্রিয়া চালু করে। এ কথা অনস্বীকার্য যে সব অপরাধমূলক ঘটনাই পুলিশের নজরে আসে না বা এলেও পুলিশ আমলে নেয় না। এ পর্যন্ত যেসব ফতোয়ার ঘটনা জানা গেছে, তার প্রায় সব কয়টাই মিডিয়ার মাধ্যমে। এ জন্য বলা যাবে না যে ঘটনাগুলো বিক্ষিপ্ত। এ যুক্তির পক্ষে আরো যুক্তি রয়েছে। তা হলো, যেকোনো অপরাধমূলক ঘটনার বিচার সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ীই হবে। এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল বা প্রধান বিরোধী দল ফতোয়া-প্রথার পক্ষে-বিপক্ষে কোনো বক্তব্যই দেয়নি। না দেওয়াই ভালো। কারণ, বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তিযোগ্য। সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য উত্তম পন্থা হবে, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আদালতের ওপরই ছেড়ে দেওয়া।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফতোয়া-সংক্রান্ত চলমান বিতর্ক নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বিতর্ক শুরু হয়েছে এমন একসময়ে, যখন জাতির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে সাংবিধানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। এ অঙ্গীকার ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলই প্রকাশ্যে করেছে। সংবিধান রাষ্ট্রকে প্রজাতন্ত্র হিসেবেই উল্লেখ করেছে। ধর্মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এর অর্থ এই নয় যে নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে বা সামাজিক ব্যবস্থায় ধর্মের কোনো স্থানই নেই। অবশ্যই তা রয়েছে। এ জন্যই সংবিধান সব সম্প্রদায়কেই নিজ ধর্ম অনুসরণ করার স্বাধীনতা অর্পণ করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। যে বিষয়টি নিশ্চিতভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন, তা হলো ধর্মের স্থান ব্যক্তিগত জীবনের গণ্ডির মধ্যেই সীমিত। শাসন ব্যবস্থায় নয়। ফতোয়ার মাধ্যমে এ অবস্থানকে দুর্বল বা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরো বলা যেতে পারে যে হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর নগণ্যসংখ্যক কিছু ঘটনার জন্য পুলিশ আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে কিছু অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করেছিল। এ প্রসঙ্গে অন্তত রাজশাহী জেলার একটি ঘটনার কথা মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এর পরও ফতোয়ার ঘোষণা স্তব্ধ হয়নি। এ কারণেই বিষয়টি উদ্বেগজনক।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এক দশকের অধিককাল ধরে ইসলামের নামে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার ঘটনাবলি। সরকার এ জন্য আইনি পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। জঙ্গি তৎপরতার ধারাবাহিকতায় একসময় একটি লিফলেট জঙ্গিরা প্রচার করে। বিষয়বস্তু ছিল, বাংলাদেশে সংবিধানসম্মত ও প্রচলিত আদালতের বিচার করার কোনো ক্ষমতাই নেই। বলা নিষ্প্রয়োজন যে তাদের এ যুক্তি এ দেশের আপামর জনসাধারণ গ্রহণ করেনি। এর অর্থ কি এই নয় যে নাগরিকরা এ ধরনের প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে রায় দিয়েছে এবং সংবিধানসহ প্রচলিত আইনের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেছে। ঐতিহাসিকভাবেও এ বিষয়টি সত্য যে ব্রিটিশ শাসনামলে উপমহাদেশে বহু নতুন আইন করা হয়েছিল, যা ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। এর ফলে সামাজিক ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন সাধিত হয়। এ পরিবর্তন রাজনৈতিক চেতনারও সহায়ক হয়, যে চেতনার পরিসমাপ্তি ঘটে ঔপনিবেশিক শাসনের বিলুপ্তির মাধ্যমে। পরবর্তীকালে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কুশাসনের বিলুপ্তি হয়।
শাসনব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুপ্রবেশের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ও দৃশ্যমান_যৌতুকপ্রথা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী যৌতুকপ্রথার ফলে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই অন্তত ২৩ জন নারী মৃত্যুবরণ করেন ও ১১ জন শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। এ সংক্রান্ত ২০১০ সালের পরিসংখ্যানেও বলা হয়েছে, ওই বছর মৃতের সংখ্যা ছিল ২৪৯ এবং নির্যাতনের ঘটনা ছিল ১২২টি। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ ধরনের অপরাধের মাত্রা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। এসব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাপ্রবাহ এমন সময় দৃশ্যমান, যখন দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নারী অধিকার নিশ্চিত করতে সোচ্চার। সব সরকারই কম-বেশি এ বিষয়ে সমর্থনও দিয়েছে। এ বিষয়ে যে কথা বলা যায় তা হলো, ধর্মকে শাসনব্যবস্থা থেকে পৃথক করে ব্যক্তিগত গণ্ডির মধ্যেই সীমিত রাখা সুশাসনের জন্য সহায়ক। এটা করা হলে নারী অধিকারও হুমকির মুখে পড়বে। এ ক্ষেত্রে অন্য বিষয়টি হলো, বাল্যবিয়ে। ব্রিটিশ আমলেই এ ধরনের কু-প্রথাকে প্রতিরোধ করার জন্য বিবাহের নিম্নতম বয়সসীমা আইনের দ্বারা নির্ধারিত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এ আইনের কিছু ইতিবাচক সংস্কারও করা হয়। সম্প্রতি ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে বিদ্যমান আইনও কার্যকর নয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রসহ নাগরিকদের আরো গঠনমূলক ভূমিকার প্রয়োজন।
চলমান ঘটনাপ্রবাহের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এ ধরনের মামলার ফলে উচ্চতর আদালতের কার্যপরিধি কিছুটা হলেও অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ কারণে আদালত এমন সব মামলা নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হচ্ছে, যা প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের দায়িত্ব। এক কথায় বলা যায়, বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের ধারা জাতি গঠনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে সক্ষম নয়। রাজনৈতিক দল ও সামাজিক নেতৃত্ব একযোগে যদি সংবিধান ও প্রচলিত আইনের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়, তাহলেই এ ধরনের মামলা আদালতে যাবে না। বর্তমানে কিছু বেসরকারি সংস্থা এ লক্ষ্যে কাজ করলেও রাজনৈতিক সমর্থনের ঘাটতির কারণে এদের চেষ্টা সফল হচ্ছে না। প্রায় সব ক্ষমতাসীন দলই মনে করে, আইন ও নীতি প্রণয়ন করলেই দায়িত্ব শেষ। বাস্তবে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রশাসনিক যন্ত্র যথেষ্ট দুর্বল। এদিকে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গ সচেতন হলে সুফল অর্জন করা সম্ভব হবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
বর্তমানে সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়াটি চলমান। বলা যায়, প্রায় শেষপর্যায়ে। এ নিয়ে ইসলামপন্থী দল ও সংবিধানে বিশ্বাসী দলের মধ্যে বিতর্কও চলছে। এ বিতর্কেরও একটি স্পর্শকাতর বিষয় হলো, ধর্মনিরপেক্ষতা, যা মূল সংবিধানে ছিল এবং আবারও ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে দু-দুটি সামরিক শাসনের ফলে সংবিধানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি স্বীকৃতি লাভ করে। সাংবিধানিক সংশোধনী প্রক্রিয়ায় চলমান বিতর্কে এ বিষয়টিও ক্ষমতাসীন সরকার মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ সামরিক শাসনামলের ধর্ম-সংক্রান্ত বিষয় সংবিধানে অক্ষুণ্ন থাকবে। একই সঙ্গে থাকবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। এ নিয়েও কিছু বিতর্ক হয়েছে। কিছু আদর্শিক ব্যক্তির মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মের স্বীকৃতি একই সঙ্গে সংবিধানে থাকলে তা হবে সাংঘর্ষিক। বর্তমানে ফতোয়া-সংক্রান্ত চলমান আইনি লড়াই নিঃসন্দেহে সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। কারণ, এ লড়াইয়ের মূল বিষয়বস্তু শাসনব্যবস্থায় ধর্মের অনুপ্রবেশ। ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী নাগরিকদের আশঙ্কা, এর ফলে সুশাসন ব্যাহত হবে। কারণ ফতোয়ার নামে যেসব দণ্ড প্রদান করা হচ্ছে, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই নামান্তর। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের বিচারিকপ্রক্রিয়া সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। এ বিষয়ে কিছু প্রখ্যাত আইনজীবী এ যুক্তিই সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছেন। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন যে পবিত্র কোরআনেই ফতোয়ার স্বীকৃতি রয়েছে এবং এ প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের ধারা এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ না হলেও বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রতিবাদীদের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র দুটি দল বা গোষ্ঠী ফতোয়া-প্রথা বিলুপ্ত হলে তীব্র আন্দোলনের হুমকি প্রদান করেছে ইতিমধ্যেই। এর মধ্যে একটি দল নরম-গরম সুরেই অভিমত ব্যক্ত করেছে। তাদের কড়া যুক্তি হলো, এ বিষয়টি নির্ধারণ করার কোনো ক্ষমতাই কোনো আদালতের নেই। নরম যুক্তির মধ্যে এ কথাও বলা হয়েছে যে ফতোয়ার নামে যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, তা তারা সমর্থন করে না। তবে অতীতের কোনো ঘটনা সম্পর্কে তারা কোনো প্রতিবাদ করেনি। কেন করেনি তা স্পষ্ট নয়। অন্য গোষ্ঠীটি তীব্র আন্দোলনেরই কথা বলেছে। প্রথমোক্ত দলটি এ কথাও বলেছে যে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার জন্য ফতোয়া বিলুপ্ত করা সমর্থনযোগ্য নয়।
আসলেই কি ফতোয়াজনিত ঘটনাপ্রবাহ কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা? সব ঘটনাই কি পুলিশের নজরে আসে বা পুলিশ আমলে নিয়ে আইনি-প্রক্রিয়া চালু করে। এ কথা অনস্বীকার্য যে সব অপরাধমূলক ঘটনাই পুলিশের নজরে আসে না বা এলেও পুলিশ আমলে নেয় না। এ পর্যন্ত যেসব ফতোয়ার ঘটনা জানা গেছে, তার প্রায় সব কয়টাই মিডিয়ার মাধ্যমে। এ জন্য বলা যাবে না যে ঘটনাগুলো বিক্ষিপ্ত। এ যুক্তির পক্ষে আরো যুক্তি রয়েছে। তা হলো, যেকোনো অপরাধমূলক ঘটনার বিচার সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ীই হবে। এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল বা প্রধান বিরোধী দল ফতোয়া-প্রথার পক্ষে-বিপক্ষে কোনো বক্তব্যই দেয়নি। না দেওয়াই ভালো। কারণ, বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তিযোগ্য। সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য উত্তম পন্থা হবে, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আদালতের ওপরই ছেড়ে দেওয়া।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফতোয়া-সংক্রান্ত চলমান বিতর্ক নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বিতর্ক শুরু হয়েছে এমন একসময়ে, যখন জাতির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে সাংবিধানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। এ অঙ্গীকার ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলই প্রকাশ্যে করেছে। সংবিধান রাষ্ট্রকে প্রজাতন্ত্র হিসেবেই উল্লেখ করেছে। ধর্মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এর অর্থ এই নয় যে নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে বা সামাজিক ব্যবস্থায় ধর্মের কোনো স্থানই নেই। অবশ্যই তা রয়েছে। এ জন্যই সংবিধান সব সম্প্রদায়কেই নিজ ধর্ম অনুসরণ করার স্বাধীনতা অর্পণ করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। যে বিষয়টি নিশ্চিতভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন, তা হলো ধর্মের স্থান ব্যক্তিগত জীবনের গণ্ডির মধ্যেই সীমিত। শাসন ব্যবস্থায় নয়। ফতোয়ার মাধ্যমে এ অবস্থানকে দুর্বল বা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরো বলা যেতে পারে যে হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর নগণ্যসংখ্যক কিছু ঘটনার জন্য পুলিশ আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে কিছু অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করেছিল। এ প্রসঙ্গে অন্তত রাজশাহী জেলার একটি ঘটনার কথা মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এর পরও ফতোয়ার ঘোষণা স্তব্ধ হয়নি। এ কারণেই বিষয়টি উদ্বেগজনক।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এক দশকের অধিককাল ধরে ইসলামের নামে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার ঘটনাবলি। সরকার এ জন্য আইনি পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। জঙ্গি তৎপরতার ধারাবাহিকতায় একসময় একটি লিফলেট জঙ্গিরা প্রচার করে। বিষয়বস্তু ছিল, বাংলাদেশে সংবিধানসম্মত ও প্রচলিত আদালতের বিচার করার কোনো ক্ষমতাই নেই। বলা নিষ্প্রয়োজন যে তাদের এ যুক্তি এ দেশের আপামর জনসাধারণ গ্রহণ করেনি। এর অর্থ কি এই নয় যে নাগরিকরা এ ধরনের প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে রায় দিয়েছে এবং সংবিধানসহ প্রচলিত আইনের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেছে। ঐতিহাসিকভাবেও এ বিষয়টি সত্য যে ব্রিটিশ শাসনামলে উপমহাদেশে বহু নতুন আইন করা হয়েছিল, যা ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। এর ফলে সামাজিক ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন সাধিত হয়। এ পরিবর্তন রাজনৈতিক চেতনারও সহায়ক হয়, যে চেতনার পরিসমাপ্তি ঘটে ঔপনিবেশিক শাসনের বিলুপ্তির মাধ্যমে। পরবর্তীকালে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কুশাসনের বিলুপ্তি হয়।
শাসনব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুপ্রবেশের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ও দৃশ্যমান_যৌতুকপ্রথা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী যৌতুকপ্রথার ফলে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই অন্তত ২৩ জন নারী মৃত্যুবরণ করেন ও ১১ জন শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। এ সংক্রান্ত ২০১০ সালের পরিসংখ্যানেও বলা হয়েছে, ওই বছর মৃতের সংখ্যা ছিল ২৪৯ এবং নির্যাতনের ঘটনা ছিল ১২২টি। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ ধরনের অপরাধের মাত্রা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। এসব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাপ্রবাহ এমন সময় দৃশ্যমান, যখন দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নারী অধিকার নিশ্চিত করতে সোচ্চার। সব সরকারই কম-বেশি এ বিষয়ে সমর্থনও দিয়েছে। এ বিষয়ে যে কথা বলা যায় তা হলো, ধর্মকে শাসনব্যবস্থা থেকে পৃথক করে ব্যক্তিগত গণ্ডির মধ্যেই সীমিত রাখা সুশাসনের জন্য সহায়ক। এটা করা হলে নারী অধিকারও হুমকির মুখে পড়বে। এ ক্ষেত্রে অন্য বিষয়টি হলো, বাল্যবিয়ে। ব্রিটিশ আমলেই এ ধরনের কু-প্রথাকে প্রতিরোধ করার জন্য বিবাহের নিম্নতম বয়সসীমা আইনের দ্বারা নির্ধারিত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এ আইনের কিছু ইতিবাচক সংস্কারও করা হয়। সম্প্রতি ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে বিদ্যমান আইনও কার্যকর নয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রসহ নাগরিকদের আরো গঠনমূলক ভূমিকার প্রয়োজন।
চলমান ঘটনাপ্রবাহের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এ ধরনের মামলার ফলে উচ্চতর আদালতের কার্যপরিধি কিছুটা হলেও অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ কারণে আদালত এমন সব মামলা নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হচ্ছে, যা প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের দায়িত্ব। এক কথায় বলা যায়, বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের ধারা জাতি গঠনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে সক্ষম নয়। রাজনৈতিক দল ও সামাজিক নেতৃত্ব একযোগে যদি সংবিধান ও প্রচলিত আইনের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়, তাহলেই এ ধরনের মামলা আদালতে যাবে না। বর্তমানে কিছু বেসরকারি সংস্থা এ লক্ষ্যে কাজ করলেও রাজনৈতিক সমর্থনের ঘাটতির কারণে এদের চেষ্টা সফল হচ্ছে না। প্রায় সব ক্ষমতাসীন দলই মনে করে, আইন ও নীতি প্রণয়ন করলেই দায়িত্ব শেষ। বাস্তবে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রশাসনিক যন্ত্র যথেষ্ট দুর্বল। এদিকে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গ সচেতন হলে সুফল অর্জন করা সম্ভব হবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments