রঙ্গব্যঙ্গ-প্রতারক by মোস্তফা কামাল
ডাকনাম নীল। পুরো নাম খলিলুর রহমান নীল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছে সে। নিয়মিত পত্রিকা পড়ে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার জ্ঞান ভালো। কথায় কথায় ইংরেজি বলে। চটপটে এবং বাকপটুও বলা যায় তাকে। কিন্তু সে বেকার। একটা চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাকরি পায়নি। কেন পায়নি তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
তার ধারণা, সে বেশি জানে। এটা তার জন্য একটা সমস্যা। বেশি জানা লোকদের ভাত জোটে না। তারও এখন সে অবস্থা হয়েছে। দীর্ঘদিন গ্রামে অলস সময় কাটানোর পর সে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় মোহাম্মদপুরে একটি মেসে ওঠে। সেই মেসে তার পরিচয় হয় আরেক যুবকের সঙ্গে। তার নাম জুনায়েদ হোসেন প্রিন্স।
নীল ভাবে, প্রিন্স আমার মতোই বেকার। কোনো কাজ করে না! অথচ তার কাছে টাকা-পয়সার অভাব নেই। ঘটনা কী! এত টাকা সে কোথায় পায়? নীল প্রিন্সের কাছে এ বিষয়ে জানতে চায়। জবাবে সে নীলকে বলে, 'শোনো নীল, এভাবে মেসে ঝিম মেরে বসে থাকলে পেটে ভাত জুটবে না। ঢাকা শহর বড় কঠিন জায়গা। আবার এখানে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে পারলে রাজার হালতে থাকা যায়! ঢাকা শহরে টাকা বাতাসে ওড়ে। কেবল ধরতে জানতে হয়! বুঝতে পারছ?'
নীল বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, 'বল কি! টাকা বাতাসে ওড়ে!'
'কেন, তোমার বিশ্বাস হয় না?'
'বিশ্বাসের কথা বললে তো বিশ্বাস হবে! আমি কত দিন ধরে ঢাকা শহরে ঘুরলাম। কোথাও তো টাকা উড়তে দেখলাম না!'
'ঠিক আছে, তুমি আমার সঙ্গে এসো। তুমি চুপচাপ শুধু দেখবে। কোনো কথা বলবে না। আর তুমি তো শিক্ষিত মানুষ। তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে, কোথায় কোন কথা বলা যায়! ঠিক আছে?'
নীল প্রিন্সের কথায় সায় দিল। তারপর তার সঙ্গে বাইরে বের হলো। প্রিন্স তাকে তার অফিসে নিয়ে গেল। এটি তার মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের অফিস। অফিসের সামনের দিকটা ব্যাংকের মতো করে সাজানো। সামনের দিকে দুটি জমার কাউন্টার রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখে, বিশাল দুটি লাইন। লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে টাকা। ১০টায় অফিস খোলার পর তারা টাকা জমা দেবে। সর্বনিম্ন জমা পাঁচ শ টাকা। পাঁচ শ টাকায় এক মাসে এক হাজার টাকা আর এক বছরে পঁচিশ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এক হাজার টাকা জমা দিলে এক মাস পর দুই হাজার এবং এক বছর পর ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
মানুষ ভাবে, হঠাৎ বড় লোক হওয়ার এর চেয়ে সহজ উপায় আর কী আছে! তা ছাড়া এটা একটা বড় সুযোগও! এই সুযোগ কোনো দিন আসবে কি না সন্দেহ। তাই তারা টাকা জমা দেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কার আগে কে দেবে- এ নিয়ে রীতিমতো ঝগড়াঝাটি!
নীল বসে বসে টাকা জমা দেওয়ার দৃশ্য দেখে আর ভাবে, হায় রে মানুষ! কত বোকা হতে পারে! একবারও ভাবে না, পাঁচ শ জমা দিলে এক মাসে কি এক হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব? সে আবার ভাবে, জাকগে, এসব ভেবে লাভ নেই। যার টাকা সে যদি নদীতে ফালায় তাতে আমার কী!
মাত্র দুই ঘণ্টা জমা নেওয়ার পর বুথ বন্ধ করে দেওয়া হলো। যদিও টাকা জমা দেওয়ার জন্য আরো অনেকেই অপেক্ষমাণ ছিলেন। বলা হলো, পরদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত টাকা জমা নেওয়া হবে। এরপর জমার টাকা গণনা শুরু হলো। দেখা গেল, দুই ঘণ্টায় ১০ লাখ টাকা জমা পড়েছে। এত টাকা দেখে নীলের চোখ তো ছানাবড়া। সে মনে মনে বলে, প্রিন্স তো ঠিকই বলেছে! ঢাকা শহরে তো টাকা বাতাসেই ওড়ে!
প্রিন্স হঠাৎ নীলের কাঁধের ওপর হাত রাখল। এতে চমকে উঠল নীল। নীল কিছু বলার আগেই প্রিন্স বলল, 'কি, আমার কথা সত্যি হয়েছে তো?'
নীল ইতিবাচক মাথা নেড়ে বলে, 'সত্যি, এক শ ভাগ সত্যি।'
'তাহলে তুমিও ধরার চেষ্টা করো!'
'কিভাবে করব? আমার কথায় কে টাকা দেবে? এক শ টাকা ধার চাইলে কেউ দিতে চায় না!'
'হুম, বুঝতে পারছি। তোমাকে আরেকটু চতুর বানাতে হবে। মিথ্যা সত্য বানিয়ে বলা আর তিলকে তাল করার কৌশল তোমাকে শেখাতে হবে। তুমি একটা কাজ করো। আমার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে তুমি টাকা ধরার চেষ্টা করো।'
'সেই চেষ্টা না হয় করলাম! কিন্তু পাঁচ শ টাকায় এক মাস পর এক হাজার টাকা কী করে দেব?'
'ওটা নিয়ে তোমার আপাতত মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি শুধু ক্যাম্পেইনটা চালিয়ে যাও। বাকিটা আমি দেখছি।'
নীল মনে মনে ভাবে, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। পেটে ক্ষুধা নিয়ে নীতিবাক্য ঝেড়ে লাভ নেই। আপাতত প্রিন্সের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। তারপর যা হওয়ার হবে। নীল প্রিন্সকে বলল, আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি। তুমি যা বলবে আমি তা-ই করব।
প্রিন্স নীলের হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলে- ওকে, তাহলে আজ থেকেই শুরু হোক আমাদের পথচলা।
নীল সারা ঢাকা শহরে প্রচার-প্রপাগান্ডা শুরু করে। আর প্রিন্সের দায়িত্ব হচ্ছে, টাকা জমা নেওয়া এবং অফিস সামলানো। টানা দুই বছর এভাবে চলতে থাকল। প্রতিদিন হাজারো মানুষ তাদের কাছে টাকা জমা করে। সেই টাকা দিয়ে তারা কোথাও জমি কেনে। কোথাও কেনে বিল্ডিং কিংবা ফ্ল্যাট। মানুষের টাকায় তারা নতুন দামি গাড়িও হাঁকায়। মাত্র দুই বছরে তারা কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়। একটা পর্যায়ে প্রিন্স ভাবে, এই ব্যবসা আর কন্টিনিউ করা যাবে না। তাহলে ধরা খেতে হবে।
তারপর একদিন তারা অফিসে তালা ঝুলিয়ে চম্পট দিল। পরদিন লোকজন এসে দেখল, অফিস বন্ধ! তাদের বুঝতে আর বাকি রইল না। তারা অর্থ হারানোর শোকে একেবারে পাথর হয়ে গেল। নির্বাক লোকগুলো শুধু বলল, এরা প্রতারক...!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
নীল ভাবে, প্রিন্স আমার মতোই বেকার। কোনো কাজ করে না! অথচ তার কাছে টাকা-পয়সার অভাব নেই। ঘটনা কী! এত টাকা সে কোথায় পায়? নীল প্রিন্সের কাছে এ বিষয়ে জানতে চায়। জবাবে সে নীলকে বলে, 'শোনো নীল, এভাবে মেসে ঝিম মেরে বসে থাকলে পেটে ভাত জুটবে না। ঢাকা শহর বড় কঠিন জায়গা। আবার এখানে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে পারলে রাজার হালতে থাকা যায়! ঢাকা শহরে টাকা বাতাসে ওড়ে। কেবল ধরতে জানতে হয়! বুঝতে পারছ?'
নীল বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, 'বল কি! টাকা বাতাসে ওড়ে!'
'কেন, তোমার বিশ্বাস হয় না?'
'বিশ্বাসের কথা বললে তো বিশ্বাস হবে! আমি কত দিন ধরে ঢাকা শহরে ঘুরলাম। কোথাও তো টাকা উড়তে দেখলাম না!'
'ঠিক আছে, তুমি আমার সঙ্গে এসো। তুমি চুপচাপ শুধু দেখবে। কোনো কথা বলবে না। আর তুমি তো শিক্ষিত মানুষ। তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে, কোথায় কোন কথা বলা যায়! ঠিক আছে?'
নীল প্রিন্সের কথায় সায় দিল। তারপর তার সঙ্গে বাইরে বের হলো। প্রিন্স তাকে তার অফিসে নিয়ে গেল। এটি তার মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের অফিস। অফিসের সামনের দিকটা ব্যাংকের মতো করে সাজানো। সামনের দিকে দুটি জমার কাউন্টার রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখে, বিশাল দুটি লাইন। লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে টাকা। ১০টায় অফিস খোলার পর তারা টাকা জমা দেবে। সর্বনিম্ন জমা পাঁচ শ টাকা। পাঁচ শ টাকায় এক মাসে এক হাজার টাকা আর এক বছরে পঁচিশ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এক হাজার টাকা জমা দিলে এক মাস পর দুই হাজার এবং এক বছর পর ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
মানুষ ভাবে, হঠাৎ বড় লোক হওয়ার এর চেয়ে সহজ উপায় আর কী আছে! তা ছাড়া এটা একটা বড় সুযোগও! এই সুযোগ কোনো দিন আসবে কি না সন্দেহ। তাই তারা টাকা জমা দেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কার আগে কে দেবে- এ নিয়ে রীতিমতো ঝগড়াঝাটি!
নীল বসে বসে টাকা জমা দেওয়ার দৃশ্য দেখে আর ভাবে, হায় রে মানুষ! কত বোকা হতে পারে! একবারও ভাবে না, পাঁচ শ জমা দিলে এক মাসে কি এক হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব? সে আবার ভাবে, জাকগে, এসব ভেবে লাভ নেই। যার টাকা সে যদি নদীতে ফালায় তাতে আমার কী!
মাত্র দুই ঘণ্টা জমা নেওয়ার পর বুথ বন্ধ করে দেওয়া হলো। যদিও টাকা জমা দেওয়ার জন্য আরো অনেকেই অপেক্ষমাণ ছিলেন। বলা হলো, পরদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত টাকা জমা নেওয়া হবে। এরপর জমার টাকা গণনা শুরু হলো। দেখা গেল, দুই ঘণ্টায় ১০ লাখ টাকা জমা পড়েছে। এত টাকা দেখে নীলের চোখ তো ছানাবড়া। সে মনে মনে বলে, প্রিন্স তো ঠিকই বলেছে! ঢাকা শহরে তো টাকা বাতাসেই ওড়ে!
প্রিন্স হঠাৎ নীলের কাঁধের ওপর হাত রাখল। এতে চমকে উঠল নীল। নীল কিছু বলার আগেই প্রিন্স বলল, 'কি, আমার কথা সত্যি হয়েছে তো?'
নীল ইতিবাচক মাথা নেড়ে বলে, 'সত্যি, এক শ ভাগ সত্যি।'
'তাহলে তুমিও ধরার চেষ্টা করো!'
'কিভাবে করব? আমার কথায় কে টাকা দেবে? এক শ টাকা ধার চাইলে কেউ দিতে চায় না!'
'হুম, বুঝতে পারছি। তোমাকে আরেকটু চতুর বানাতে হবে। মিথ্যা সত্য বানিয়ে বলা আর তিলকে তাল করার কৌশল তোমাকে শেখাতে হবে। তুমি একটা কাজ করো। আমার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে তুমি টাকা ধরার চেষ্টা করো।'
'সেই চেষ্টা না হয় করলাম! কিন্তু পাঁচ শ টাকায় এক মাস পর এক হাজার টাকা কী করে দেব?'
'ওটা নিয়ে তোমার আপাতত মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি শুধু ক্যাম্পেইনটা চালিয়ে যাও। বাকিটা আমি দেখছি।'
নীল মনে মনে ভাবে, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। পেটে ক্ষুধা নিয়ে নীতিবাক্য ঝেড়ে লাভ নেই। আপাতত প্রিন্সের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। তারপর যা হওয়ার হবে। নীল প্রিন্সকে বলল, আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি। তুমি যা বলবে আমি তা-ই করব।
প্রিন্স নীলের হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলে- ওকে, তাহলে আজ থেকেই শুরু হোক আমাদের পথচলা।
নীল সারা ঢাকা শহরে প্রচার-প্রপাগান্ডা শুরু করে। আর প্রিন্সের দায়িত্ব হচ্ছে, টাকা জমা নেওয়া এবং অফিস সামলানো। টানা দুই বছর এভাবে চলতে থাকল। প্রতিদিন হাজারো মানুষ তাদের কাছে টাকা জমা করে। সেই টাকা দিয়ে তারা কোথাও জমি কেনে। কোথাও কেনে বিল্ডিং কিংবা ফ্ল্যাট। মানুষের টাকায় তারা নতুন দামি গাড়িও হাঁকায়। মাত্র দুই বছরে তারা কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়। একটা পর্যায়ে প্রিন্স ভাবে, এই ব্যবসা আর কন্টিনিউ করা যাবে না। তাহলে ধরা খেতে হবে।
তারপর একদিন তারা অফিসে তালা ঝুলিয়ে চম্পট দিল। পরদিন লোকজন এসে দেখল, অফিস বন্ধ! তাদের বুঝতে আর বাকি রইল না। তারা অর্থ হারানোর শোকে একেবারে পাথর হয়ে গেল। নির্বাক লোকগুলো শুধু বলল, এরা প্রতারক...!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments