অ্যানথ্রাক্স-পরীক্ষা ছাড়া গরু জবাই বন্ধ করতে হবে by আবুল হাসনাত
কিছুদিন ধরে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ার খবর দেখা যাচ্ছে। শুরুতে সিরাজগঞ্জ ও পাবনা এলাকায় সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর গত কয়েক দিনে জামালপুর, টাঙ্গাইল, পঞ্চগড়, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সারা দেশের সব কর্মকর্তাকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে আতঙ্ক নয়, দরকার সচেতনতা। এ জন্য কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে ধরা হলো।
জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কক প্রথম আবিষ্কার করেন, ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়াই অ্যানথ্রাক্সের জন্য দায়ী। দেখতে অনেকটা রডের মতো লম্বাটে, তবে মাটিতে এ ব্যাকটেরিয়া বৃত্তাকার স্পোর হিসেবে ১০০ বছর বেঁচে থাকতে পারে। এরা সহজে ধ্বংস হয় না এবং যেকোনো সময় সুযোগ পেলেই আক্রমণ করতে পারে। এ ব্যাকটেরিয়া সাধারণত গরু, ছাগল, ভেড়া ও ঘোড়াকে আক্রমণ করে থাকে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এলে বা পশুর মাংস বা পশু থেকে উৎপন্ন খাবার বা দ্রব্যাদির সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে মানুষ থেকে মানুষে এ রোগ ছড়ায় না। বিভিন্ন জেলায় মানুষ আক্রান্ত হয়েছে পশুর মাধ্যমে।
উন্নত বিশ্বে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ খুব একটা হয় না। তবে যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলার পর বিদেশি জঙ্গিদের দ্বারা খামের মধ্যে পাঠানো অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণে সে সময় পাঁচজনের মৃত্যু ঘটেছিল। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এবং দুর্বল রোগ নিবারণব্যবস্থার কারণে এ রোগ সহজেই সংক্রমিত হতে পারে।
অ্যানথ্রাক্স তিন ধরনের, কিউটেনিয়াস বা চামড়ার অ্যানথ্রাক্স, শ্বাসনালি বা ফুসফুসের অ্যানথ্রাক্স এবং গ্যাসট্রোইনটেসটিনাল বা পাকস্থলী অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স। যদি চামড়া কোথাও কেটে বা ছিঁড়ে যায় বা ক্ষত দেখা যায়, তাহলে অ্যানথ্রাক্স এসব ক্ষতস্থান দিয়ে সহজেই শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং চামড়ায় এর ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিতে পারে। ফলে চামড়ার ওপর ফুলে লাল ফোসকার মতো আকার ধারণ করতে পারে। মাংসপেশিতে ব্যথা, মাথাব্যথা, জ্বর, বমি বা বমিভাব ইত্যাদি এ রোগের প্রধান উপসর্গ। এ রোগের চিকিৎসা তুলনামূলক সহজ।
জীবাণুটি যদি শ্বাসনালির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে তাহলে ফুসফুসের অ্যানথ্রাক্স জন্ম দিতে পারে। দেরিতে চিকিৎসা শুরু করলে এ ধরনের অ্যানথ্রাক্সে বাঁচার সম্ভাবনা কম থাকে। বুকের ভেতর লিম্ফনোডে প্রবেশ করে ব্যাকটেরিয়াটি বংশবিস্তার করে এবং টক্সিন উৎপন্ন করতে থাকে। এই টক্সিনই মৃত্যুর জন্য মূলত দায়ী। অ্যানটিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াটিকে ধ্বংস করলেও টক্সিনকে ধ্বংস করতে পারে না। এ রোগের প্রধান উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। এ ছাড়া গলা ফুলে যায়, জ্বর, মাংসপেশির ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দিতে পারে। সর্বশেষটি হলো পাকস্থলি অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে এ ধরনের অ্যানথ্রাক্স হতে পারে। ক্ষুধামান্দ্য, বমি বমি ভাব, রক্ত ডায়রিয়া, জ্বর, তলপেটে ব্যথা ইত্যাদি ধরন অ্যানথ্রাক্সের মূল উপসর্গ। সময়মতো অ্যান্টিবায়োটিক নিলে এ রোগ থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব।
এ রোগের চিকিৎসা নিয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ করা সম্ভব। চামড়ার অ্যানথ্রাক্স সিপ্রোফ্লক্সাসিন বা ডক্সিসাইক্লিন ট্যাবলেট দ্বারা চিকিৎসা করা সম্ভব। ৬০ দিন পর্যন্ত ওষুধ নেওয়া যেতে পারে। তবে জরুরি প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ইন্ট্রাভেনাস রুটে সরাসরি রক্তে সরবরাহ করা হয়। ফুসফুসের অ্যানথ্রাক্স হলে অবশ্যই ওষুধ সরাসরি রক্তে সরবরাহ করতে হবে। ওপরের ওষুধগুলোর পাশাপাশি কমপক্ষে আরও দুই-তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হবে। যেমন—রিফামপিন, ভ্যানকোমাইসিন, অ্যামপিসিলিন, ক্লোরামফেনিকল, ইমিপেনেম, ক্ল্যারিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি। পাকস্থলী-অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্সেও একই ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে এরই মধ্যে সরকার বেশ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারি নির্দেশাবলি মেনে চললে এবং নিচে উল্লিখিত উপদেশগুলো মেনে চললে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ করা সম্ভব:
১. কোনোভাবেই অসুস্থ পশু জবাই করে মাংস খাওয়া যাবে না। ২. মৃত পশুকে কমপক্ষে ছয় হাত গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অসুস্থ পশুর সব মলমূত্র, ব্যবহূত জিনিসপত্র একইভাবে গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে। ৩. জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে আক্রান্ত স্থান পরিষ্কার করতে হবে। ৪. সুস্থ গবাদিপশুকে ভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. এক এলাকার গবাদিপশু যেন অন্য এলাকায় যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬. খালি হাতে অসুস্থ বা মৃত গবাদিপশু স্পর্শ করা যাবে না। অবশ্যই গ্লাভস বা পলিথিন ব্যবহার করতে হবে। ৭. গণসচেতনতা বাড়ানোর জন্য ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সবশেষে সরকারকে অনুরোধ করব, কোনোভাবেই ঢাকা শহরে পরীক্ষা ছাড়া গরু জবাই করতে যাতে না দেওয়া হয়। ঢাকা শহর খুবই জনবহুল বলে একবার সংক্রামিত হলে এটা এখানে মহামারি আকার ধারণ করতে বেশি সময় লাগবে না।
ড. আবুল হাসনাত: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ahasnat99@yahoo.com
জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কক প্রথম আবিষ্কার করেন, ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়াই অ্যানথ্রাক্সের জন্য দায়ী। দেখতে অনেকটা রডের মতো লম্বাটে, তবে মাটিতে এ ব্যাকটেরিয়া বৃত্তাকার স্পোর হিসেবে ১০০ বছর বেঁচে থাকতে পারে। এরা সহজে ধ্বংস হয় না এবং যেকোনো সময় সুযোগ পেলেই আক্রমণ করতে পারে। এ ব্যাকটেরিয়া সাধারণত গরু, ছাগল, ভেড়া ও ঘোড়াকে আক্রমণ করে থাকে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এলে বা পশুর মাংস বা পশু থেকে উৎপন্ন খাবার বা দ্রব্যাদির সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে মানুষ থেকে মানুষে এ রোগ ছড়ায় না। বিভিন্ন জেলায় মানুষ আক্রান্ত হয়েছে পশুর মাধ্যমে।
উন্নত বিশ্বে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ খুব একটা হয় না। তবে যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলার পর বিদেশি জঙ্গিদের দ্বারা খামের মধ্যে পাঠানো অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণে সে সময় পাঁচজনের মৃত্যু ঘটেছিল। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এবং দুর্বল রোগ নিবারণব্যবস্থার কারণে এ রোগ সহজেই সংক্রমিত হতে পারে।
অ্যানথ্রাক্স তিন ধরনের, কিউটেনিয়াস বা চামড়ার অ্যানথ্রাক্স, শ্বাসনালি বা ফুসফুসের অ্যানথ্রাক্স এবং গ্যাসট্রোইনটেসটিনাল বা পাকস্থলী অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স। যদি চামড়া কোথাও কেটে বা ছিঁড়ে যায় বা ক্ষত দেখা যায়, তাহলে অ্যানথ্রাক্স এসব ক্ষতস্থান দিয়ে সহজেই শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং চামড়ায় এর ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিতে পারে। ফলে চামড়ার ওপর ফুলে লাল ফোসকার মতো আকার ধারণ করতে পারে। মাংসপেশিতে ব্যথা, মাথাব্যথা, জ্বর, বমি বা বমিভাব ইত্যাদি এ রোগের প্রধান উপসর্গ। এ রোগের চিকিৎসা তুলনামূলক সহজ।
জীবাণুটি যদি শ্বাসনালির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে তাহলে ফুসফুসের অ্যানথ্রাক্স জন্ম দিতে পারে। দেরিতে চিকিৎসা শুরু করলে এ ধরনের অ্যানথ্রাক্সে বাঁচার সম্ভাবনা কম থাকে। বুকের ভেতর লিম্ফনোডে প্রবেশ করে ব্যাকটেরিয়াটি বংশবিস্তার করে এবং টক্সিন উৎপন্ন করতে থাকে। এই টক্সিনই মৃত্যুর জন্য মূলত দায়ী। অ্যানটিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াটিকে ধ্বংস করলেও টক্সিনকে ধ্বংস করতে পারে না। এ রোগের প্রধান উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। এ ছাড়া গলা ফুলে যায়, জ্বর, মাংসপেশির ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দিতে পারে। সর্বশেষটি হলো পাকস্থলি অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে এ ধরনের অ্যানথ্রাক্স হতে পারে। ক্ষুধামান্দ্য, বমি বমি ভাব, রক্ত ডায়রিয়া, জ্বর, তলপেটে ব্যথা ইত্যাদি ধরন অ্যানথ্রাক্সের মূল উপসর্গ। সময়মতো অ্যান্টিবায়োটিক নিলে এ রোগ থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব।
এ রোগের চিকিৎসা নিয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ করা সম্ভব। চামড়ার অ্যানথ্রাক্স সিপ্রোফ্লক্সাসিন বা ডক্সিসাইক্লিন ট্যাবলেট দ্বারা চিকিৎসা করা সম্ভব। ৬০ দিন পর্যন্ত ওষুধ নেওয়া যেতে পারে। তবে জরুরি প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ইন্ট্রাভেনাস রুটে সরাসরি রক্তে সরবরাহ করা হয়। ফুসফুসের অ্যানথ্রাক্স হলে অবশ্যই ওষুধ সরাসরি রক্তে সরবরাহ করতে হবে। ওপরের ওষুধগুলোর পাশাপাশি কমপক্ষে আরও দুই-তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হবে। যেমন—রিফামপিন, ভ্যানকোমাইসিন, অ্যামপিসিলিন, ক্লোরামফেনিকল, ইমিপেনেম, ক্ল্যারিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি। পাকস্থলী-অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্সেও একই ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে এরই মধ্যে সরকার বেশ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারি নির্দেশাবলি মেনে চললে এবং নিচে উল্লিখিত উপদেশগুলো মেনে চললে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ করা সম্ভব:
১. কোনোভাবেই অসুস্থ পশু জবাই করে মাংস খাওয়া যাবে না। ২. মৃত পশুকে কমপক্ষে ছয় হাত গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অসুস্থ পশুর সব মলমূত্র, ব্যবহূত জিনিসপত্র একইভাবে গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে। ৩. জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে আক্রান্ত স্থান পরিষ্কার করতে হবে। ৪. সুস্থ গবাদিপশুকে ভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. এক এলাকার গবাদিপশু যেন অন্য এলাকায় যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬. খালি হাতে অসুস্থ বা মৃত গবাদিপশু স্পর্শ করা যাবে না। অবশ্যই গ্লাভস বা পলিথিন ব্যবহার করতে হবে। ৭. গণসচেতনতা বাড়ানোর জন্য ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সবশেষে সরকারকে অনুরোধ করব, কোনোভাবেই ঢাকা শহরে পরীক্ষা ছাড়া গরু জবাই করতে যাতে না দেওয়া হয়। ঢাকা শহর খুবই জনবহুল বলে একবার সংক্রামিত হলে এটা এখানে মহামারি আকার ধারণ করতে বেশি সময় লাগবে না।
ড. আবুল হাসনাত: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ahasnat99@yahoo.com
No comments