সিরিয়া-আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিষ্করুণ খেলাক্ষেত্র by মশিউল আলম

জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ অমানুষ, তাঁর ক্ষমতা অবৈধ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বারবার বলছেন, আসাদকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান নেতা জন ম্যাককেইন বললেন, সিরিয়ার ব্যাপারে ওবামা সরকার কিছু করতে পারছে না বলে সে সরকারের লজ্জিত হওয়া উচিত।


সিরিয়াসংকট নিরসনকল্পে জাতিসংঘ ও আরব লিগের নিয়োজিত বিশেষ দূত কফি আনান বৃহস্পতিবার ভীষণ হতাশ কণ্ঠে জানিয়েছেন, সিরিয়ায় তাঁর শান্তিপরিকল্পনা কাজে আসছে না। নিউইয়র্ক টাইমস ৮ জুন এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম ‘আসাদ, দ্য বুচার’। এই পত্রিকা বলছে, গত দুই সপ্তাহে আসাদের সামরিক বাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা চারটি বড় ধরনের হামলা চালিয়ে কয়েক শ নিরীহ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে। হুলা নামের একটি গ্রামে হামলা চালিয়ে তারা একসঙ্গে হত্যা করেছে ১০৮ জন মানুষকে, তাদের মধ্যে ৩৯ জনই শিশু। আল-কুবেইর নামের আরেক গ্রামে তারা একসঙ্গে হত্যা করেছে ৭৮ জনকে। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল কয়েক দিন ধরে হত্যাযজ্ঞের স্থান পরিদর্শনে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, তাদের লক্ষ করে কারা যেন গুলি ছুড়েছে। অবশেষে তারা সেখানে যেতে পেরেছে। সেখানে মানুষের পোড়া মাংসের গন্ধ, পোড়া দেহাবশেষ, ছিন্নভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখতে পেয়েছে তারা। প্রত্যক্ষদর্শী ও বেঁচে যাওয়া লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পেরেছে, সরকারি সেনা ও মিলিশিয়ারা শুধু কামান দাগেনি, শুধু গুলি করেনি, ছুরি আর কুড়ালও ব্যবহার করেছে মানুষ মারার কাজে।
সিরিয়ার সরকার এসব হত্যাযজ্ঞের দায় স্বীকার করেনি; বলছে এগুলো সেই সব ‘সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের’ অপকর্ম, যারা ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ নামে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং সারা সিরিয়ায় রক্তপাত চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে তিউনিসিয়ায় শুরু হয়ে মিসর দিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে যে বিপুল গণজাগরণ শুরু হয়, সে সময় পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তার নাম দিয়েছিল অ্যারাব স্প্রিং রেভ্যুলেশান, সংক্ষেপে অ্যারাব রেভ্যুলেশান। সেই থেকে আমরাও বলি আরব বসন্ত। সিরিয়াতেও সেই বসন্তের বাতাস লাগে সে বছরেরই মার্চে। তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক বেন আলি তত দিনে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সৌদি আরবে; ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে খাঁচায় ঢুকতে বাধ্য হয়েছেন মিসরের জবরদস্ত স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক। লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ সংগঠিত হতে শুরু করেছে। ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার মানুষও শুরু করে তাদের স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের পতনের আন্দোলন। কিন্তু দেখা গেল, তিউনিসিয়া বা মিসরের মতো সহজ নয় ব্যাপারটা। বসন্ত ফুরিয়ে গেল, গ্রীষ্মকাল চলে এল, কিন্তু আসাদবিরোধী বিক্ষোভ-প্রতিবাদের কোনো পরিণতি নেই। ব্যক্তি আসাদ নরম-সরম ভদ্রলোক বলে পরিচিত হলেও পৈতৃক সূত্রে পাওয়া রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর তাঁর দাবি এতটাই দৃঢ় যে তিনি প্রাণপণে আঁকড়ে রইলেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে এখন আরব বসন্তের বদলে লেখা হচ্ছে এক্সটেন্ডেট অ্যারাব সামার বা দীর্ঘায়িত আরব গ্রীষ্ম।
বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে তাড়ানোর যে সংগ্রাম ২০১১ সালের মার্চ মাসে শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে তিউনিসিয়া ও মিসরের অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ নাগরিক গণজাগরণের অনেক তফাত। তিউনিসিয়ায় এক ফলবিক্রেতা যুবক নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মাহুতি দিলে গোটা তিউনিসীয় যুবসমাজে যে বিক্ষোভ স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছিল, তা ছিল ভীষণ ক্ষিপ্র। তা ছিল একেবারেই অসংগঠিত, এক শ ভাগ স্বতঃস্ফূর্ত। তাই মহাদুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসক জয়নাল আবদিন বেন আলিকে প্রাণ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হয় খুব তাড়াতাড়ি। মিসরের তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভও ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবসমাজ ও পেশাজীবীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ। তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভের প্রায় অর্ধেক ছিল নারী; কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী, কবি, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, যারা ফেসবুক-টুইটারে বার্তা ও রাজনৈতিক লিফলেট চালাচালি করেছে, মিসরের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের মতো করে মেনিফেস্টো রচনা করে ইন্টারনেটে সহনাগরিকদের মধ্যে প্রচার করেছে। তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভে রক্তপাত ঘটে একটা পর্যায়ে, যখন মোবারক সরকার নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দেয়।
কিন্তু সিরিয়ার কোথাও তাহরির স্কয়ারের মতো শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ-প্রতিবাদ নেই। সিরিয়ার এই ‘বিপ্লবে’ কোথাও নারীর দেখা পাওয়া যায় না, যেমন দেখা গিয়েছিল কায়রোর তাহরির স্কয়ারে। আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যারা আটঘাট বেঁধে, প্রাণ বাজি রেখে নেমেছে, তাদের হাতে অনেক ভারী ভারী আগ্নেয়াস্ত্র, তিউনিসিয়া বা মিসরে বেন আলি বা মোবারককে তাড়াতে যেসব অস্ত্রের প্রয়োজনই পড়েনি। সিরিয়ার এই আসাদ-বিরোধীরা ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ নামে সংগঠিত হয়েছে আসাদের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে। দৃশ্যটা অনেকখানি লিবিয়ার মতো। লিবিয়ায় কোনো গণজাগরণ ছিল না। নাগরিকেরা গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেনি। কিন্তু কেমন করে যেন, কোথা থেকে যেন দলে দলে তরুণ-যুবকের আবির্ভাব ঘটতে লাগল, যাদের কাঁধে রকেট লঞ্চার, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, হালকা মেশিনগান এবং পরের দিকে আরও ভারী ভারী অস্ত্র, সাঁজোয়া যানবাহন। গাদ্দাফি জবরদস্ত স্বৈরশাসক ছিলেন, গোটা লিবিয়াকে নিয়ে পরিণত করেছিলেন নিরেট এক পুলিশি রাষ্ট্রে; কোথায় যে গাদ্দাফির গুপ্তচর লুকিয়ে আছে—এই ভয়ে কাঠ হয়ে থাকত লিবিয়ার মানুষ। আরব বসন্তের কালে সেই লিবিয়ার লৌহপ্রাচীর কী করে ভেঙে গিয়েছিল, আর কী করে সম্ভব হয়েছিল সেই ‘রেজিম চেঞ্জ’, তার নেপথ্য কাহিনি নিশ্চয়ই অনেক কৌতূহলোদ্দীপক।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কথায় খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আমেরিকা সিরিয়ায় রেজিম চেঞ্জ বা সরকার পরিবর্তন করতে চায়। চায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম সারির দেশগুলোও। অর্থনৈতিক অবরোধ ইত্যাদি কোনো ফল দিচ্ছে না, ফল দেবেও না—এটা তারা বুঝতে পেরেছে। জাতিসংঘের বা আরব লিগের বিশেষ দূত কফি আনানের শান্তি উদ্যোগ কাজে আসবে না এটাও তারা জানে। দরকার সামরিক হস্তক্ষেপ, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা সেজন্য এক পায়ে খাড়া। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে দুই সদস্য রাশিয়া আর চীন একযোগে বলছে, সিরিয়ায় কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ করা চলবে না। সাংহাই কো-অপারেশান অর্গানাইজেশন নামের এক আঞ্চলিক সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ৬-৭ জুন বেইজিং গেলে সেখানে চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়ে অনেক ঘনিষ্ঠ আলোচনা হয়েছে, আর সিরিয়ার প্রশ্নে রুশ-চীন মতৈক্য আরও জোরালো হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট পুতিন ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরোভের বিভিন্ন বিবৃতি শুনে। গত শুক্রবার লাভরোভ বলেছেন, সিরিয়ায় জোর করে সরকার পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা মস্কো মেনে নেবে না। সমস্যাটা রাজনৈতিক পন্থায় সমাধান করতে হবে, সামরিক পন্থায় নয়। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য মস্কো একটা জরুরি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে রাজি আছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর ভাষায়, ‘কসাই আসাদ’ সিরিয়ায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটাচ্ছেন। ২০১১ সালের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ১৫ হাজার নিরীহ বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কফি আনান তাঁর শান্তি উদ্যোগের নিষ্ফলতায় হতাশ হয়ে সতর্ক করে দিচ্ছেন ‘গণহারে হত্যাযজ্ঞ সিরিয়ার দৈনন্দিন বাস্তবতায় পরিণত’ হতে যাচ্ছে। সেই সিরিয়ার কসাইকে গোপনে অস্ত্র জোগাচ্ছে রাশিয়া, চীন আর ইরান।
সিরিয়াকে নিয়ে বিশ্বরাজনীতির বড় বড় খেলোয়াড়ের খেলা জমে উঠেছে বেশ। কিন্তু এ খেলা বড়ই নির্মম।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.