নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-কী হবে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এখন বন্ধ। ছুটির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর। আগাম ছুটি দিয়ে রমজান ও ঈদের ছুটিকে প্রলম্বিত করা হলো বটে, কিন্তু ঘটনার রেশ এর মধ্যে শেষ হয়েছে, নাকি সময় ও সুযোগমতো তা আবার চাড়া দিয়ে উঠবে, নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।
গেল মাসের প্রথম দিকে বর্ধিত বেতন ও ফি প্রত্যাহারসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। বলাবাহুল্য, সে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নগরের ষোলশহরে জিইসি মোড় ও জামালখান এলাকায় এসে অবরোধ, ভাঙচুর ইত্যাদি জনদুর্ভোগ তৈরির পর ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত চড়াও হয়েছে নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ওপর। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভবনগুলো এখন যেন হয়ে উঠেছে অসহায়ত্বের প্রতীক।
বলেছি, ছাত্রদের আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করতে পারেনি। কিন্তু ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো কোনো ফোরামের (চাকসু নির্বাচন হয়নি গত ২০ বছর) অনুপস্থিতি বা ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর তৎপরতা নিষিদ্ধ থাকার পর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো পথ আসলে খোলা আছে কি না—সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
সিন্ডিকেটের সভায় ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এতে মাসে দুই থেকে আড়াই শ এবং বছরে প্রায় ৭০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার কথা। কর্তৃপক্ষ বলছেন, ছাত্র বেতন নয়, বরং পরীক্ষা, সনদ, মানোন্নয়ন ও অনিয়মিত (নন-কলেজিয়েট) ছাত্রদের জরিমানা ইত্যাদি মিলিয়ে বর্ধিত ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও ফি এখনো সর্বনিম্ন বলেও দাবি করেছেন তাঁরা। এ কথা তো ঠিক, দ্রব্যমূল্য ও সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় আনলে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন-ফি শায়েস্তা খাঁর আমলে থাকতে পারে না। এমনকি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র এককালে একটি প্রাইভেট টিউশনি করে যেখানে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতেন, তা এখন ক্ষেত্রবিশেষে এক থেকে তিন হাজার টাকায় পৌঁছেছে। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির স্বার্থে বেতন ও ফি কিছুটা বাড়ানো অযৌক্তিক নয়। তবে সেটা এক লাফে ৪০-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো কতটা সমীচীন, প্রশ্ন উঠবে সেটা নিয়ে। কেননা যে মেধাবী ছাত্ররা কঠিন ভর্তিযুদ্ধের বেড়া ডিঙিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসেন, তাঁদের অনেকেই দরিদ্র বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।
কথা হচ্ছে, ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যখন প্রতিবাদ জানালেন, আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনার উদ্যোগ কি নিয়েছিল? যত দূর জানি, উপাচার্য একজন ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন। ছাত্রদের কল্যাণে কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি?
শিক্ষক সমিতির নেতারা ফি বৃদ্ধির অজুহাতে ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষক সমিতিই কি পারত না মধ্যস্থতার কোনো উদ্যোগ নিতে? কিংবা খোদ উপাচার্যই কি শিক্ষক সমিতিকে সে রকম কোনো উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব দিতে পারতেন না?
উপাচার্য আবু ইউসুফ কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের কিছু অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে সফল হয়েছিলেন। আমাদের ধারণা, সেই সাফল্য তাঁকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল, যাতে তিনি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাবি উপেক্ষা করেছেন অনায়াসে। কিন্তু দুটি আন্দোলনের চরিত্র যে ভিন্ন তা বোঝার অক্ষমতাই ঘটনাকে এত দূর টেনে এনেছে বলে মনে করেন অনেকে। ছাত্রলীগের একাংশের দাবিটির মধ্যে ছিল নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নেওয়ার স্বার্থ, অন্যদিকে বেতন-ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে আন্দোলনটি বৃহত্তর ছাত্রসমাজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট।
তবে ৩ আগস্ট দাবি আদায়ের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-বাস, ব্যাংক, ল্যাবরেটরি, কম্পিউটার ভাঙচুর বা নথিপত্র জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা কিংবা এর আগে আরও দুই দিন ধরে নগরের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাঙচুরসহ অরাজকতা সৃষ্টির ঘটনা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট বা ছাত্র ফেডারেশনের মতো বামপন্থী প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো শুরুতে এ আন্দোলনের পুরোভাগে থাকলেও শেষ পর্যন্ত এর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি, বরং নেতৃত্বের ব্যর্থতা বা হঠকারিতা শিক্ষকসহ সমাজের সচেতন অংশের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে।
‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’—এ নিয়মে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ। মাত্র এক দিন আগে ঢাকায় মতিউর রহমান নিজামীসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার গ্রেপ্তারের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে এ রকম একটি সুযোগকে কাজে লাগাবে শিবির—এটাই ছিল স্বাভাবিক। কাপড়ে মুখ ঢাকা যেসব শিক্ষার্থী ভাঙচুরে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই শিবিরের কর্মী এবং তাঁদের সমর্থক বহিরাগতরাও যে ধ্বংসলীলায় যোগ দিয়েছিলেন—এমন তথ্যও পরদিন প্রকাশিত হয়েছে পত্রপত্রিকায়।
এ সুযোগে সোহরাওয়ার্দী হল থেকে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস-রেলস্টেশনে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য যারা ভাঙতে গিয়েছিল, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে তো সংশয় থাকার কথা নয়। অন্যদিকে ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে আন্দোলনে ছিল না, কিন্তু উপাচার্যের ওপর ক্ষুব্ধ দলের একাংশ পুরো ঘটনায় নানাভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে—এমন ধারণাও অমূলক নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা ও হল ত্যাগের নির্দেশের ফলে পরিস্থিতির ওপর কর্তৃপক্ষের আপাত-নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেছে, কিন্তু জটিলতা নিরসন হয়েছে বলে মনে হয় না। ঘটনার তদন্ত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা নিয়মানুযায়ী চলতে থাকুক, কিন্তু পাশাপাশি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাবিটি সহূদয় বিবেচনা করাও দরকার বলে মনে করি আমরা। এর জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন প্রবীণ শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে, তাঁদের আলোচনার টেবিলে এনে একটি সমাধানের সূত্র বের করা জরুরি। সর্বোপরি ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া দরকার। কেননা, নিষেধাজ্ঞার পদ্ধতি কতটা অকার্যকর, তার প্রমাণ তো আমরা পেয়েছি সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি মৃত্যুর ঘটনা ও ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময়। পাশাপাশি চাকসু নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণের বিষয়টিও ভাবতে পারে কর্তৃপক্ষ।
২.
এদিকে, অগ্নিগর্ভ হয়ে আছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিও। যত দূর আমরা জানি, মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্রের ক্ষোভ-বিক্ষোভের শিকার হয়ে বিপন্ন হতে চলেছে এ বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবন। উল্লেখ করা দরকার, চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও গণমাধ্যমগুলোর সমর্থন ও জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে এটি কলেজ থেকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ পেয়েছিল। ভেটেরিনারি কলেজকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা যেতে পারে, এ একাডেমিক রূপকল্পটি তৈরি হয়েছিল বর্তমান উপাচার্যের হাতেই।
আমরা নানা কারণে আশাবাদী ছিলাম এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নিয়ে। এযাবৎ এর মান এবং স্নাতকের ছাত্রদের কর্মসংস্থানের সাফল্য খুবই আশাব্যঞ্জক। এখানকার ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণের পর ভারতের চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুর দীর্ঘসময় ইন্টার্ন করার বিরল সুযোগ লাভ করে আসছে। পশুসম্পদ রক্ষা ও এর সম্ভাবনার ক্ষেত্র বিস্তৃত করার জন্য এখানকার ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হলে দেশ যে নানাভাবে উপকৃত হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ ক্যাম্পাসে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিয়মিত উপস্থিতি, বার্ষিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় উচ্চতর গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির আয়োজন সত্যিকারের একটি আলোর ইশারা দিয়েছিল আমাদের। এ পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি শিক্ষক উন্নত পশ্চিমা বিশ্বের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন বা অর্জনের শেষ পর্যায়ে আছেন। কিন্তু কিছু ছাত্রের একগুঁয়েমি ও উচ্ছৃঙ্খলতায় এ রকম সম্ভাবনাময় অগ্রগতি বিঘ্নিত হলে তা হবে দুঃখজনক।
ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর আচরণ ক্ষুদ্র উপদলীয় রাজনৈতিক মহল ছাড়া অন্যদের তেমন সমর্থন পেয়েছে বলে জানা নেই। সংশ্লিষ্ট একাধিক মন্ত্রী, সরকারদলীয় স্থানীয় সাংসদ ও সরকারের আমলারাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন নানান সময়। এমনকি এই ছাত্রদের দাবির মুখে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও, তাঁরা উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মতো কোনো অভিযোগ পাননি।
এত কিছুর পরও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে আরও।
আমাদের দুর্ভাগ্য, যেখানেই সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়, সেখানেই সেই বিকাশকে রুদ্ধ করার জন্য ভেতর থেকেই শুরু হয় নানান অপতৎপরতা। বর্তমান উপাচার্যের পদত্যাগ বিক্ষোভরত ছাত্রদের অন্যতম দাবি। উপাচার্য কে থাকবেন বা কে হবেন—সেটি আমাদের বিচার্য বিষয় নয়। আমাদের ভাবনার বিষয় হচ্ছে, এ সম্ভাবনাময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ও সাধারণ ছাত্রদের ভবিষ্যৎ। সে দিক থেকে বলব, যেকোনো বড় প্রতিষ্ঠানের রূপকল্প তৈরি ও গঠনপর্বের নেতৃত্ব বদলের ফলে ইতিপূর্বে অনেক প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নেতৃত্বের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখতে বলি।
আমরা মনে করি, সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। যেসব ছাত্রকে নানা মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রতি সদয় হতে পারে কি না, সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ বের করা যায় কি না—সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান। এখানকার ছাত্ররাও দেশের শিক্ষিত সমাজের উজ্জ্বল অংশ। ফলে এখানে উদ্ভূত যেকোনো সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত আলাপ-আলোচনার টেবিলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত করা, ভাঙচুর ও হানাহানির পথ ধরা কোনোভাবেই কাম্য নয়, সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা ছাত্রদের সহিষ্ণুতা ও কর্তৃপক্ষের ঔদার্য এবং উভয় পক্ষের সুবিবেচনা প্রত্যাশা করি।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
বলেছি, ছাত্রদের আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করতে পারেনি। কিন্তু ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করার মতো কোনো ফোরামের (চাকসু নির্বাচন হয়নি গত ২০ বছর) অনুপস্থিতি বা ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর তৎপরতা নিষিদ্ধ থাকার পর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো পথ আসলে খোলা আছে কি না—সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
সিন্ডিকেটের সভায় ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এতে মাসে দুই থেকে আড়াই শ এবং বছরে প্রায় ৭০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার কথা। কর্তৃপক্ষ বলছেন, ছাত্র বেতন নয়, বরং পরীক্ষা, সনদ, মানোন্নয়ন ও অনিয়মিত (নন-কলেজিয়েট) ছাত্রদের জরিমানা ইত্যাদি মিলিয়ে বর্ধিত ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও ফি এখনো সর্বনিম্ন বলেও দাবি করেছেন তাঁরা। এ কথা তো ঠিক, দ্রব্যমূল্য ও সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় আনলে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন-ফি শায়েস্তা খাঁর আমলে থাকতে পারে না। এমনকি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র এককালে একটি প্রাইভেট টিউশনি করে যেখানে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতেন, তা এখন ক্ষেত্রবিশেষে এক থেকে তিন হাজার টাকায় পৌঁছেছে। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির স্বার্থে বেতন ও ফি কিছুটা বাড়ানো অযৌক্তিক নয়। তবে সেটা এক লাফে ৪০-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো কতটা সমীচীন, প্রশ্ন উঠবে সেটা নিয়ে। কেননা যে মেধাবী ছাত্ররা কঠিন ভর্তিযুদ্ধের বেড়া ডিঙিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসেন, তাঁদের অনেকেই দরিদ্র বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।
কথা হচ্ছে, ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যখন প্রতিবাদ জানালেন, আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনার উদ্যোগ কি নিয়েছিল? যত দূর জানি, উপাচার্য একজন ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন। ছাত্রদের কল্যাণে কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি?
শিক্ষক সমিতির নেতারা ফি বৃদ্ধির অজুহাতে ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষক সমিতিই কি পারত না মধ্যস্থতার কোনো উদ্যোগ নিতে? কিংবা খোদ উপাচার্যই কি শিক্ষক সমিতিকে সে রকম কোনো উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব দিতে পারতেন না?
উপাচার্য আবু ইউসুফ কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের কিছু অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে সফল হয়েছিলেন। আমাদের ধারণা, সেই সাফল্য তাঁকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল, যাতে তিনি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাবি উপেক্ষা করেছেন অনায়াসে। কিন্তু দুটি আন্দোলনের চরিত্র যে ভিন্ন তা বোঝার অক্ষমতাই ঘটনাকে এত দূর টেনে এনেছে বলে মনে করেন অনেকে। ছাত্রলীগের একাংশের দাবিটির মধ্যে ছিল নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নেওয়ার স্বার্থ, অন্যদিকে বেতন-ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে আন্দোলনটি বৃহত্তর ছাত্রসমাজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট।
তবে ৩ আগস্ট দাবি আদায়ের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-বাস, ব্যাংক, ল্যাবরেটরি, কম্পিউটার ভাঙচুর বা নথিপত্র জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা কিংবা এর আগে আরও দুই দিন ধরে নগরের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাঙচুরসহ অরাজকতা সৃষ্টির ঘটনা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট বা ছাত্র ফেডারেশনের মতো বামপন্থী প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো শুরুতে এ আন্দোলনের পুরোভাগে থাকলেও শেষ পর্যন্ত এর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি, বরং নেতৃত্বের ব্যর্থতা বা হঠকারিতা শিক্ষকসহ সমাজের সচেতন অংশের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে।
‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’—এ নিয়মে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ। মাত্র এক দিন আগে ঢাকায় মতিউর রহমান নিজামীসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার গ্রেপ্তারের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে এ রকম একটি সুযোগকে কাজে লাগাবে শিবির—এটাই ছিল স্বাভাবিক। কাপড়ে মুখ ঢাকা যেসব শিক্ষার্থী ভাঙচুরে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই শিবিরের কর্মী এবং তাঁদের সমর্থক বহিরাগতরাও যে ধ্বংসলীলায় যোগ দিয়েছিলেন—এমন তথ্যও পরদিন প্রকাশিত হয়েছে পত্রপত্রিকায়।
এ সুযোগে সোহরাওয়ার্দী হল থেকে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস-রেলস্টেশনে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য যারা ভাঙতে গিয়েছিল, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে তো সংশয় থাকার কথা নয়। অন্যদিকে ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে আন্দোলনে ছিল না, কিন্তু উপাচার্যের ওপর ক্ষুব্ধ দলের একাংশ পুরো ঘটনায় নানাভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে—এমন ধারণাও অমূলক নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা ও হল ত্যাগের নির্দেশের ফলে পরিস্থিতির ওপর কর্তৃপক্ষের আপাত-নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেছে, কিন্তু জটিলতা নিরসন হয়েছে বলে মনে হয় না। ঘটনার তদন্ত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা নিয়মানুযায়ী চলতে থাকুক, কিন্তু পাশাপাশি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাবিটি সহূদয় বিবেচনা করাও দরকার বলে মনে করি আমরা। এর জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন প্রবীণ শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে, তাঁদের আলোচনার টেবিলে এনে একটি সমাধানের সূত্র বের করা জরুরি। সর্বোপরি ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া দরকার। কেননা, নিষেধাজ্ঞার পদ্ধতি কতটা অকার্যকর, তার প্রমাণ তো আমরা পেয়েছি সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি মৃত্যুর ঘটনা ও ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময়। পাশাপাশি চাকসু নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণের বিষয়টিও ভাবতে পারে কর্তৃপক্ষ।
২.
এদিকে, অগ্নিগর্ভ হয়ে আছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিও। যত দূর আমরা জানি, মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্রের ক্ষোভ-বিক্ষোভের শিকার হয়ে বিপন্ন হতে চলেছে এ বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবন। উল্লেখ করা দরকার, চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও গণমাধ্যমগুলোর সমর্থন ও জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে এটি কলেজ থেকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ পেয়েছিল। ভেটেরিনারি কলেজকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা যেতে পারে, এ একাডেমিক রূপকল্পটি তৈরি হয়েছিল বর্তমান উপাচার্যের হাতেই।
আমরা নানা কারণে আশাবাদী ছিলাম এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নিয়ে। এযাবৎ এর মান এবং স্নাতকের ছাত্রদের কর্মসংস্থানের সাফল্য খুবই আশাব্যঞ্জক। এখানকার ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণের পর ভারতের চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুর দীর্ঘসময় ইন্টার্ন করার বিরল সুযোগ লাভ করে আসছে। পশুসম্পদ রক্ষা ও এর সম্ভাবনার ক্ষেত্র বিস্তৃত করার জন্য এখানকার ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হলে দেশ যে নানাভাবে উপকৃত হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ ক্যাম্পাসে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিয়মিত উপস্থিতি, বার্ষিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় উচ্চতর গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির আয়োজন সত্যিকারের একটি আলোর ইশারা দিয়েছিল আমাদের। এ পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি শিক্ষক উন্নত পশ্চিমা বিশ্বের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন বা অর্জনের শেষ পর্যায়ে আছেন। কিন্তু কিছু ছাত্রের একগুঁয়েমি ও উচ্ছৃঙ্খলতায় এ রকম সম্ভাবনাময় অগ্রগতি বিঘ্নিত হলে তা হবে দুঃখজনক।
ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর আচরণ ক্ষুদ্র উপদলীয় রাজনৈতিক মহল ছাড়া অন্যদের তেমন সমর্থন পেয়েছে বলে জানা নেই। সংশ্লিষ্ট একাধিক মন্ত্রী, সরকারদলীয় স্থানীয় সাংসদ ও সরকারের আমলারাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন নানান সময়। এমনকি এই ছাত্রদের দাবির মুখে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও, তাঁরা উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মতো কোনো অভিযোগ পাননি।
এত কিছুর পরও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে আরও।
আমাদের দুর্ভাগ্য, যেখানেই সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়, সেখানেই সেই বিকাশকে রুদ্ধ করার জন্য ভেতর থেকেই শুরু হয় নানান অপতৎপরতা। বর্তমান উপাচার্যের পদত্যাগ বিক্ষোভরত ছাত্রদের অন্যতম দাবি। উপাচার্য কে থাকবেন বা কে হবেন—সেটি আমাদের বিচার্য বিষয় নয়। আমাদের ভাবনার বিষয় হচ্ছে, এ সম্ভাবনাময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ও সাধারণ ছাত্রদের ভবিষ্যৎ। সে দিক থেকে বলব, যেকোনো বড় প্রতিষ্ঠানের রূপকল্প তৈরি ও গঠনপর্বের নেতৃত্ব বদলের ফলে ইতিপূর্বে অনেক প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নেতৃত্বের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখতে বলি।
আমরা মনে করি, সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। যেসব ছাত্রকে নানা মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রতি সদয় হতে পারে কি না, সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ বের করা যায় কি না—সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান। এখানকার ছাত্ররাও দেশের শিক্ষিত সমাজের উজ্জ্বল অংশ। ফলে এখানে উদ্ভূত যেকোনো সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত আলাপ-আলোচনার টেবিলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত করা, ভাঙচুর ও হানাহানির পথ ধরা কোনোভাবেই কাম্য নয়, সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা ছাত্রদের সহিষ্ণুতা ও কর্তৃপক্ষের ঔদার্য এবং উভয় পক্ষের সুবিবেচনা প্রত্যাশা করি।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments