ব্যতিক্রমী একজন by শাহানা মজুমদার
কাজী আবেদ হোসেন ২০০৮ সালে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলায় ২৪৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ১৬৬টি গ্রামের ৫০ হাজার জেলেসহ তিন লাখ মানুষকে নিয়ে বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্লাবনভূমির ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা মাছ রক্ষার্থে কোনো রকম মাছ না ধরে এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। গ্রামের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। গ্রামের এই হতদরিদ্র সাধারণ মানুষই আমাদের মতো শহরের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গ্রামের ৯৫ ভাগ কৃষিজীবীর মধ্যে একটি শ্রেণী শুধু মাছ ধরেই জীবন চালায়। তারা হলো প্রান্তিক বা প্রজন্মগতভাবে জেলে। মূলত এই শ্রেণীই আমরা যে মাছে-ভাতে বাঙালি, এ বাক্যটিকে জীবিত রেখেছে।
কাজী আবেদ হোসেন ২০০৮ সালে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলায় ২৪৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ১৬৬টি গ্রামের ৫০ হাজার জেলেসহ তিন লাখ মানুষকে নিয়ে বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্লাবনভূমির ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা মাছ রক্ষার্থে কোনো রকম মাছ না ধরে এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন এটিএন বাংলার বর্ষসেরা মানবের পুরস্কার, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সনদ ও স্বর্ণপদক। বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বব্যাংক এবং ১১টি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা প্রকাশ করেছে প্রতিবেদন। বিশ্বব্যাংকের ঐড়ৎরুড়হঃধষ ষবধৎহরহম ঢ়ৎড়মৎধস বিষয়টি নান্দনিক শিখন হিসেবে দেশে শীর্ষস্থানে রয়েছে এবং সরকার সব জেলায় এই পদক্ষেপটি গ্রহণ করার জন্য একটি প্রকল্পও গ্রহণ করেছে।
কাজী আবেদ নেত্রকোনা থেকে বদলি হয়ে ২০১১ সালে কুড়িগ্রামে এসে ব্রহ্মপুত্র নদ, ধরলা, দুধকুমার, ফুলকুমার নদী এবং ৫টি ছড়াসহ ২৭৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা এবং ২৬৫টি গ্রামের পাঁচ লাখ মানুষকে বললেন_ বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাছেরা ডিম ছাড়ে। সেই সময় যদি জেলেরা মা মাছগুলো ধরে তবে অসংখ্য মাছের জন্মানোর সম্ভাবনা এবং সরকারের কোষাগারে মৎস্য সম্পদ থেকে আসা বিপুল পরিমাণ অর্থের সম্ভাবনার মৃত্যু হয়। কারণ একটা মাছের ভেতরে থাকে লাখ লাখ ডিম। সেই ডিম যদি মা মাছ ছাড়ার সুযোগ পায় তবে একটা মাছের জায়গায় আমরা পাব লাখ লাখ মাছ।
জেলেপাড়ায় গিয়ে দেখলাম, অসংখ্য রূপালি মাছ ছুটে বেড়াচ্ছে নদীতে। মধ্য দুপুরের সূর্যের আলো যখন রূপালি মাছগুলোর ওপর পড়ে চকচক করে উঠছিল, নদীটাকে মনে হচ্ছিল রূপার নদী। জেলেশিশুরা ছুটছিল মাছদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। বউয়েরা আঁচল মুখে লাজুক হেসে দেখছিল তার বীর বরকে। মাছ না মারলে যাদের একবেলা খাবার জোটে না, তারা প্রায় ৪ মাস মাছ ধরছে না। অন্য কাজও তারা জানে না যে, সেই সময়টায় কিছু করে খাবে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই হতদরিদ্র জেলেপাড়ার মানুষরা স্বপ্ন দেখছে, একটা থেকে অনেক_ লাখ মাছ হবে। এ রকম শূন্য পেট নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখতে পারে, তারাই তো বীর। এক জেলে কাজী আবেদকে উদ্দেশ করে বললেন_ স্যার, হামাগের মাছ! আহা! সেকি আনন্দ সবার চোখে মুখে! সুখ_ এ ছাড়া আর কী?
জেলেদের স্বাবলম্বী করার জন্য পুরো উপজেলায় 'উজ্জ্বল কুড়িগ্রাম' নামে প্রায় ১৩৫টি সমিতি করেছেন তিনি; যার বর্তমান স্থিতি ৮০ লাখ টাকা। এর অর্থ উৎপাদনশীল ও আয়বর্ধক খাতে কাজে লাগিয়ে জেলেদের আত্মনির্ভরশীল করা হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা করতে যে দৈববাণীটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন তা হলো_ জেলেরা যেন প্রতিদিন এক কাপ চা আর মা-বোনেরা যেন একটা পান কম খেয়ে তার পয়সা জমা করেন সমিতিতে।
পাঁচ বছর ধরে এই পদক্ষেপটি তিনি বাস্তবায়ন করে আসছেন। ফলে অবাধ বিচরণভূমির মা মাছ ডিম ছাড়া এবং পোনা মাছ নিশ্চিতভাবে বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে মাছের কয়েকগুণ উৎপাদনও বেড়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক শাইখ সিরাজের প্রতিবেদন মতে, প্রায় ২০ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছও ফিরে এসেছে। নিশ্চিত হয়েছে জলজ অন্য প্রাণীদের বংশবিস্তার এবং ধয়ঁধঃরপ বপড়ংুংঃবস। জেলেদের মাথাপিছু দৈনিক আয় যেখানে ছিল ১৫০-২০০ টাকা তা এখন হয়েছে ৫০০ টাকা, আবার কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি। পাঁচ লাখ মানুষ হয়েছে স্বশিক্ষিত, দেশপ্রেমিক আর সমবায়ের মনোভাবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
চার মাস জেলেদের খাবারের প্রসঙ্গ আসতেই বললেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি সরকারকে অনুরোধ করেছেন জেলেপাড়ার হতদরিদ্র এসব মানুষকে এই চার মাস যেন সাহায্য করা হয়। প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল প্রতিটি পরিবারকে দেওয়ার জন্য এৎধঃরঃরড়ঁং ৎবষরবভ (এজ) পদ্ধতি গ্রহণ করার অনুরোধ করেছেন তিনি। জেলেপাড়ায় পরিবার রয়েছে ২৫ হাজার ৭৫টি। জনসংখ্যা প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার। প্রান্তিক জেলে ছাড়া অন্য জেলেদেরও এর আওতায় আনা হলে এই সংখ্যা হবে সাড়ে তিন লাখ। জেলেরা বলল, চার মাসের মধ্যে দেড় মাস চলে গেলেও এখনও কোনো সাহায্য তারা পায়নি।
কাজী আবেদ একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পাঠককে পরিচয়টা পরে দিলাম, কারণ আমরা মনে করি সরকারি অফিসার মানেই গমচোর। এই ভ্রান্ত ধারণাই হয়তো পাঠককে লেখাটা পড়তে অনাগ্রহী করে তুলত। বাছবিচার করাটাকে অনেক সময়ই আমরা সময় নষ্ট বলে মনে করি। ড্রইং রুমে বসে খবরের কাগজ হাতে আর কফির পেয়ালা ঠোঁটে নিয়ে বলি, না! দেশটার কিছু হলো না! চোর-বাটপাড়ে ভরা দেশটা। তাদের জন্য বলছি_ একবার ঘুরে আসুন সেসব জায়গায়, যারা নিজের শরীরে আগুন দিয়ে অন্ধ গলিতে আলো দিয়ে যাচ্ছে। কোথাও না কোথাও যুদ্ধ চলছে। আর সরকারকে বলছি_ মঙ্গলের জন্য এই যে যুদ্ধ চলছে, তাতে সাহায্য পাওয়া হতদরিদ্র এসব মানুষের অধিকার। দ্রুত এর একটা বিহিত করতে হবে।
কাজী আবেদ হোসেন ২০০৮ সালে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলায় ২৪৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ১৬৬টি গ্রামের ৫০ হাজার জেলেসহ তিন লাখ মানুষকে নিয়ে বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্লাবনভূমির ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা মাছ রক্ষার্থে কোনো রকম মাছ না ধরে এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন এটিএন বাংলার বর্ষসেরা মানবের পুরস্কার, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সনদ ও স্বর্ণপদক। বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বব্যাংক এবং ১১টি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা প্রকাশ করেছে প্রতিবেদন। বিশ্বব্যাংকের ঐড়ৎরুড়হঃধষ ষবধৎহরহম ঢ়ৎড়মৎধস বিষয়টি নান্দনিক শিখন হিসেবে দেশে শীর্ষস্থানে রয়েছে এবং সরকার সব জেলায় এই পদক্ষেপটি গ্রহণ করার জন্য একটি প্রকল্পও গ্রহণ করেছে।
কাজী আবেদ নেত্রকোনা থেকে বদলি হয়ে ২০১১ সালে কুড়িগ্রামে এসে ব্রহ্মপুত্র নদ, ধরলা, দুধকুমার, ফুলকুমার নদী এবং ৫টি ছড়াসহ ২৭৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা এবং ২৬৫টি গ্রামের পাঁচ লাখ মানুষকে বললেন_ বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাছেরা ডিম ছাড়ে। সেই সময় যদি জেলেরা মা মাছগুলো ধরে তবে অসংখ্য মাছের জন্মানোর সম্ভাবনা এবং সরকারের কোষাগারে মৎস্য সম্পদ থেকে আসা বিপুল পরিমাণ অর্থের সম্ভাবনার মৃত্যু হয়। কারণ একটা মাছের ভেতরে থাকে লাখ লাখ ডিম। সেই ডিম যদি মা মাছ ছাড়ার সুযোগ পায় তবে একটা মাছের জায়গায় আমরা পাব লাখ লাখ মাছ।
জেলেপাড়ায় গিয়ে দেখলাম, অসংখ্য রূপালি মাছ ছুটে বেড়াচ্ছে নদীতে। মধ্য দুপুরের সূর্যের আলো যখন রূপালি মাছগুলোর ওপর পড়ে চকচক করে উঠছিল, নদীটাকে মনে হচ্ছিল রূপার নদী। জেলেশিশুরা ছুটছিল মাছদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। বউয়েরা আঁচল মুখে লাজুক হেসে দেখছিল তার বীর বরকে। মাছ না মারলে যাদের একবেলা খাবার জোটে না, তারা প্রায় ৪ মাস মাছ ধরছে না। অন্য কাজও তারা জানে না যে, সেই সময়টায় কিছু করে খাবে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই হতদরিদ্র জেলেপাড়ার মানুষরা স্বপ্ন দেখছে, একটা থেকে অনেক_ লাখ মাছ হবে। এ রকম শূন্য পেট নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখতে পারে, তারাই তো বীর। এক জেলে কাজী আবেদকে উদ্দেশ করে বললেন_ স্যার, হামাগের মাছ! আহা! সেকি আনন্দ সবার চোখে মুখে! সুখ_ এ ছাড়া আর কী?
জেলেদের স্বাবলম্বী করার জন্য পুরো উপজেলায় 'উজ্জ্বল কুড়িগ্রাম' নামে প্রায় ১৩৫টি সমিতি করেছেন তিনি; যার বর্তমান স্থিতি ৮০ লাখ টাকা। এর অর্থ উৎপাদনশীল ও আয়বর্ধক খাতে কাজে লাগিয়ে জেলেদের আত্মনির্ভরশীল করা হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা করতে যে দৈববাণীটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন তা হলো_ জেলেরা যেন প্রতিদিন এক কাপ চা আর মা-বোনেরা যেন একটা পান কম খেয়ে তার পয়সা জমা করেন সমিতিতে।
পাঁচ বছর ধরে এই পদক্ষেপটি তিনি বাস্তবায়ন করে আসছেন। ফলে অবাধ বিচরণভূমির মা মাছ ডিম ছাড়া এবং পোনা মাছ নিশ্চিতভাবে বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে মাছের কয়েকগুণ উৎপাদনও বেড়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক শাইখ সিরাজের প্রতিবেদন মতে, প্রায় ২০ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছও ফিরে এসেছে। নিশ্চিত হয়েছে জলজ অন্য প্রাণীদের বংশবিস্তার এবং ধয়ঁধঃরপ বপড়ংুংঃবস। জেলেদের মাথাপিছু দৈনিক আয় যেখানে ছিল ১৫০-২০০ টাকা তা এখন হয়েছে ৫০০ টাকা, আবার কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি। পাঁচ লাখ মানুষ হয়েছে স্বশিক্ষিত, দেশপ্রেমিক আর সমবায়ের মনোভাবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
চার মাস জেলেদের খাবারের প্রসঙ্গ আসতেই বললেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি সরকারকে অনুরোধ করেছেন জেলেপাড়ার হতদরিদ্র এসব মানুষকে এই চার মাস যেন সাহায্য করা হয়। প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল প্রতিটি পরিবারকে দেওয়ার জন্য এৎধঃরঃরড়ঁং ৎবষরবভ (এজ) পদ্ধতি গ্রহণ করার অনুরোধ করেছেন তিনি। জেলেপাড়ায় পরিবার রয়েছে ২৫ হাজার ৭৫টি। জনসংখ্যা প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার। প্রান্তিক জেলে ছাড়া অন্য জেলেদেরও এর আওতায় আনা হলে এই সংখ্যা হবে সাড়ে তিন লাখ। জেলেরা বলল, চার মাসের মধ্যে দেড় মাস চলে গেলেও এখনও কোনো সাহায্য তারা পায়নি।
কাজী আবেদ একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পাঠককে পরিচয়টা পরে দিলাম, কারণ আমরা মনে করি সরকারি অফিসার মানেই গমচোর। এই ভ্রান্ত ধারণাই হয়তো পাঠককে লেখাটা পড়তে অনাগ্রহী করে তুলত। বাছবিচার করাটাকে অনেক সময়ই আমরা সময় নষ্ট বলে মনে করি। ড্রইং রুমে বসে খবরের কাগজ হাতে আর কফির পেয়ালা ঠোঁটে নিয়ে বলি, না! দেশটার কিছু হলো না! চোর-বাটপাড়ে ভরা দেশটা। তাদের জন্য বলছি_ একবার ঘুরে আসুন সেসব জায়গায়, যারা নিজের শরীরে আগুন দিয়ে অন্ধ গলিতে আলো দিয়ে যাচ্ছে। কোথাও না কোথাও যুদ্ধ চলছে। আর সরকারকে বলছি_ মঙ্গলের জন্য এই যে যুদ্ধ চলছে, তাতে সাহায্য পাওয়া হতদরিদ্র এসব মানুষের অধিকার। দ্রুত এর একটা বিহিত করতে হবে।
No comments