মত ও মন্তব্য-কিছু প্রশ্ন রেখে গেছেন ওসামা বিন লাদেন by হারুন হাবীব

বিশেষ মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত হলেন এ কালের সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত বিশ্ব কাঁপানো আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন। বিন লাদেন নিহত হওয়ার খবরে স্বাভাবিক কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোতে ব্যাপক আনন্দ-উৎসব চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আনন্দের সমুদ্রে ভাসছে। যে বিন লাদেন বিশ্বের প্রবল প্রতাবশালী


আমেরিকার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামার সাহস দেখিয়েছে, যে ব্যক্তি আমেরিকার বুকে পর্যন্ত আঘাত হেনেছে, যে বিন লাদেনকে ধরতে এক দশক ধরে আমেরিকা ও তার মিত্ররা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, যার জন্য কয়েক হাজার আমেরিকান সৈন্যের জীবন গেছে, সেই বিন লাদেনকে মার্কিন বিশেষ বাহিনী হত্যা করেছে। এটি কম কৃতিত্বের বিষয় নয়।
১ মে ২০১১। মধ্যরাতের পর আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটি থেকে চারটি হেলিকপ্টারে চেপে পাকিস্তানের উদ্দেশে উড়াল দেয় মার্কিন নেভিসিলের ২৫ থেকে ৩০ জন চৌকস সদস্য। অ্যাবোটাবাদের মিলিটারি শহরের সুরক্ষিত তিনতলা নির্ধারিত বাড়ির কাছে পেঁৗছেই হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসে মার্কিন কমান্ডো দল। প্রায় ১৮ ফুট উঁচু দেয়াল ঘেরা বাড়িটিতে ঢোকার দুটিই মাত্র পথ। বিস্ফোরক দিয়ে লোহার দরজা উড়িয়ে দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে কমান্ডোরা। এরপর শুরু হয় গোলাগুলি। নিজের ছেলে, এক ভাই এবং দুই দেহরক্ষীর সঙ্গে কমান্ডোদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেন বিশ্বের 'এক নম্বর সন্ত্রাসী' হিসেবে খ্যাত বা কুখ্যাত ওসামা বিন লাদেন।
কিন্তু শেষরক্ষা হয় না পলাতক বিশ্ব জিহাদি নেতা বিন লাদেনের। কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই মার্কিন কমান্ডোদের গুলিতে নিহত হন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মাটিতে গত ১০ বছরে মার্কিন বাহিনীর এ কালের সবচেয়ে সফল অভিযান এটি। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেমন তার সামরিক কৌশল ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। সেই সঙ্গে প্রমাণ করেছে_যে বিন লাদেন আমেরিকার মাটিতে তিন হাজার নিরপরাধ মানুষের জীবন নিয়েছে বলে তারা মনে করে, যে বিন লাদেন সারা বিশ্বে মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যে বিন লাদেনের জিহাদের ডাক মুসলমানদের একটি অংশকে প্রলুব্ধ করেছে, তাঁকে হত্যা করার গৌরব তারা অর্জন করেছে।
ওসামা বিন লাদেন_জিহাদের যে পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন সে পথ বিশ্বের কিছুসংখ্যক মুসলমান গ্রহণ করলেও বিপুলসংখ্যক মুসলমান তা গ্রহণ করেনি। অদূর ভবিষ্যতে করবে_তা মনে করারও কোনো কারণ নেই। কারণ সহিংসতা কখনোই শান্তি ও সফলতা বয়ে আনে না। কিন্তু লাদেনের মৃত্যু একটি বড় প্রশ্ন রেখে গেছে বিশ্ববাসীর সামনে। প্রশ্নটি হচ্ছে : ৯/১১-এর পর গোটা পৃথিবীতে যখন বিন লাদেনকে ধরার বা হত্যা করার সর্বাত্মক যুদ্ধ, এমনকি পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যখন বিন লাদেন ও তালেবানবিরোধী সর্বাত্মক সন্ত্রাসবিরোধী সংগ্রামে লিপ্ত, তখনই বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়া গেল অ্যাবোটাবাদের মিলিটারি একাডেমী থেকে মাত্র ৭০০ মিটার দূরে সুরক্ষিত সুরম্য একটি বাড়িতে? শুধু নাটকীয় বললেও কম বলা হবে। পাকিস্তানের সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে রীতিমতো অন্ধকারে রেখে আফগানিস্তান থেকে হেলিকপ্টারে এসে শ্বাসরুদ্ধকর ৪০ মিনিটের এক অভিযানে মার্কিন বাহিনীর একটি দল কৃতিত্বপূর্ণ অভিযানটি পরিচালনা করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, সন্দেহ নেই। এর পরও বলতে হবে, বিন লাদেনকে তারা জীবিত ধরতে পারেনি। পারলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। উত্তর পাওয়া যেত কে বা কারা তাঁকে অতি সুরক্ষিত একটি বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল এবং কে বা কারা এত দিন ধরে তাঁর নিরাপত্তা বিধান করেছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ঘটনা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানের অবস্থান নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। ক্যান্টনমেন্ট শহর অ্যাবোটাবাদের এ বাড়িটি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে। এত গুরুত্বপূর্ণ ও নিরাপদ একটি সরকারি স্থাপনার পাশে বিন লাদেনের মতো জঙ্গি নেতার আশ্রয় পাকিস্তানের সঙ্গে জঙ্গিদের দহরম-মহরমকে নতুন করে বিশ্বের সামনে নিয়ে এসেছে। কাজেই, শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সারা বিশ্বেই নতুন করে সন্দেহ-অবিশ্বাস শুরু হবে পাকিস্তানকে ঘিরে_এটা অবধারিত। বিন লাদেনকে কে রক্ষা করেছিল? পাকিস্তানের সরকার, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই নাকি অন্য কেউ? কে সমর্থক তালেবানদের? সঙ্গত এ প্রশ্নগুলোর জবাব আমেরিকা যেমন খুঁজবে, তেমনি খুঁজবে বিশ্ববাসী। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে ব্যর্থ হলে 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' কোনো দিন সফল হবে না। হওয়ার সুযোগ নেই।
বিন লাদেনের মরদেহ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মার্কিন সূত্রগুলো দাবি করেছে। তারা বলেছে, লাদেনের মরদেহ নিয়ে ঝামেলায় পড়েছিল তারা। নিন্দিত এ জঙ্গি নেতার মরদেহ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল বহু রাষ্ট্র। জন্মসূত্রে লাদেন সৌদি আরবের নাগরিক হলেও ১৯৯১ সালে সন্ত্রাসের দায়ে তাঁর নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নেয় তাঁর দেশ। তবে মৃত্যুর মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেন তড়িঘড়ি করে বিন লাদেনকে সাগরে সমাহিত করা হলো_এ ব্যাপারে সন্দেহ সহজে যাবে মনে করার কারণ নেই। বিন লাদেনের কবর একসময় জঙ্গি বা জিহাদিদের তীর্থস্থান হতে পারে_এমন আশঙ্কা থেকেই কি? এ প্রশ্নও আছে। সে যা-ই হোক, ব্যক্তি বিন লাদেন আজ অতীত। সেই সঙ্গে প্রশ্ন থেকে যাবে_বিন লাদেনের মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান আল-কায়েদাও কি অতীত? নাকি তা চিন্তা করা বাস্তবসম্মত? যে কারণেই হোক, এশিয়া-আফ্রিকার বহু দেশের বহু ইসলাম ধর্মাবলম্বী লাদেনের আল-কায়েদাকে মুসলিম স্বার্থে একটি বৈধ সংগঠন মনে করে। তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র মুসলমানদের ধ্বংস করতে চায়। এ শ্রেণীটির কাছে বিন লাদেন কি অতীত হবে?
ওসামা বিন লাদেনের জন্ম ধনাঢ্য এক সৌদি পরিবারে। যে দেশটির সঙ্গে আমেরিকার বন্ধুত্ব বহু আগে থেকে। অথচ সে আমেরিকারই প্রধান শত্রু হয়ে ওঠেন বিন লাদেন। অনেকে এও অভিযোগ করেন যে মার্কিন স্বার্থেই বিন লাদেনের উত্থান এবং পতন। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তান দখল করে, তখন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সরাসরি মদদ জোগায় বিন লাদেন ও তাঁর আল-কায়েদাকে। প্রথমদিকে বিন লাদেন ছিলেন সৌদি রাজপরিবারবিরোধী। তাঁর মতে, সৌদি রাজপরিবারের যতটা ওহাবি হওয়ার কথা ততটা ওহাবি তারা নয়। তারা দুর্নীতিপরায়ণ। এরপর 'টুইন টাওয়ারে' ভয়াবহ হামলা ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অভিযান চালায় আফগানিস্তানে। বিন লাদেনের বন্ধু কাবুলের তালেবান শাসকদের পতন ঘটে। কিন্তু সে যুদ্ধ আজও শেষ হয়নি, বরং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটবে, তা আমি মনে করি না। তবে এটা হয়তো ঠিক, বিন লাদেনের মৃত্যুর পর প্রথমদিকে এ সন্ত্রাসবাদের কর্মকাণ্ড কিছুটা স্তিমিত হবে, কিন্তু সংকট দূর হবে না। সন্ত্রাসবাদ কোনো ধর্ম সমর্থন করে না। ইসলামও নয়। পাকিস্তানের সাহসী সাংবাদিক হামিদ মির বিন লাদেনের তিনবার সাক্ষাৎকার নিয়ে বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। লাদেনের মৃত্যুর পরদিন তিনি লিখেছেন_বিন লাদেন সব সময়ই মার্কিন নীতির ভুল-ত্রুটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মার্কিনবিদ্বেষ ছিল তাঁর মূল শক্তি, কখনোই ইসলাম নয়। ওসামা বিন লাদেন এখন মৃত; কিন্তু মনে রাখা উচিত, আল-কায়েদা ও তার মিত্ররা আজও আছে। পৃথিবীকে নিরাপদ করতে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ দমন করতে হবে সন্দেহ নেই; কিন্তু নানা ক্ষেত্রে দ্বিমুখী নীতি প্রয়োগের অভিযোগ থেকে আমেরিকাকে বেরিয়ে আসতে হবে একই সঙ্গে। অন্যথায় জিহাদি তৎপরতা যেমন শেষ হবে না, আল-কায়েদা বা তালেবানও সমর্থন লাভে ব্যর্থ হবে না। স্লোগানসর্বস্ব নয়, আমরা সত্যিকার অর্থেই একটি নিরাপদ বিশ্ব চাই_যে বিশ্বে ধর্ম নিয়ে, শক্তির দম্ভ নিয়ে প্রতিযোগিতা হবে না।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক
hh1971@gmail. Com

No comments

Powered by Blogger.