বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩২৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল জব্বার পাটোয়ারী, বীর বিক্রম কৌশলী এক প্রতিরোধযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ চালালেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে। একটি দলের নেতৃত্বে আবদুল জব্বার পাটোয়ারী।
সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকলেন। তাঁদের নিখুঁত গোলাবর্ষণে পাকিস্তানি সেনারা দিশাহারা হয়ে অবস্থান ছেড়ে সরে যেতে বাধ্য হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এল বিরাট এক এলাকা। এ ঘটনা সালদা নদী রেলস্টেশনে। ১৯৭১ সলের ৯ অক্টোবর।
মুক্তিযুদ্ধকালে সালদা নদী এলাকায় কয়েক দিন পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হতো। সেপ্টেম্বর মাসে সেখানে অনেকবার যুদ্ধ হয়। সালদা নদী রেলস্টেশন নানা কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ স্টেশনের ওপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেটের রেল যোগাযোগ। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে এই স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে।
সালদা নদী ছিল মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা। সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে সালদা নদী রেলস্টেশন দখলের পরিকল্পনা করেন। তাঁর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল সেখানে আক্রমণ করে।
পরিকল্পনা অনুসারে মেজর আবদুল সালেক চৌধুরী (বীর উত্তম) তাঁর দল নিয়ে রেলস্টেশনের পশ্চিমে গোডাউন এলাকায় অবস্থান নেন। মুজিব ব্যাটারি কামান নিয়ে অবস্থান নেয় মন্দভাগে। আবদুল জব্বার পাটোয়ারী মর্টার সেকশন নিয়ে অবস্থান নেন ব্যারাকের পেছনে। অপর একটি দল অবস্থান নেয় নয়নপুর সড়কের কাছে। এই যুদ্ধে সার্বিক নেতৃত্ব দেন খালেদ মোশাররফ নিজেই।
৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে ছয়টায় মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ শুরু করেন। তাঁদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের নয়নপুরে অবস্থানরত দল পিছু হটে সালদা রেলস্টেশনে আশ্রয় নেয়। এমন সময় মুক্তিবাহিনীর মেজর সালেকের দলের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। সেদিন আবদুল জব্বার পাটোয়ারী তাঁর দল নিয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেন। কিন্তু তাঁরা সালদা রেলস্টেশন দখল করতে ব্যর্থ হন।
পরদিন ৯ অক্টোবর আবার সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। এই যুদ্ধে আবদুল জব্বার পাটোয়ারী অসাধারণ বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শন করেন। তাঁদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতি শিকার করে সালদা রেলস্টেশন ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। রেলস্টেশন মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেন। পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রেলস্টেশন পুনর্দখলের জন্য আক্রমণ চালিয়েও তা আর দখল করতে পারেনি।
আবদুল জব্বার পাটোয়ারী চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ কর্মরত ছিলেন ২৭ বালুচ রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। মার্চ মাসে তিনি ছুটিতে বাড়ি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। পরে তাঁকে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে যুদ্ধ করেন ফেনী, নাজিরহাট ও হাটহাজারী এলাকায়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল জব্বার পাটোয়ারীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৫।
আবদুল জব্বার পাটোয়ারী ২০০০ সালে মারা গেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার (ডাক কড়িতলী) চৌমুখা গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা ১৩৫৭/৬ নবারুন কেজি স্কুল সড়ক, পূর্ব জুরাইন, শ্যামপুর, ঢাকা। তাঁর বাবার নাম আবদুর রহমান পাটোয়ারী। স্ত্রী আফিয়া খাতুন। তাঁর দুই ছেলে, তিনি মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং আবদুল রাজ্জাক পাটোয়ারী (ছেলে)।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মুক্তিযুদ্ধকালে সালদা নদী এলাকায় কয়েক দিন পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হতো। সেপ্টেম্বর মাসে সেখানে অনেকবার যুদ্ধ হয়। সালদা নদী রেলস্টেশন নানা কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ স্টেশনের ওপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেটের রেল যোগাযোগ। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে এই স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে।
সালদা নদী ছিল মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা। সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে সালদা নদী রেলস্টেশন দখলের পরিকল্পনা করেন। তাঁর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল সেখানে আক্রমণ করে।
পরিকল্পনা অনুসারে মেজর আবদুল সালেক চৌধুরী (বীর উত্তম) তাঁর দল নিয়ে রেলস্টেশনের পশ্চিমে গোডাউন এলাকায় অবস্থান নেন। মুজিব ব্যাটারি কামান নিয়ে অবস্থান নেয় মন্দভাগে। আবদুল জব্বার পাটোয়ারী মর্টার সেকশন নিয়ে অবস্থান নেন ব্যারাকের পেছনে। অপর একটি দল অবস্থান নেয় নয়নপুর সড়কের কাছে। এই যুদ্ধে সার্বিক নেতৃত্ব দেন খালেদ মোশাররফ নিজেই।
৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে ছয়টায় মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ শুরু করেন। তাঁদের প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের নয়নপুরে অবস্থানরত দল পিছু হটে সালদা রেলস্টেশনে আশ্রয় নেয়। এমন সময় মুক্তিবাহিনীর মেজর সালেকের দলের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। সেদিন আবদুল জব্বার পাটোয়ারী তাঁর দল নিয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেন। কিন্তু তাঁরা সালদা রেলস্টেশন দখল করতে ব্যর্থ হন।
পরদিন ৯ অক্টোবর আবার সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। এই যুদ্ধে আবদুল জব্বার পাটোয়ারী অসাধারণ বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শন করেন। তাঁদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতি শিকার করে সালদা রেলস্টেশন ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। রেলস্টেশন মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেন। পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রেলস্টেশন পুনর্দখলের জন্য আক্রমণ চালিয়েও তা আর দখল করতে পারেনি।
আবদুল জব্বার পাটোয়ারী চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ কর্মরত ছিলেন ২৭ বালুচ রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। মার্চ মাসে তিনি ছুটিতে বাড়ি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। পরে তাঁকে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে যুদ্ধ করেন ফেনী, নাজিরহাট ও হাটহাজারী এলাকায়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল জব্বার পাটোয়ারীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৫।
আবদুল জব্বার পাটোয়ারী ২০০০ সালে মারা গেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার (ডাক কড়িতলী) চৌমুখা গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা ১৩৫৭/৬ নবারুন কেজি স্কুল সড়ক, পূর্ব জুরাইন, শ্যামপুর, ঢাকা। তাঁর বাবার নাম আবদুর রহমান পাটোয়ারী। স্ত্রী আফিয়া খাতুন। তাঁর দুই ছেলে, তিনি মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং আবদুল রাজ্জাক পাটোয়ারী (ছেলে)।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments