দাহকালের কথা-অটিজম by মাহমুদুজ্জামান বাবু
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে পান্থপথ ধরে সোনারগাঁও হোটেলের দিকে যেতে থাকলে হাতের বাঁয়ে পড়ে স্কয়ার হাসপাতাল, সেটা পেরোলে বউবাজার, এর পরই ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা খোলাবাজারে চাল বিক্রির দেড় টনি ট্রাক। এ পথে আমার নিত্য যাওয়া-আসা, তাই চোখে পড়েছে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন, যা রোজার আগে এত দীর্ঘ ছিল না।
দুই দিন আগে, বৃষ্টিধোয়া বুড়ো-সকালে আমি ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য সেই লাইনের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। শাসক দল আওয়ামী লীগ ও এর পক্ষাবলম্বনকারী অনেকের ভাষণ ও কথা (জনজীবনে কোনো দুর্ভোগ নেই) আমাকে সেই লাইনের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আমি আদতে ‘সত্য’ জানতে চেয়েছিলাম।
গৃহকর্মী পান্নার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার একটি গ্রামে। ঢাকায় থাকেন স্কয়ার হাসপাতালের পেছনে, বস্তির মতো একটা টিনশেড ঘরে। স্বামী অনিয়মিত রিকশাচালক। শরীর অনুমতি দেয় না, তাই বেশি সময় ধরে রিকশা চালানো যায় না। তার ওপর ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বড় রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে মহানগর প্রশাসন। বাধ্য হয়ে পান্না বাড়িয়েছেন তাঁর কাজের মাত্রা। আগে দুই বাসায় খাটতেন। এখন খাটেন চার বাসায়। সকাল সাড়ে ছয়টায় তাঁর কাজের শুরু, শেষ ১০টায়। দ্বিতীয় দফায় শুরু বিকেল তিনটায়, শেষ রাত আটটায়। দুই বছর বয়সী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ান পান্না। চার বাসা থেকে তাঁর আয় ছয় হাজার টাকা। ঘরভাড়া দিতে হয় সাড়ে তিন হাজার। বাকি থাকল কত? আড়াই হাজার টাকা। পান্নার রিকশাচালক স্বামীর আয় অনিয়মিত। সেটা কত? পান্না সেটা জানেন না। তাঁর ভাষায়, রিকশা চালানো অনেক পরিশ্রমের কাজ, সে জন্য খেতে হয় অনেক। তাঁর স্বামী তাই খুব বেশি টাকা ঘরে আনতে পারেন না। ওই টাকায় কচুঘেঁচুটা বাজার থেকে ঘরে আসে। গৃহকর্মী পান্না করেন তিন রকমের কাজ। ঘরদোর ধোয়ামোছা, কাপড় কাচা আর রান্না করা। ‘সব বাসায়ই এই কাজ। শরীরে কুলায়?’ এই প্রশ্ন শুনে পান্না ম্লান হাসেন এবং বলেন, ‘ড্যানা (হাতের বাহু) অবশ হইয়া যায়।’ পান্নার পেছনে দাঁড়ানো আমার সমবয়সী একজন আমাকে দেখছিলেন অনেকক্ষণ ধরে। পুরুষ। এবার আমি তাঁর দিকে এগোতেই তিনি নিজেই বলে উঠলেন, ‘আমি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করি। আপনাকে চিনি। আমার কাছে আর কিছু জানতে চাইবেন না।’ গৃহকর্মী পান্নাকে প্রশ্ন করার আগেই আমি ট্রাকের পাটাতনে ঢেলে রাখা চাল হাতে নিয়ে দেখেছি। কেজিপ্রতি ২৪ টাকা দরের এই রঙের ও গন্ধের চাল আমার মধ্যবিত্ত জিব সহজে নিতে চাইবে না। আমার কাণ্ডজ্ঞান সেই লাইনের কাছ থেকে ওই দিন আমাকে সরিয়ে এনেছিল।
কাকতালীয়ভাবে ওই দিন রাতেই বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য টেলিভিশন সংবাদে প্রচারিত হলো। কম খেতে বলাটা জনসাধারণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, সেটা না হয় অনুল্লেখ্য থাকুক; কিন্তু একই দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে দেশের দ্রব্যমূল্য এবং জনজীবনের চলমান দুর্ভোগ সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের শিশুতোষ উপলব্ধিটা স্পষ্ট হয়েছে। ওবায়দুল কাদের মনে করেন, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন অসহায় করে তুলছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ না করে যদি এখন নেতিবাচক বক্তব্য দেওয়া হয়, সেটা গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো হয়ে উঠবে। হায়! এই কাণ্ডজ্ঞান কি সরকারের আছে?
নেই। সাধারণ মানুষ ঘরে ও বাইরে কিংবা পাড়াপড়শিরা এ-বাড়ি ও-বাড়িতে অশালীন ও অরুচিকর কথা চালাচালি করলে সেটা অন্তত ঘরে ও পাড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু গণমাধ্যমে যাদের কথা প্রচারিত হয়, তাদের নিশ্চয়ই জনসাধারণের জন্য সহনীয় কথা ও সত্য ভাষণ দেওয়া দরকার। সরকারি দল ও বিরোধী দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরা যে ভাষায় প্রতিপক্ষের সমালোচনা করে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন, সাম্প্রতিক সময়ে সেসব কথায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বা উন্নত রুচির প্রতিফলন একটুও ঘটছে না। সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের দৈনন্দিন সংকট মোচনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দূরে থাক, আশু পরিকল্পনার দেখাও খুব শিগগির মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের আত্মপ্রসাদ ও নিন্দার কথা চালাচালি যখন শেষ হয়, তার পরদিনই একজন নিরপরাধ কাদের পুলিশের আক্রোশের শিকার হন, অথবা পুলিশের উসকানিতে গণপিটুনিতে মারা যায় কিশোর মিলন। অস্থির এই সময়, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন আর তখন রাজনীতির নামে এসব জনস্বার্থবিরোধী কাণ্ডজ্ঞানহীন কথা আমাদের ভবিষ্যতের দুর্দিন নিশ্চিত করে। আমরা শঙ্কিত হই।
একদিন একটা আলোচনা সভায় শুনেছিলাম, বক্তা উদাহরণ দিচ্ছিলেন, মাছের শরীরে প্রথম পচন ধরে এর মাথায়। তারপর শরীরের বাকি অংশে। রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও তেমনি। রাষ্ট্রের চূড়ায় যে বা যাঁরা থাকেন, তাঁদের পচন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ায়। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা ‘অটিজম’ নিয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার করলেন। নিজেদের অথর্ব ও ক্রিয়াহীন নুয়ে থাকা দেখে তাঁকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। পুরো দেশটা ‘অটিজম’-এ ভুগছে। হ্যাঁ, ভুগছে! কম্পিউটার, লক করুন!
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
গৃহকর্মী পান্নার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার একটি গ্রামে। ঢাকায় থাকেন স্কয়ার হাসপাতালের পেছনে, বস্তির মতো একটা টিনশেড ঘরে। স্বামী অনিয়মিত রিকশাচালক। শরীর অনুমতি দেয় না, তাই বেশি সময় ধরে রিকশা চালানো যায় না। তার ওপর ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বড় রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে মহানগর প্রশাসন। বাধ্য হয়ে পান্না বাড়িয়েছেন তাঁর কাজের মাত্রা। আগে দুই বাসায় খাটতেন। এখন খাটেন চার বাসায়। সকাল সাড়ে ছয়টায় তাঁর কাজের শুরু, শেষ ১০টায়। দ্বিতীয় দফায় শুরু বিকেল তিনটায়, শেষ রাত আটটায়। দুই বছর বয়সী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ান পান্না। চার বাসা থেকে তাঁর আয় ছয় হাজার টাকা। ঘরভাড়া দিতে হয় সাড়ে তিন হাজার। বাকি থাকল কত? আড়াই হাজার টাকা। পান্নার রিকশাচালক স্বামীর আয় অনিয়মিত। সেটা কত? পান্না সেটা জানেন না। তাঁর ভাষায়, রিকশা চালানো অনেক পরিশ্রমের কাজ, সে জন্য খেতে হয় অনেক। তাঁর স্বামী তাই খুব বেশি টাকা ঘরে আনতে পারেন না। ওই টাকায় কচুঘেঁচুটা বাজার থেকে ঘরে আসে। গৃহকর্মী পান্না করেন তিন রকমের কাজ। ঘরদোর ধোয়ামোছা, কাপড় কাচা আর রান্না করা। ‘সব বাসায়ই এই কাজ। শরীরে কুলায়?’ এই প্রশ্ন শুনে পান্না ম্লান হাসেন এবং বলেন, ‘ড্যানা (হাতের বাহু) অবশ হইয়া যায়।’ পান্নার পেছনে দাঁড়ানো আমার সমবয়সী একজন আমাকে দেখছিলেন অনেকক্ষণ ধরে। পুরুষ। এবার আমি তাঁর দিকে এগোতেই তিনি নিজেই বলে উঠলেন, ‘আমি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করি। আপনাকে চিনি। আমার কাছে আর কিছু জানতে চাইবেন না।’ গৃহকর্মী পান্নাকে প্রশ্ন করার আগেই আমি ট্রাকের পাটাতনে ঢেলে রাখা চাল হাতে নিয়ে দেখেছি। কেজিপ্রতি ২৪ টাকা দরের এই রঙের ও গন্ধের চাল আমার মধ্যবিত্ত জিব সহজে নিতে চাইবে না। আমার কাণ্ডজ্ঞান সেই লাইনের কাছ থেকে ওই দিন আমাকে সরিয়ে এনেছিল।
কাকতালীয়ভাবে ওই দিন রাতেই বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য টেলিভিশন সংবাদে প্রচারিত হলো। কম খেতে বলাটা জনসাধারণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, সেটা না হয় অনুল্লেখ্য থাকুক; কিন্তু একই দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে দেশের দ্রব্যমূল্য এবং জনজীবনের চলমান দুর্ভোগ সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের শিশুতোষ উপলব্ধিটা স্পষ্ট হয়েছে। ওবায়দুল কাদের মনে করেন, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন অসহায় করে তুলছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ না করে যদি এখন নেতিবাচক বক্তব্য দেওয়া হয়, সেটা গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো হয়ে উঠবে। হায়! এই কাণ্ডজ্ঞান কি সরকারের আছে?
নেই। সাধারণ মানুষ ঘরে ও বাইরে কিংবা পাড়াপড়শিরা এ-বাড়ি ও-বাড়িতে অশালীন ও অরুচিকর কথা চালাচালি করলে সেটা অন্তত ঘরে ও পাড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু গণমাধ্যমে যাদের কথা প্রচারিত হয়, তাদের নিশ্চয়ই জনসাধারণের জন্য সহনীয় কথা ও সত্য ভাষণ দেওয়া দরকার। সরকারি দল ও বিরোধী দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরা যে ভাষায় প্রতিপক্ষের সমালোচনা করে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন, সাম্প্রতিক সময়ে সেসব কথায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বা উন্নত রুচির প্রতিফলন একটুও ঘটছে না। সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের দৈনন্দিন সংকট মোচনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দূরে থাক, আশু পরিকল্পনার দেখাও খুব শিগগির মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের আত্মপ্রসাদ ও নিন্দার কথা চালাচালি যখন শেষ হয়, তার পরদিনই একজন নিরপরাধ কাদের পুলিশের আক্রোশের শিকার হন, অথবা পুলিশের উসকানিতে গণপিটুনিতে মারা যায় কিশোর মিলন। অস্থির এই সময়, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন আর তখন রাজনীতির নামে এসব জনস্বার্থবিরোধী কাণ্ডজ্ঞানহীন কথা আমাদের ভবিষ্যতের দুর্দিন নিশ্চিত করে। আমরা শঙ্কিত হই।
একদিন একটা আলোচনা সভায় শুনেছিলাম, বক্তা উদাহরণ দিচ্ছিলেন, মাছের শরীরে প্রথম পচন ধরে এর মাথায়। তারপর শরীরের বাকি অংশে। রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও তেমনি। রাষ্ট্রের চূড়ায় যে বা যাঁরা থাকেন, তাঁদের পচন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ায়। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা ‘অটিজম’ নিয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার করলেন। নিজেদের অথর্ব ও ক্রিয়াহীন নুয়ে থাকা দেখে তাঁকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। পুরো দেশটা ‘অটিজম’-এ ভুগছে। হ্যাঁ, ভুগছে! কম্পিউটার, লক করুন!
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
No comments