জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দোষ ১৫০০ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কী? by তুহিন ওয়াদুদ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি হওয়া ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষের ২২টি কলেজের মোট ১৫০০ শিক্ষার্থীর নিবন্ধন নম্বর পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নির্ধারিত শর্ত পূরণের বিষয়টি কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে না দেখার কারণে শিক্ষার্থীদের সেই ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে।


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির শর্ত অনুযায়ী ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য ভর্তিপরীক্ষায় ন্যূনতম ১২ পেতে হবে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে ন্যূনতম ‘বি’ গ্রেড থাকতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা ইংরেজিতে ভর্তি হন তাঁদের প্রত্যেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধাবী, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের বিষয় নির্বাচনের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে শুরু করেছে। শুরুতেই তারা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থী অনেকগুলো বিষয় তাঁদের ভর্তির জন্য পছন্দক্রম অনুযায়ী তালিকা করে দেন। সেখানে প্রথম পছন্দ যদি শর্ত পূরণ না করে থাকে তা হলে দ্বিতীয় পছন্দ শর্ত পূরণ করে কি না তা দেখা হয়। এভাবে যে পর্যন্ত পছন্দক্রমের নিচে গেলে মেধাক্রম অনুযায়ী যে বিষয় পান একজন শিক্ষার্থীকে সে বিষয়ে ভর্তি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত যদি তাঁর বিষয়ের পছন্দক্রমের শেষ বিষয়টিও শর্তসাপেক্ষে না পান সে ক্ষেত্রে তাঁর ভর্তির কোনো সুযোগই থাকে না। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ পদ্ধতিতে ভর্তি করাতে গিয়ে অধীন কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিলে ভুল করেছে। যে ভুল একজন শিক্ষার্থী করেননি তাঁর দায় একজন শিক্ষার্থীকে কেন বহন করতে হবে?
১৫০০ শিক্ষার্থী, যাঁরা প্রত্যেকে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী, তাঁদের মেধাক্রম না জানলেও অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে তাঁরা প্রত্যেকে ইংরেজির শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলেও অন্যান্য কোনো বিষয় পেতে তাঁদের মেধাক্রম বিচারে অসুবিধা হতো না। তা হলে যে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি না পেলেও অন্যান্য বিষয় পেত তাঁদের ক্ষতি করার এই ক্ষমতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কে দিয়েছে? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ভুল বুঝতে সময় পার করেছে আরও একটি শিক্ষাবর্ষ। শিক্ষার্থীর নিবন্ধন পেতে দুই বছর লাগবে কী কারণে? যদি এই নিবন্ধন স্বল্পতম সময়ে দেওয়া হতো তা হলে তাদের ভুল অল্প সময়ের মধ্যে ধরা পড়ত। তখন হয়তো তাঁদের পছন্দক্রমের সঙ্গে মেধাক্রম মিলিয়ে বিভাগ বণ্টন করা সম্ভব হতো। তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় বছর ভর্তির চেষ্টা করার একটা বড় সুযোগও থাকত। সংশ্লিষ্ট অযোগ্য লোকের কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কিংবা কার দায়িত্বহীনতার কারণে ১৫০০ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হয়ে উঠছে সে ব্যাপারেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
ইংরেজিতে ভর্তিপরীক্ষায় ১২ না পাওয়া কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ‘বি’ গ্রেড না থাকার কারণে উদ্ভূত সমস্যা কিন্তু সারা দেশের সব কলেজের শিক্ষার্থীদের মিলিয়ে সংখ্যা ১৫০০, তা নয়। মোট ২২টি কলেজের ১৫০০ শিক্ষার্থী এ অসুবিধায় পড়েছেন। তা হলে বিষয়টি যে কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার পরিচয় বহন করছে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পরীক্ষাই এক বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখোমুখি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা করে তাঁদের সমস্যা সমাধানের পথ সন্ধান করা যেতে পারে, যাতে করে তাঁদের শিক্ষাবর্ষও ঠিক থাকে এবং তাঁদের কোনো শিক্ষাবর্ষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সারা দেশের সব শিক্ষার্থীর জন্য যেহেতু অভিন্ন নিয়মে ভর্তিপরীক্ষা হয়েছে, সুতরাং সেই অভিন্ন নিয়ম ঠিক রেখে তাঁদের প্রথম পছন্দ ইংরেজি না পেলে যে বিষয় পেতেন তাঁদের সেই বিষয়ে অথবা অন্য যেকোনো বিষয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া হোক। ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষ চূড়ান্ত পরীক্ষার সঙ্গে পরীক্ষা গ্রহণ না করে তাঁদের জন্য আরও কিছু সময় বেঁধে দেওয়া হোক। প্রথম বর্ষ ফল প্রকাশের জন্য যে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়, সেই ফল প্রকাশের অল্প সময় আগে তাঁদের পরীক্ষা নেওয়া হোক এবং পরীক্ষকদের কাছে খাতা না পাঠিয়ে পরীক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে কয়েক দিন থাকার ব্যবস্থা করে অল্প সময়ের মধ্যে খাতাগুলো মূল্যায়নের ব্যবস্থা করে অল্প সময় পরে তাঁদের ফল প্রকাশ করা হোক। তা হলে দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তাঁরা এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
১৫০০ সংখ্যাটি নেহাত সামান্য কোনো ব্যাপার নয়। দেশের অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে ১৫০০ শিক্ষার্থী এক শিক্ষাবর্ষে ভর্তি করানো হয় না। তা ছাড়া একজনের দোষে অন্যজন শাস্তি পাবে কেন? বরং যাদের দায়িত্বহীনতার জন্য ১৫০০ শিক্ষার্থী বিপদে আছেন তাদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যাতে করে আর এ অবস্থা সৃষ্টি না হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একই ভুল করেছিল। কিন্তু ফল প্রকাশের তিন দিন পরই আবার সে ফল বাতিল করে নতুন করে ফল প্রকাশ করে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে কলেজগুলো আছে, সেখানে বড় বড় ভুলের আশঙ্কা সব সময়ই রয়েছে। কারণ বড় বড় কলেজে একেকটি বিভাগে স্নাতক, স্নাতক সম্মান, মাস্টার্স পূর্ব ভাগ শেষ ভাগ এবং অনেক ক্ষেত্রে উচ্চমাধ্যমিক সব মিলিয়ে হয়তো দেড় হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। তাঁদের জন্য কোনো করণিকের ব্যবস্থা নেই, সরকারি কোনো পিয়নের ব্যবস্থা নেই। একেকটি বিভাগ চলে শুধুই শিক্ষকদের দ্বারা। তাঁদের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করার এবং দাপ্তরিক কাজের আধিক্যহেতু অনেক সময় ভুলের সম্ভাবনা থেকে যায়।
১৫০০ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন না বলে জানিয়েছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যদি এসব শিক্ষার্থীর জন্য ইতিবাচক কোনো ব্যবস্থা আশু গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তা হলে বঞ্চিত ১৫০০ শিক্ষার্থী নিশ্চয় সংগঠিত হবেন এবং আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন। সেই আন্দোলনে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বন্ধুরা এগিয়ে আসতে পারেন, এগিয়ে আসতে পারেন সচেতন নাগরিক। বিষয়টি নিয়ে এসবের আগেই একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত অত্যন্ত জরুরি।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.