সংঘাত নয়, সংলাপ চাই by গাজীউল হাসান খান
বিশ্বব্যাপী রাজনীতি যখন বিভিন্ন রাষ্ট্রের সব সমস্যা সমাধান করে শান্তি ও অগ্রগতির পথ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের দেশীয় রাজনীতি তখন আপামর জনসাধারণকে ক্রমশ এক আশঙ্কা, সংশয়, বিভেদ ও নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক মহলের মতানৈক্য, শক্তির লড়াই এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা,
শান্তি ও স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে। এক সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা এবং অনেকাংশে জাতিগত বিপর্যয়ের ভয়াবহ নিগড়ে তাদের জীবন-জীবিকা ও ভবিষ্যৎ যেন জিম্মি হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় বারবার মনে হয়, এ দেশটি কি এর সব নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার, স্বার্থ এবং মতামতের ভিত্তিতে চলবে, নাকি রাজনৈতিক মহলের কতিপয় নেতা-নেত্রীর চাপিয়ে দেওয়া কিছু নির্দেশের কাছে আটকা পড়ে থাকবে? যে জনগণের দোহাই দিয়ে সব কিছু চালিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, তা কি আদতেই তাদের চিন্তা-চেতনা, স্বার্থ কিংবা সার্বিক কল্যাণের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে? নাকি নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কায়েমি স্বার্থ ধরে রাখার অপপ্রয়াসে জারি রাখা হচ্ছে বিভিন্ন বাগ্বিতণ্ডা ও রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের অশুভ কার্যক্রম। এতে গঠনশীল জনকল্যাণমুখী রাজনীতি ও বুদ্ধিমত্তার চেয়ে আন্তদলীয় বিভেদ, বিশৃঙ্খলা, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং এমনকি এক অপরিণামদর্শী গৃহযুদ্ধের আলামতই যেন প্রতিফলিত হচ্ছে অনেক বেশি। কোনো শান্তিকামী, সৃষ্টিশীল, উন্নয়নমুখী এবং দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দেশের ব্যাপক সমস্যাসংকুল সাধারণ মানুষ তা কামনা করে না।
আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক মহলের যে দাবিটিকে কেন্দ্র করে এত আস্ফালন কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের হুমকি-ধমকি উঠেছিল, তা কি সূচনায়ই সমাধান করা দুঃসাধ্য ছিল? মোটেও না। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারাধীন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ইস্যুটি জড়িয়ে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার যেমন কিছু অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বিরোধীদলীয় জোটের নেতারা কিছু অসংগত মন্তব্য করে এ ব্যাপারে জনমনে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। এ কথা অস্বীকার করার মোটেও কোনো উপায় নেই যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মূলত একটি রাজনৈতিক ইস্যু। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে কারো কোনো বিচারের প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু যখনই দেখা গেল, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের নির্বাচনী জোট বজায় থাকলে আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তখনই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্থান পায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটি। অথচ এর আগে আজকের কারাবন্দি জামায়াত নেতাদের নিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার, এমনকি বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনও করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সত্যিকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে আমি নই। কিন্তু বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ১২ মার্চের 'ঢাকা চলো' কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে এর নেতৃত্বাধীন জোটের বিভিন্ন নেতা কখনো 'গণ-অভ্যুত্থান', কখনো আবার 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার' ঠেকানোর বিরুদ্ধে যেসব বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে দেশের জনমনে যথেষ্ট সংশয় ও ভয়-ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দলের দাবি আদায়ের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকার পক্ষের অনেকে অনেক মনগড়া উক্তি এবং অভিযোগ করে যাচ্ছেন, যা বাস্তবে অত্যন্ত অযৌক্তিক মনে হবে। মূল সমস্যা অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটির কোনো সুরাহা না করে বরং একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উসানিমূলক আচরণ কিংবা দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মীদের কোনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের কাজ হতে পারে না। বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিহত করার লক্ষ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন জোটের নেওয়া বিভিন্ন অগ্রিম কর্মসূচি দেশের শান্তিকামী সাধারণ মানুষসহ উৎপাদনশীল ও রপ্তানিমূলক খাত এবং শ্রমজীবী শ্রেণীকে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও শঙ্কিত করে তুলেছে। এমনিতেই দেশের সার্বিক অর্থনীতি পড়েছে এক বিপর্যয়ের মুখে। পশ্চিমা জগৎসহ প্রায় সারা বিশ্বে এক মহামন্দার ছায়া এখন ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে উঠছে। দেশের ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত যুবগোষ্ঠীর জন্য হচ্ছে না তেমন কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি ও শেয়ারবাজারের বিপর্যয়সহ সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা তার অর্জিত সব সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ থেকে বিমান চলাচল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শিক্ষাঙ্গন এবং বিশ্বব্যাংক থেকে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক- কোথাও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট অসন্তোষ ও অস্থিরতা সরকার কিংবা তার ক্ষমতাসীন জোটের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাদের যেকোনো ব্যর্থতা বিরোধী দলকে জনসমর্থনপুষ্ট করবে। তার প্রতিফলন ইতোমধ্যেই ঘটেছে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ভবিষ্যতে কি তার ব্যত্যয় ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে?
এ কথা ঠিক যে বিরোধী জোটের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি ও পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের জনসমর্থন যথেষ্ট বেড়েছে। কিন্তু সাংগঠনিক দিক থেকে বিরোধী জোটের দলীয় শক্তি কিংবা নেতৃত্বের প্রশ্নে তেমন কোনো গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলে মনে হয় না। ভবিষ্যতে দল পরিচালনা ও নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে নতুন কোনো সৎ, যোগ্য ও প্রতিভাবান মানুষের আগমন কিংবা যোগদান তেমনভাবে চোখে পড়ছে না।
বিরোধী দলের সর্বত্রই পুরনো মুখের সারি। যাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের সারি সারি অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দল এবং এমনকি সরকারি দলের অনেকেরই মূল পেশা হচ্ছে চাঁদাবাজি। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাঁদের নিজস্ব কোনো আয় বা পেশাগত সংগতি নেই। তাঁদের কারণেই বাংলাদেশে দুর্নীতি অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। অপরদিকে নির্বাচনের সময় দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় যাঁদের পেছনে পেশিশক্তি এবং নিজের প্রচুর কালো টাকা রয়েছে। ত্যাগী, আদর্শবান ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতাসম্পন্ন মানুষের কোথাও ঠাঁই হচ্ছে না। অরাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিরা ক্রমশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে যে দল বা জোটই আবার ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাতে বাংলাদেশের জনগণের দুর্গতি লাঘব হবে না। নেতৃত্বের অসামান্য দক্ষতায় জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে সাফল্যের প্রদীপ যেমন জ্বলে উঠবে না, তেমনি দেশে সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যিকার মেধাসম্পন্ন, শিক্ষিত ও দক্ষ রাজনীতিক প্রয়োজন। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে গৃহযুদ্ধ না বাধিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিভাবে গুণগত পরিবর্তন আনা যায়, দুর্নীতি উচ্ছেদ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানিসহ কাঁচাবাজার থেকে শেয়ারবাজার পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। নতুবা চারদিকে গণ-অসন্তোষের মুখে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া কোনোমতেই সম্ভব হবে না। পরমতসহিষ্ণুতার অভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে আস্থার কিংবা সহমর্মিতার সংকট থেকেই যাবে। দেশে এখন সে অবস্থাই বিরাজ করছে। তাই সুযোগ পেলেই একে অপরকে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করতে চায়।
বিরোধী জোটের তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবির মুখে এখন ক্ষমতাসীন সরকারের উচিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আর বিস্ফোরণোন্মুখ না করে তাদের সঙ্গে অবিলম্বে সংলাপে যাওয়া। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে এ বিষয়টি নিয়ে একটি সংবিধানসম্মত সমাধানে পৌঁছা। নতুবা দেশ শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকটেই নিপতিত হবে না, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হবে সার্বিক অবস্থা। উভয় ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অর্জিত সব অগ্রগতিই ভেস্তে যাবে চরম নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতার কারণে। যুদ্ধাপরাধীদের সাজা দিয়ে এবং দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের আটক করেও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে না অর্থনৈতিকভাবে সংকটাপন্ন সরকার। সরকারের ওপর গ্রামগঞ্জের ব্যাপক মানুষের আস্থা তখন ক্রমশ আরো হ্রাস পাবে। তিস্তা, ট্রানজিট, সীমান্তে বিএসএফের গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে ভারতের পাশাপাশি মানুষ আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় মেতে উঠতে পারে। সে অবস্থায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার অর্থ হবে আবার গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরার মতো। তা ছাড়া সে নির্বাচনকে বহির্বিশ্বেও খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে না। অর্থাৎ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এ ক্ষেত্রে অতীতের নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক এরশাদের ওপর ভরসা করে কোনো লাভ হবে না। কারণ রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর মতো ব্যক্তিদের মিত্র হিসেবে জোগাড় করলে ভবিষ্যতে আর শত্রুর অভাব হবে না। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে গেলে এক এগারো-পূর্ববর্তী পরিস্থিতির আবার পুনরাবৃত্তি ঘটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে অবিলম্বে একটি সমঝোতায় পৌঁছা আবশ্যক। বিরোধী দলের দফা এই একটিই। তাতে যদি তাদের শান্ত করা যায়, তাহলে বর্তমান মহাজোট সরকার হয়তো তাদের বাকি শাসককাজটা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারবে। এবং সামনের সময়টুকু অর্থপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারবে। নতুবা 'গণ-অভ্যুত্থান'-এর আশঙ্কা উড়িয়ে দিলেও শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করার সরকারি পরিকল্পনা কর্পূরের মতো উবে যাবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি যে অযৌক্তিক কিংবা অগণতান্ত্রিক নয়, তা ইতোমধ্যে বহুবার বহুভাবে বলা হয়ে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অযৌক্তিক নয়। তবে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এ মুহূর্তে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বলে বিরোধী জোট যে দাবি তুলেছে তা বিবেচনা করতে মহাজোট সরকারের এত আপত্তি কোথায়? অতীতে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার দাবি বিবেচনা করেই শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সেদিনের সেই সংকট যেমন ছিল একটি 'আস্থার সংকট', আজকের সংকটও মূলত একটি আস্থার সংকট।' সুতরাং হিংসাত্মক ও রক্তপাতের পথ পরিহার করে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারকে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হলে বর্তমান একগুঁয়েমি বা জেদ বজায় না রেখে কিছুটা ত্যাগস্বীকার করতেই হবে। তাতে দেশব্যাপী জনগণ শেখ হাসিনা ও তার জোটকে অবশ্যই সাধুবাদ দেবে। নতুবা হাসিনা সরকার কিংবা তাঁর নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে নানা অভিযোগ উঠতে পারে, যা তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
gaziulhkhan@gmail.com
আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক মহলের যে দাবিটিকে কেন্দ্র করে এত আস্ফালন কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের হুমকি-ধমকি উঠেছিল, তা কি সূচনায়ই সমাধান করা দুঃসাধ্য ছিল? মোটেও না। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারাধীন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ইস্যুটি জড়িয়ে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার যেমন কিছু অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বিরোধীদলীয় জোটের নেতারা কিছু অসংগত মন্তব্য করে এ ব্যাপারে জনমনে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। এ কথা অস্বীকার করার মোটেও কোনো উপায় নেই যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মূলত একটি রাজনৈতিক ইস্যু। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে কারো কোনো বিচারের প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু যখনই দেখা গেল, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের নির্বাচনী জোট বজায় থাকলে আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তখনই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্থান পায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটি। অথচ এর আগে আজকের কারাবন্দি জামায়াত নেতাদের নিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার, এমনকি বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনও করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সত্যিকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে আমি নই। কিন্তু বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ১২ মার্চের 'ঢাকা চলো' কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে এর নেতৃত্বাধীন জোটের বিভিন্ন নেতা কখনো 'গণ-অভ্যুত্থান', কখনো আবার 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার' ঠেকানোর বিরুদ্ধে যেসব বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে দেশের জনমনে যথেষ্ট সংশয় ও ভয়-ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দলের দাবি আদায়ের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকার পক্ষের অনেকে অনেক মনগড়া উক্তি এবং অভিযোগ করে যাচ্ছেন, যা বাস্তবে অত্যন্ত অযৌক্তিক মনে হবে। মূল সমস্যা অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটির কোনো সুরাহা না করে বরং একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উসানিমূলক আচরণ কিংবা দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মীদের কোনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের কাজ হতে পারে না। বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিহত করার লক্ষ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন জোটের নেওয়া বিভিন্ন অগ্রিম কর্মসূচি দেশের শান্তিকামী সাধারণ মানুষসহ উৎপাদনশীল ও রপ্তানিমূলক খাত এবং শ্রমজীবী শ্রেণীকে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও শঙ্কিত করে তুলেছে। এমনিতেই দেশের সার্বিক অর্থনীতি পড়েছে এক বিপর্যয়ের মুখে। পশ্চিমা জগৎসহ প্রায় সারা বিশ্বে এক মহামন্দার ছায়া এখন ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে উঠছে। দেশের ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত যুবগোষ্ঠীর জন্য হচ্ছে না তেমন কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি ও শেয়ারবাজারের বিপর্যয়সহ সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা তার অর্জিত সব সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ থেকে বিমান চলাচল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শিক্ষাঙ্গন এবং বিশ্বব্যাংক থেকে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক- কোথাও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট অসন্তোষ ও অস্থিরতা সরকার কিংবা তার ক্ষমতাসীন জোটের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাদের যেকোনো ব্যর্থতা বিরোধী দলকে জনসমর্থনপুষ্ট করবে। তার প্রতিফলন ইতোমধ্যেই ঘটেছে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ভবিষ্যতে কি তার ব্যত্যয় ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে?
এ কথা ঠিক যে বিরোধী জোটের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি ও পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের জনসমর্থন যথেষ্ট বেড়েছে। কিন্তু সাংগঠনিক দিক থেকে বিরোধী জোটের দলীয় শক্তি কিংবা নেতৃত্বের প্রশ্নে তেমন কোনো গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলে মনে হয় না। ভবিষ্যতে দল পরিচালনা ও নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে নতুন কোনো সৎ, যোগ্য ও প্রতিভাবান মানুষের আগমন কিংবা যোগদান তেমনভাবে চোখে পড়ছে না।
বিরোধী দলের সর্বত্রই পুরনো মুখের সারি। যাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের সারি সারি অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দল এবং এমনকি সরকারি দলের অনেকেরই মূল পেশা হচ্ছে চাঁদাবাজি। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাঁদের নিজস্ব কোনো আয় বা পেশাগত সংগতি নেই। তাঁদের কারণেই বাংলাদেশে দুর্নীতি অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। অপরদিকে নির্বাচনের সময় দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় যাঁদের পেছনে পেশিশক্তি এবং নিজের প্রচুর কালো টাকা রয়েছে। ত্যাগী, আদর্শবান ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতাসম্পন্ন মানুষের কোথাও ঠাঁই হচ্ছে না। অরাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিরা ক্রমশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে যে দল বা জোটই আবার ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাতে বাংলাদেশের জনগণের দুর্গতি লাঘব হবে না। নেতৃত্বের অসামান্য দক্ষতায় জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে সাফল্যের প্রদীপ যেমন জ্বলে উঠবে না, তেমনি দেশে সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যিকার মেধাসম্পন্ন, শিক্ষিত ও দক্ষ রাজনীতিক প্রয়োজন। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে গৃহযুদ্ধ না বাধিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিভাবে গুণগত পরিবর্তন আনা যায়, দুর্নীতি উচ্ছেদ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানিসহ কাঁচাবাজার থেকে শেয়ারবাজার পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। নতুবা চারদিকে গণ-অসন্তোষের মুখে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া কোনোমতেই সম্ভব হবে না। পরমতসহিষ্ণুতার অভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে আস্থার কিংবা সহমর্মিতার সংকট থেকেই যাবে। দেশে এখন সে অবস্থাই বিরাজ করছে। তাই সুযোগ পেলেই একে অপরকে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করতে চায়।
বিরোধী জোটের তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবির মুখে এখন ক্ষমতাসীন সরকারের উচিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আর বিস্ফোরণোন্মুখ না করে তাদের সঙ্গে অবিলম্বে সংলাপে যাওয়া। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে এ বিষয়টি নিয়ে একটি সংবিধানসম্মত সমাধানে পৌঁছা। নতুবা দেশ শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকটেই নিপতিত হবে না, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হবে সার্বিক অবস্থা। উভয় ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অর্জিত সব অগ্রগতিই ভেস্তে যাবে চরম নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতার কারণে। যুদ্ধাপরাধীদের সাজা দিয়ে এবং দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের আটক করেও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে না অর্থনৈতিকভাবে সংকটাপন্ন সরকার। সরকারের ওপর গ্রামগঞ্জের ব্যাপক মানুষের আস্থা তখন ক্রমশ আরো হ্রাস পাবে। তিস্তা, ট্রানজিট, সীমান্তে বিএসএফের গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে ভারতের পাশাপাশি মানুষ আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় মেতে উঠতে পারে। সে অবস্থায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার অর্থ হবে আবার গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরার মতো। তা ছাড়া সে নির্বাচনকে বহির্বিশ্বেও খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে না। অর্থাৎ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এ ক্ষেত্রে অতীতের নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক এরশাদের ওপর ভরসা করে কোনো লাভ হবে না। কারণ রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর মতো ব্যক্তিদের মিত্র হিসেবে জোগাড় করলে ভবিষ্যতে আর শত্রুর অভাব হবে না। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে গেলে এক এগারো-পূর্ববর্তী পরিস্থিতির আবার পুনরাবৃত্তি ঘটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে অবিলম্বে একটি সমঝোতায় পৌঁছা আবশ্যক। বিরোধী দলের দফা এই একটিই। তাতে যদি তাদের শান্ত করা যায়, তাহলে বর্তমান মহাজোট সরকার হয়তো তাদের বাকি শাসককাজটা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারবে। এবং সামনের সময়টুকু অর্থপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারবে। নতুবা 'গণ-অভ্যুত্থান'-এর আশঙ্কা উড়িয়ে দিলেও শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করার সরকারি পরিকল্পনা কর্পূরের মতো উবে যাবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি যে অযৌক্তিক কিংবা অগণতান্ত্রিক নয়, তা ইতোমধ্যে বহুবার বহুভাবে বলা হয়ে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অযৌক্তিক নয়। তবে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এ মুহূর্তে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বলে বিরোধী জোট যে দাবি তুলেছে তা বিবেচনা করতে মহাজোট সরকারের এত আপত্তি কোথায়? অতীতে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার দাবি বিবেচনা করেই শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সেদিনের সেই সংকট যেমন ছিল একটি 'আস্থার সংকট', আজকের সংকটও মূলত একটি আস্থার সংকট।' সুতরাং হিংসাত্মক ও রক্তপাতের পথ পরিহার করে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারকে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হলে বর্তমান একগুঁয়েমি বা জেদ বজায় না রেখে কিছুটা ত্যাগস্বীকার করতেই হবে। তাতে দেশব্যাপী জনগণ শেখ হাসিনা ও তার জোটকে অবশ্যই সাধুবাদ দেবে। নতুবা হাসিনা সরকার কিংবা তাঁর নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে নানা অভিযোগ উঠতে পারে, যা তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
gaziulhkhan@gmail.com
No comments