বাণিজ্যমুখী নয়, চাই গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা-জনগণের স্বাস্থ্যসেবা

যখন চিকিৎসক ছিলেন না, তখনো মা ছিলেন। ছিলেন বলেই মানবজাতি বাড়তে পেরেছে। বিশ্বখ্যাত জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ডেভিড ওয়ারনারের বাংলাদেশ সফর এই একটি কথার কারণেই সার্থক হবে। তিনি বলেছেন, বিশ্বে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সবচেয়ে বেশি দেন মা।


মাকে ক্ষমতা দিলে, প্রশিক্ষণ দিলে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কথাটা সর্বাংশে সত্য, কিন্তু চিকিৎসাসেবার বাণিজ্যিকীকরণ এবং অতি-পেশাদারীকরণের যুগে এ সত্যটা সবাই ভুলতে বসেছে।
আধুনিক ও পেশাদারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের ঘিরেই নির্মিত। সাবেকি যুগের মানুষ নিজের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং রোগ থেকে প্রতিরোধের প্রাথমিক বিধিব্যবস্থা সম্পর্কে যতটা ওয়াকিবহাল ছিল, আধুনিক মানুষ ততটা নয়। প্রতিটি ছোটখাটো প্রয়োজনে তাই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মানুষের এই অনভিজ্ঞতা ও অতিসচেতনতাকে পুঁজি করেই চলছে চিকিৎসা-ব্যবসা ও ওষুধ-বাণিজ্য। গত মঙ্গলবার ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে আয়োজিত সভায় ডেভিড ওয়ারনার এই অবস্থা সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আমাদের সবার দৃষ্টি কেড়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সারা বিশ্বে সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান।’ ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিকে তিনি তাই প্রাতিষ্ঠানিক গণহত্যা বলেও অভিহিত করেছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়ে যায় চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে। এটাও ঠিক, ব্যয়বহুল ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা কিনতে না পারার জন্য প্রতিবছর অজস্র মানুষ অকালে প্রাণ হারায়।
ডেভিড ওয়ারনার সেখানে নিয়ে আসেন বিনা ওষুধে আরোগ্য লাভের উপায়ের ধারণা। ওষুধের সঠিক ও ভুল ব্যবহারের বিষয়টি নিয়েও তাঁর উদ্বেগ আমাদের আমলে নেওয়া দরকার। তিনি বলেছেন, ‘কেউ যদি তাঁর গ্রামকে বসবাসের জন্য অধিকতর স্বাস্থ্য-উপযোগী করে তুলতে কাজ করেন, তবে তিনিই পল্লি-স্বাস্থ্যকর্মী।’ এ ধারণার আলোকে দেখলে দেখব, আমরা ক্রমাগত আমাদের জীবন ও বসতিকে অস্বাস্থ্যকর করে তুলছি; অন্যদিকে জোর দিচ্ছি চিকিৎসক ও ওষুধের ওপর। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্যকর নগর ও গ্রাম এবং স্বাস্থ্যসচেতনতাকে সমাজের সব মানুষের কাণ্ডজ্ঞানে পরিণত করলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও দামি ওষুধের ওপর এত নির্ভরশীলতা গড়ে উঠত না।
ডেভিড ওয়ারনার প্রচলবিরোধী স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ। তাঁর পদ্ধতি দরিদ্র দেশগুলোর বেলায় খুবই সাফল্যদায়ক। আশা করি, নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যবিষয়ক সবাই তাঁর পরামর্শের তাৎপর্য অনুধাবন করবেন।

No comments

Powered by Blogger.