বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা-বিদায় বইমেলা ২০১২ by সাজ্জাদ শরিফ
এটা কি বইমেলার শেষ দিন? ফেব্রুয়ারির শেষে বইমেলার এই দিনটিকে পত্রপত্রিকায় তুলনা করা হয়ে থাকে ভাঙা হাটের সঙ্গে। কিন্তু কোথায় ভাঙা হাট? বইমেলা প্রাঙ্গণে ঢোকার মুখে মানুষের ভিড়ে চলার গতি কমিয়ে আনতে হয়। এ বছর বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক মেলায় ঢুকেছিলেন আমাদের সঙ্গেই।
তাঁকে দেখে ‘ওই যে, ওই যে’ বলে ছুটে এলেন একদল তরুণী। তাঁদের হাতে তাঁর সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসত্রয়ীর প্রথম খণ্ড যারা ভোর এনেছিল। বইটি কেনার পর লেখককে হাতের এত কাছে পেয়ে তাঁর স্বাক্ষর না নিয়ে কি ঘরে ফেরা যায়?
উপচে পড়া ভিড় মেলার ভেতরেও। মেলার শেষের দিকের এই ভিড়ের সঙ্গে আগের দিনগুলোর ভিড়ের চরিত্রগত কিছু তফাত আছে। এই ভিড়ের বেশির ভাগ হাতে দেখা যাচ্ছে বই। এত দিন ছিল দেখার পালা। কী কী বই আসছে, কোন কোন বই কিনতে হবে, তার নানা হিসাব-নিকাশ। শেষের দিনগুলো কেনার। শুধুই কি নতুন বই? তা কিন্তু নয়। ‘বইমেলায় না এলে তো আমি জানতেই পারতাম না যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধানটি আবার বেরিয়েছে।’ বললেন আবদুস সালাম। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন থাকেন রাজশাহীতে। মূলত বই কিনতেই মেলা গুটিয়ে যাওয়ার আগে তড়িঘড়ি করে ঢাকায় এসেছেন। ‘আমরা যারা ঢাকার বাইরে থাকি, তারা পত্রিকায় নতুন বইয়ের খবর পড়ি; আর চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকি, কখন সে বই দেখার সুযোগ পাব।’ ঢাকার বাইরের এই গ্রন্থপ্রেমীদের হাহাকারের প্রতি কি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সাড়া দেবে?
বইমেলার শৃঙ্খলা
কয়েক বছর ধরে বইমেলাকে কিছু নিয়মকানুনে বাঁধার কথা উঠছে জোরেশোরে। প্রথম সারির একজন প্রকাশক—যিনি আবার মেলা কমিটি ও টাস্কফোর্সেরও সদস্য—বললেন, বাংলা একাডেমীর এই ছোট্ট জায়গার মধ্যেও পরিসর আরও বাড়ানো সম্ভব, যদি যথার্থ প্রকাশকদের চিহ্নিত করার জন্য কিছু পূর্বশর্ত কঠোরভাবে বেঁধে দেওয়া যায়। তিন ইউনিটের একটি স্টলের দিকে তিনি ইঙ্গিত করে দেখালেন। গিয়ে দেখা গেল, এ বছর তাদের প্রকাশনার সংখ্যা সত্যি সত্যি একেবারে হাতেগোনা। স্টলটি অচেনা কিছু প্রকাশনা সংস্থার নিম্নমানের বই দিয়ে ভরা। এদের যোগ্যতা কী? না, এর স্বত্বাধিকারী একজন প্রবীণ প্রবাসী লেখক। সেই প্রকাশক জানালেন, এমন স্টলের সংখ্যা একেবারে কম নয়।
পূর্বশর্ত বেঁধে দেওয়ার প্রতি সায় দিলেন আরও কয়েকজন প্রকাশক। এমনকি কয়েকজন লেখকও। একজন বললেন, ‘বইমেলার ভেতরে সংগঠনের স্টল কেন থাকবে?’ শুধু কি সংগঠন, তিনি দেখিয়ে দিলেন আরও বিচিত্র ধরনের স্টল: তথ্যমাধ্যমের, কাগজ প্রস্তুতকারীর, বেসরকারি সাহায্য সংস্থার। তাঁর পরামর্শ, পেশাদার প্রকাশক ছাড়া এই বইমেলায় আর কাউকেই স্টল বরাদ্দ দেওয়া উচিত নয়। যেসব বেসরকারি সাহায্য সংস্থা তাদের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বই বের করে থাকে, তাদেরও না। তাহলেও মেলার জন্য আরও পরিসর বের করে আনা সম্ভব।
একজন শিশুসাহিত্যিক বললেন, বইমেলায় সবচেয়ে বড় ভোগান্তি হয় শিশু-কিশোরদের। তাদের জন্য মেলার একটি অংশ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেখানে কি ভালো শিশু-কিশোরসাহিত্য পাওয়া যায়? তাঁর পরামর্শ, যারা ভালো শিশুসাহিত্যের প্রকাশক, তাদের সবাইকে এখানে একটি করে ইউনিটের স্টল বরাদ্দ করলে বাচ্চাদের আর হন্যে হয়ে সারা মেলায় ঘুরতে হবে না; এই জায়গাটুকুরও অপচয় হবে না।
তথ্য ও সংখ্যা
বইমেলায় কতগুলো বই এল, কোন বই কত সংখ্যায় বিক্রি হলো, কত টাকার বই বিক্রি হলো—এসবের সঠিক কোনো তথ্য এখনো পাওয়ার উপায় নেই। ইউপিএলের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমেদের এটি সব সময়ের আক্ষেপ। কদিন আগে বই নিয়ে এক কথকতার আগে তিনি বলছিলেন, ‘এসব তথ্য যথাযথভাবে পেলে বই, বইমেলা, দেশের প্রকাশনা ইত্যাদি নিয়ে ভাবা যেত।’ তিনি সব সময় জোর দিয়ে আসছেন বইমেলায় ঢোকার জন্য স্বল্পমূল্য হলেও টিকিট প্রবর্তনের ওপর। তাতে মেলার দর্শনার্থীর সংখ্যা জানা যেত, অহেতুক ভিড় কমত, মেলা ব্যবস্থাপনার কিছু খরচও উঠে আসত।
একই প্রসঙ্গ তুলে বাংলা একাডেমীর পরিচালনা পর্ষদের এক সাবেক সদস্য বললেন, টিকিটের ব্যবস্থা হলে সেটি নানা দিক থেকেই ভালো হতো। একটি সাংস্কৃতিক জোটের জন্য আগে সেটি হতে হতেও হয়নি। আবার সে কথা ভাবা যেতে পারে।
কবি জাহিদ হায়দার তুললেন খোদ প্রকাশনার মান-উন্নয়নের কথা। তাঁর কথা, প্রকাশনা এখন যথেষ্ট লাভজনক খাত। বইয়ের মান বাড়ানোর জন্য এখন প্রকাশকদের নজর দিতে হবে। ভালো পাণ্ডুলিপি বাছাই করা, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করা এবং নির্ভুলভাবে বই ছাপানোর দিকে না তাকালে পাঠকদের প্রতি গুরুতর অন্যায় করা হয়।
লেখক ও পাঠকদের পক্ষ থেকে প্রকাশনার মান বাড়ানোর কথা এবার উঠেছে বেশ জোরের সঙ্গে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা নিয়ে বছর কয়েক ধরে কর্মশালার আয়োজন করছেন রাখাল রাহা। আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে প্রকাশকেরা পাণ্ডুলিপি-ব্যবস্থাপনা কিছুটা হলেও পাল্টাতে বাধ্য হবেন, তাঁর বিশ্বাস।
এবারের বইমেলার চেয়ে আরেকটু গুছিয়ে আসুক আগামী বছরের বইমেলা। বাঙালির সৃষ্টির সম্ভার নিয়ে আসুক আরও নতুন বই—আরেকটু নির্ভুল হয়ে, আরও সুন্দর হয়ে।
বিদায় বইমেলা ২০১২।
উপচে পড়া ভিড় মেলার ভেতরেও। মেলার শেষের দিকের এই ভিড়ের সঙ্গে আগের দিনগুলোর ভিড়ের চরিত্রগত কিছু তফাত আছে। এই ভিড়ের বেশির ভাগ হাতে দেখা যাচ্ছে বই। এত দিন ছিল দেখার পালা। কী কী বই আসছে, কোন কোন বই কিনতে হবে, তার নানা হিসাব-নিকাশ। শেষের দিনগুলো কেনার। শুধুই কি নতুন বই? তা কিন্তু নয়। ‘বইমেলায় না এলে তো আমি জানতেই পারতাম না যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধানটি আবার বেরিয়েছে।’ বললেন আবদুস সালাম। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন থাকেন রাজশাহীতে। মূলত বই কিনতেই মেলা গুটিয়ে যাওয়ার আগে তড়িঘড়ি করে ঢাকায় এসেছেন। ‘আমরা যারা ঢাকার বাইরে থাকি, তারা পত্রিকায় নতুন বইয়ের খবর পড়ি; আর চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকি, কখন সে বই দেখার সুযোগ পাব।’ ঢাকার বাইরের এই গ্রন্থপ্রেমীদের হাহাকারের প্রতি কি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সাড়া দেবে?
বইমেলার শৃঙ্খলা
কয়েক বছর ধরে বইমেলাকে কিছু নিয়মকানুনে বাঁধার কথা উঠছে জোরেশোরে। প্রথম সারির একজন প্রকাশক—যিনি আবার মেলা কমিটি ও টাস্কফোর্সেরও সদস্য—বললেন, বাংলা একাডেমীর এই ছোট্ট জায়গার মধ্যেও পরিসর আরও বাড়ানো সম্ভব, যদি যথার্থ প্রকাশকদের চিহ্নিত করার জন্য কিছু পূর্বশর্ত কঠোরভাবে বেঁধে দেওয়া যায়। তিন ইউনিটের একটি স্টলের দিকে তিনি ইঙ্গিত করে দেখালেন। গিয়ে দেখা গেল, এ বছর তাদের প্রকাশনার সংখ্যা সত্যি সত্যি একেবারে হাতেগোনা। স্টলটি অচেনা কিছু প্রকাশনা সংস্থার নিম্নমানের বই দিয়ে ভরা। এদের যোগ্যতা কী? না, এর স্বত্বাধিকারী একজন প্রবীণ প্রবাসী লেখক। সেই প্রকাশক জানালেন, এমন স্টলের সংখ্যা একেবারে কম নয়।
পূর্বশর্ত বেঁধে দেওয়ার প্রতি সায় দিলেন আরও কয়েকজন প্রকাশক। এমনকি কয়েকজন লেখকও। একজন বললেন, ‘বইমেলার ভেতরে সংগঠনের স্টল কেন থাকবে?’ শুধু কি সংগঠন, তিনি দেখিয়ে দিলেন আরও বিচিত্র ধরনের স্টল: তথ্যমাধ্যমের, কাগজ প্রস্তুতকারীর, বেসরকারি সাহায্য সংস্থার। তাঁর পরামর্শ, পেশাদার প্রকাশক ছাড়া এই বইমেলায় আর কাউকেই স্টল বরাদ্দ দেওয়া উচিত নয়। যেসব বেসরকারি সাহায্য সংস্থা তাদের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বই বের করে থাকে, তাদেরও না। তাহলেও মেলার জন্য আরও পরিসর বের করে আনা সম্ভব।
একজন শিশুসাহিত্যিক বললেন, বইমেলায় সবচেয়ে বড় ভোগান্তি হয় শিশু-কিশোরদের। তাদের জন্য মেলার একটি অংশ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেখানে কি ভালো শিশু-কিশোরসাহিত্য পাওয়া যায়? তাঁর পরামর্শ, যারা ভালো শিশুসাহিত্যের প্রকাশক, তাদের সবাইকে এখানে একটি করে ইউনিটের স্টল বরাদ্দ করলে বাচ্চাদের আর হন্যে হয়ে সারা মেলায় ঘুরতে হবে না; এই জায়গাটুকুরও অপচয় হবে না।
তথ্য ও সংখ্যা
বইমেলায় কতগুলো বই এল, কোন বই কত সংখ্যায় বিক্রি হলো, কত টাকার বই বিক্রি হলো—এসবের সঠিক কোনো তথ্য এখনো পাওয়ার উপায় নেই। ইউপিএলের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমেদের এটি সব সময়ের আক্ষেপ। কদিন আগে বই নিয়ে এক কথকতার আগে তিনি বলছিলেন, ‘এসব তথ্য যথাযথভাবে পেলে বই, বইমেলা, দেশের প্রকাশনা ইত্যাদি নিয়ে ভাবা যেত।’ তিনি সব সময় জোর দিয়ে আসছেন বইমেলায় ঢোকার জন্য স্বল্পমূল্য হলেও টিকিট প্রবর্তনের ওপর। তাতে মেলার দর্শনার্থীর সংখ্যা জানা যেত, অহেতুক ভিড় কমত, মেলা ব্যবস্থাপনার কিছু খরচও উঠে আসত।
একই প্রসঙ্গ তুলে বাংলা একাডেমীর পরিচালনা পর্ষদের এক সাবেক সদস্য বললেন, টিকিটের ব্যবস্থা হলে সেটি নানা দিক থেকেই ভালো হতো। একটি সাংস্কৃতিক জোটের জন্য আগে সেটি হতে হতেও হয়নি। আবার সে কথা ভাবা যেতে পারে।
কবি জাহিদ হায়দার তুললেন খোদ প্রকাশনার মান-উন্নয়নের কথা। তাঁর কথা, প্রকাশনা এখন যথেষ্ট লাভজনক খাত। বইয়ের মান বাড়ানোর জন্য এখন প্রকাশকদের নজর দিতে হবে। ভালো পাণ্ডুলিপি বাছাই করা, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করা এবং নির্ভুলভাবে বই ছাপানোর দিকে না তাকালে পাঠকদের প্রতি গুরুতর অন্যায় করা হয়।
লেখক ও পাঠকদের পক্ষ থেকে প্রকাশনার মান বাড়ানোর কথা এবার উঠেছে বেশ জোরের সঙ্গে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা নিয়ে বছর কয়েক ধরে কর্মশালার আয়োজন করছেন রাখাল রাহা। আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে প্রকাশকেরা পাণ্ডুলিপি-ব্যবস্থাপনা কিছুটা হলেও পাল্টাতে বাধ্য হবেন, তাঁর বিশ্বাস।
এবারের বইমেলার চেয়ে আরেকটু গুছিয়ে আসুক আগামী বছরের বইমেলা। বাঙালির সৃষ্টির সম্ভার নিয়ে আসুক আরও নতুন বই—আরেকটু নির্ভুল হয়ে, আরও সুন্দর হয়ে।
বিদায় বইমেলা ২০১২।
No comments