শ্রমিকদের তাজুল ইসলাম by সহিদুল্লাহ চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন কৃতী ছাত্র বদলি শ্রমিকের কষ্টকর জীবন বেছে নিয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্য সামনে রেখে। সাহস, ধৈর্য, সাধনা_ এসব গুণ ছিল তার মধ্যে। শ্রমিকরাও সেটা বুঝতে পারছিল মহৎ লক্ষ্য অর্জনে আত্মনিবেদনের অনেক ঘটনার সাক্ষী মানব ইতিহাস।
আমাদের ভূখণ্ডে গণতন্ত্র কায়েমে, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায়, শ্রমজীবী জনগণের মুক্তি সাধনায় এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার জন্য অগণিত মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন। তিতুমীর, সূর্য সেন, সালাম, বরকত, মনু মিয়া, আসাদ, মতিউর, সার্জেন্ট জহুর_ কত নক্ষত্রের নামই তো আমরা করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন ৩০ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু। স্বাধীন বাংলাদেশেও নানা শ্রেণী-পেশার মানুষকে অধিকার আদায়ের জন্য লড়তে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এ লড়াইয়ের একজন অনন্য সংগ্রামী ছিলেন তাজুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সেরা ছাত্রদের একজন ছিলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছেন। একাত্তরে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধরেছেন। ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গণমুখী শিক্ষার জন্য নিরলস কাজ করেছেন।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় আমলেই আমরা দেখেছি ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। যারা গিয়েছেন সবাই সফল হতে পারেননি। তাজুল ইসলাম কিন্তু দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন। তিনি শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল হিসেবে পরিচিত আদমজী জুটমিলে শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। এর পেছনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রেরণা ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের আস্থা অর্জনের জন্য বদলি শ্রমিকের কাজ নেওয়া এবং শ্রমিক কলোনিতে নিয়মিত থাকা কেবল পার্টির নির্দেশে হয় না। এ জন্য ভেতর থেকে তাগিদ আসতে হয়। প্রকৃত অর্থেই তাজুল ইসলাম শ্রমিকদের মধ্যে পড়ে থেকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। এ কাজে পদে পদে বাধা এসেছে। তার সততা, নিষ্ঠা, নীতিনিষ্ঠ অবস্থানকে মিলের প্রশাসকরা ভালো চোখে দেখেনি। এমনকি সুবিধাবাদী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের কাছেও তিনি হয়ে ওঠেন প্রতিপক্ষ। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে গণতন্ত্র নির্বাসন দিয়ে যে সামরিক শাসন দেশের বুকে চেপে বসেছিল তার শাসকদের কাছেও তিনি ছিলেন অনাকাঙ্ক্ষিত। আইয়ুব খান আদমজী পাটকলের শ্রমিকদের শক্তিমত্তার পরিচয় পেয়েছিলেন। তার কঠোর সামরিক শাসনের মধ্যেই প্রথম বড় ধরনের প্রতিবাদ এসেছিল এ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের দিক থেকে। তারা ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ধর্মঘট করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে এ কারখানার শ্রমিকরা মিছিল করে ঢাকায় চলে এসেছিল। এমন প্রতিষ্ঠানটিতে তাজুল ইসলামের মতো নিবেদিতপ্রাণ একজন নেতা প্রভাব বিস্তার করে চললে বড় ধরনের বিপদ নেমে আসতে পারে_ এমন শঙ্কা শাসক-শোষকদের ছিল। ১৯৮৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তাজুল ইসলামের ওপর আঘাত তাই আকস্মিক ছিল না। পরদিন ১ মার্চ ছিল কয়েকটি রাজনৈতিক জোট এবং শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের দেশব্যাপী ডাকা হরতাল। শ্রমিকশ্রেণী যাতে এ হরতালে শামিল হয়, এ জন্য সর্বত্রই উদ্যোগ ছিল। তাজুল ইসলাম সক্রিয় হয়েছিলেন আদমজীতে। তিনি শ্রমিকদের আহ্বান জানান পরদিন কারখানা বন্ধ রাখার জন্য। এ সময়ই সামরিক শাসকদের পোষা গুণ্ডারা তাকে আঘাত করে। পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার খবর ছড়িয়ে পড়ায় আদমজী-বাওয়ানীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শ্রমিক পথে নেমে পড়ে। এসব স্থান হয়ে ওঠে অগি্নগর্ভ। সংবাদপত্রে তার আত্মদানের খবর পড়ে দেশবাসী জানতে পারে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন কৃতী ছাত্র বদলি শ্রমিকের কষ্টকর জীবন বেছে নিয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্য সামনে রেখে। সাহস, ধৈর্য, সাধনা_ এসব গুণ ছিল তার মধ্যে। শ্রমিকরাও সেটা বুঝতে পারছিল। এ কারণেই তাদের প্রতিবাদ হয়েছিল ব্যাপক ও তীব্র। তার স্ত্রী ও দুটি নাবালক পুত্রের পাশে দাঁড়িয়েছিল হাজার হাজার শ্রমিক। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা বেতনের একটি অংশ তুলে দেয় তাজুলের পরিবারের হাতে।
তাজুল ইসলামের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন আরও বেগবান হয়। শ্রমিকরা এতে বেশি বেশি করে শামিল হতে থাকে। এ কারণে ১৯৮৪ সালের ২৮ এপ্রিল শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপের ডাকা ধর্মঘট সর্বাত্মক ধর্মঘটে রূপ নিয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ বাধ্য হন স্কপের নেতাদের সঙ্গে শ্রমিক ও কর্মচারীদের দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি সম্পাদনে। এভাবে সেনাশাসকের নতিস্বীকার শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বেও ব্যতিক্রমী ঘটনা।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ মোটেই ভালো নেই। বিজ্ঞজনেরা বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে। নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। কিন্তু শ্রমিকদের জীবনে তার প্রভাব তো দেখা যায় না। কিছু লোক অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে, কিন্তু শ্রমিকদের জীবনে কষ্টের শেষ নেই। আমাদের জন্য আরও মনোকষ্ট হয়ে আছে তাজুল ইসলামের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আদমজী পাটকল চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের এ সিদ্ধান্ত দেশের জন্য আত্মঘাতী, সেটা এখন সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন।
সহিদুল্লাহ চৌধুরী :শ্রমিক নেতা
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় আমলেই আমরা দেখেছি ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। যারা গিয়েছেন সবাই সফল হতে পারেননি। তাজুল ইসলাম কিন্তু দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন। তিনি শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল হিসেবে পরিচিত আদমজী জুটমিলে শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। এর পেছনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রেরণা ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের আস্থা অর্জনের জন্য বদলি শ্রমিকের কাজ নেওয়া এবং শ্রমিক কলোনিতে নিয়মিত থাকা কেবল পার্টির নির্দেশে হয় না। এ জন্য ভেতর থেকে তাগিদ আসতে হয়। প্রকৃত অর্থেই তাজুল ইসলাম শ্রমিকদের মধ্যে পড়ে থেকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। এ কাজে পদে পদে বাধা এসেছে। তার সততা, নিষ্ঠা, নীতিনিষ্ঠ অবস্থানকে মিলের প্রশাসকরা ভালো চোখে দেখেনি। এমনকি সুবিধাবাদী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের কাছেও তিনি হয়ে ওঠেন প্রতিপক্ষ। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে গণতন্ত্র নির্বাসন দিয়ে যে সামরিক শাসন দেশের বুকে চেপে বসেছিল তার শাসকদের কাছেও তিনি ছিলেন অনাকাঙ্ক্ষিত। আইয়ুব খান আদমজী পাটকলের শ্রমিকদের শক্তিমত্তার পরিচয় পেয়েছিলেন। তার কঠোর সামরিক শাসনের মধ্যেই প্রথম বড় ধরনের প্রতিবাদ এসেছিল এ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের দিক থেকে। তারা ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ধর্মঘট করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে এ কারখানার শ্রমিকরা মিছিল করে ঢাকায় চলে এসেছিল। এমন প্রতিষ্ঠানটিতে তাজুল ইসলামের মতো নিবেদিতপ্রাণ একজন নেতা প্রভাব বিস্তার করে চললে বড় ধরনের বিপদ নেমে আসতে পারে_ এমন শঙ্কা শাসক-শোষকদের ছিল। ১৯৮৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তাজুল ইসলামের ওপর আঘাত তাই আকস্মিক ছিল না। পরদিন ১ মার্চ ছিল কয়েকটি রাজনৈতিক জোট এবং শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের দেশব্যাপী ডাকা হরতাল। শ্রমিকশ্রেণী যাতে এ হরতালে শামিল হয়, এ জন্য সর্বত্রই উদ্যোগ ছিল। তাজুল ইসলাম সক্রিয় হয়েছিলেন আদমজীতে। তিনি শ্রমিকদের আহ্বান জানান পরদিন কারখানা বন্ধ রাখার জন্য। এ সময়ই সামরিক শাসকদের পোষা গুণ্ডারা তাকে আঘাত করে। পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার খবর ছড়িয়ে পড়ায় আদমজী-বাওয়ানীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শ্রমিক পথে নেমে পড়ে। এসব স্থান হয়ে ওঠে অগি্নগর্ভ। সংবাদপত্রে তার আত্মদানের খবর পড়ে দেশবাসী জানতে পারে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন কৃতী ছাত্র বদলি শ্রমিকের কষ্টকর জীবন বেছে নিয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্য সামনে রেখে। সাহস, ধৈর্য, সাধনা_ এসব গুণ ছিল তার মধ্যে। শ্রমিকরাও সেটা বুঝতে পারছিল। এ কারণেই তাদের প্রতিবাদ হয়েছিল ব্যাপক ও তীব্র। তার স্ত্রী ও দুটি নাবালক পুত্রের পাশে দাঁড়িয়েছিল হাজার হাজার শ্রমিক। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা বেতনের একটি অংশ তুলে দেয় তাজুলের পরিবারের হাতে।
তাজুল ইসলামের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন আরও বেগবান হয়। শ্রমিকরা এতে বেশি বেশি করে শামিল হতে থাকে। এ কারণে ১৯৮৪ সালের ২৮ এপ্রিল শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপের ডাকা ধর্মঘট সর্বাত্মক ধর্মঘটে রূপ নিয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ বাধ্য হন স্কপের নেতাদের সঙ্গে শ্রমিক ও কর্মচারীদের দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি সম্পাদনে। এভাবে সেনাশাসকের নতিস্বীকার শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বেও ব্যতিক্রমী ঘটনা।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ মোটেই ভালো নেই। বিজ্ঞজনেরা বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে। নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। কিন্তু শ্রমিকদের জীবনে তার প্রভাব তো দেখা যায় না। কিছু লোক অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে, কিন্তু শ্রমিকদের জীবনে কষ্টের শেষ নেই। আমাদের জন্য আরও মনোকষ্ট হয়ে আছে তাজুল ইসলামের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আদমজী পাটকল চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের এ সিদ্ধান্ত দেশের জন্য আত্মঘাতী, সেটা এখন সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন।
সহিদুল্লাহ চৌধুরী :শ্রমিক নেতা
No comments