কলকাতার চিঠি-বাংলাদেশি বন্দী এবং পশ্চিমবঙ্গ কারাগার by অমর সাহা

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারাগারে এখন প্রায় দেড় হাজার বাংলাদেশি বন্দী রয়েছে। এর মধ্যে কারাদণ্ড ভোগ করা (জানখালাসপ্রাপ্ত) বন্দীর সংখ্যা ২১৩। বাকিরা কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন বন্দী। কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশন সূত্র থেকে বলা হয়েছে, এখন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছে এক হাজার ৬৬০ জন বাংলাদেশি বন্দী।


এর মধ্যে জানখালাসপ্রাপ্ত বন্দীর সংখ্যা ২১৩। এসব বন্দীর মধ্যে এমনও রয়েছে, যারা কারাদণ্ড ভোগ করার পর এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত পড়ে রয়েছে বিভিন্ন কারাগারে।
মূলত, কূটনৈতিক জটিলতার কারণেই এসব বন্দী কারাদণ্ড ভোগ করার পরও যথাসময়ে দেশে ফিরে যেতে পারে না। এ নিয়ে বন্দীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। আর মাঝেমধ্যে জানখালাসপ্রাপ্ত বন্দীরা দেশে ফেরার দাবিতে কারাগারের মধ্যেই শুরু করে অনশন। এ ধরনের অনশন হয়েছে কোচবিহার, শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, বহরমপুর আর উত্তর দিনাজপুর কারাগারে।
বলে রাখা ভালো, ভারতে এখন আর কারাগার শব্দটি নেই। সব কারাগারকে বলা হয় সংশোধনাগার। আর এই বিভিন্ন কারাগার বা সংশোধনাগারে বাংলাদেশি বন্দীদের অনশনের জেরে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। বাংলাদেশ সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তৎপর হয়ে ওঠে। তারপর শুরু হয় এসব বন্দীকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া। কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশন জানখালাসপ্রাপ্ত ওই সব বন্দীর তালিকা পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখান থেকে এসব বন্দীর নাগরিকত্ব যাচাই করে রিপোর্ট পাঠানোর পর শুরু হয় এসব বন্দীকে দেশে ফেরানোর কাজ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এসব বন্দীকে তুলে দেয় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে। বিএসএফ তুলে দেয় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবির হাতে। এভাবেই চলে বন্দীদের দেশে ফেরত পাঠানোর কাজ। এতে সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশি বন্দীরা। তারা চাইছে, এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুত সম্পাদন করা হোক।
সাজার মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও দেশে ফিরতে না পেরে দেশে ফেরার দাবিতে সর্বশেষ অনশন হয় পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা কারাগারে। গত ২১ জুলাই ৯ বাংলাদেশি বন্দী এখানে অনশন শুরু করে। এই বন্দীদের মধ্যে ছিল চারজন পুরুষ ও পাঁচজন নারী। চার দিন পর কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সব বন্দী অনশন প্রত্যাহার করে।
কারাগারের সুপারিনটেনডেন্ট খগেন্দ্রনাথ তীর প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, কোচবিহার কারাগারে এখন ৪৮০ জন বন্দী থাকলেও এর মধ্যে ২৫০ জনই বাংলাদেশি বন্দী। এই বন্দীদের মধ্যে আবার ২৩ জন বন্দীর সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এর আগে অবশ্য ৪৯ জন বাংলাদেশি বন্দীর সঙ্গে তাদের ছয়টি শিশুকে এই কারাগার থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তা-ও হয়েছিল ওই সব বন্দীর অনশন শুরু করার পর।
এর আগে গত ৯ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার আলিপুরদুয়ারের বিশেষ কারাগারে তিন বাংলাদেশি বন্দী দেশে ফেরার জন্য চার দিন একটানা অনশন করার পর কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে অনশন প্রত্যাহার করে। ১০ মাস আগে এই বন্দীদের কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও তারা দেশে ফিরে যেতে পারেনি।
তাই পশ্চিমবঙ্গের কারাগারে বন্দী বাংলাদেশি বন্দীদের দ্রুত মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে এবার পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুন করে উদ্যোগও নিয়েছে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারাগারে জানখালাসপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বন্দীদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানাতে কলকাতা হাইকোর্টের এক নির্দেশের জেরে পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম গত জুলাই মাসে এক বৈঠক করেন কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশের উপহাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় এখন থেকে কোনো বাংলাদেশি বন্দী কারাদণ্ডাদেশ পাওয়ার পরই পশ্চিমবঙ্গ সরকার সঙ্গে সঙ্গেই ওই বন্দী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দেবে বাংলাদেশ সরকারকে। এ ছাড়া কোনো বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে বিচারের সম্মুখীন হলেই সেই সংবাদও জানিয়ে দেওয়া হবে কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে। এমনকি এখন থেকে বিভিন্ন কারাগার কর্তৃপক্ষও সরাসরি বন্দী বাংলাদেশিদের সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে, যেটা আগে সম্ভব ছিল না। এর ফলে বাংলাদেশি বন্দীদের দ্রুত সে দেশে ফেরত পাঠানো সহজ হবে।
প্রসঙ্গত, গত মে মাসে দিল্লির স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারাগারের পাঁচ শতাধিক জানখালাসপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বন্দীকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আরজি জানায়। সেই মামলায় রাজ্য সরকার যথারীতি উপস্থিত না হলে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জয়নারায়ণ প্যাটেল এবং বিচারপতি অসীমকুমার রায়ের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ হাইকোর্টে তলব করেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবকে। স্বরাষ্ট্রসচিব গত ৮ জুলাই হাইকোর্টে উপস্থিত হয়ে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সময় চান। পরে হাইকোর্ট দুই সপ্তাহের সময় দেন স্বরাষ্ট্রসচিবকে।
গত মে মাসে দায়ের করা এই জনস্বার্থ মামলায় দাবি করা হয়, কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও অন্তত পাঁচ শতাধিক জানখালাসপ্রাপ্ত বন্দী বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারছে না। তাদের অবিলম্বে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক। একই সঙ্গে দাবি করা হয়, বন্দীদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতিদিন পাঁচ হাজার রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। মামলার বাদীর আইনজীবী মধুরিমা ধানুকা হাইকোর্টে জানান, মে মাসের হিসাবে ৪২৭ জন পুরুষ ও ৫৩ জন নারী বাংলাদেশি কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বিভিন্ন কারাগারে রয়েছে, যারা এখনো বাংলাদেশে ফিরতে পারছে না। এদের কারও কারও কারাদণ্ডের মেয়াদ দু-তিন বছর আগে শেষ হয়েছে।
এদিকে স্বরাষ্ট্রসচিবের হলফনামা পেশের পর বন্দীদের দ্রুত বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কী নির্দেশিকা রয়েছে, তা জানার জন্য কলকাতা হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে ওই মামলায় পক্ষভুক্ত করার আদেশ দেয় গত ২৯ জুলাই। একই সঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জয়নারায়ণ প্যাটেল এবং বিচারপতি অসীমকুমার রায়ের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পেশ করা হলফনামায় বলা হয়, কারাবন্দী বাংলাদেশিদের শনাক্তকরণ চিঠি বাংলাদেশ থেকে বিলম্বে আসার কারণে কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশি বন্দীরা যথাসময়ে বাংলাদেশে ফিরতে পারে না। ফলে তাদের থাকতে হচ্ছে বিভিন্ন কারাগারে।
এ ব্যাপারে কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশের উপহাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশ সরকার সব সময়ই বাংলাদেশি বন্দীদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী। কিন্তু বন্দীদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে সময়মতো না পাওয়ার কারণে এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। তবে উপহাইকমিশন বন্দীদের তালিকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশ সরকারের কাছে। সেখান থেকে বন্দীদের নাগরিকত্ব যাচাই-সম্পর্কীয় প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ এলেই বাংলাদেশ সরকার বন্দীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
দেখা গেছে, এই বাংলাদেশি বন্দীদের মধ্যে রয়েছে নারী আর শিশুও। কাজের লোভে দালালদের খপ্পরে পড়ে এসব বন্দী বেআইনিভাবে সীমান্ত পার হতে গিয়ে ধরা পড়ে। তারপর তাদের ঠাঁই হয় পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে সীমান্ত জেলার কারাগারে। এসব বন্দীকে দ্রুত বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কলকাতার কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উদ্যোগ নিলেও তারাও আটকে যায় কূটনৈতিক জটিলতার বেড়াজালে। তাই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মকর্তারাও চাইছে, এসব বন্দীকে দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য উভয় দেশ একটা সিদ্ধান্ত নিক, যাতে করে মানবিকতার দিক বিবেচনা করে উভয় দেশের সরকার বন্দীদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে পারে।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.