'তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন' by বুলবুল মহলানবীশ
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো দেখি চারপাশে হালকা আলো। অচেনা একটা মিষ্টি গন্ধ। মৃদু মৃদু সুর। ভীষণ একটা ভালোলাগা। এত ভোরে আমি তো কখনো উঠি না! সেই মৃদু ভেসে আসা সুর, গন্ধ আর আলো ধীরে ধীরে আমার কাছে এল। এক্কেবারে আমার হাতের নাগালে।
হঠাৎ একটা রিনরিনে মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল : _কী গো, এখনো ঘুম ভাঙল না? এই যে সূর্য উঠছে, ফুল ফুটছে, পাখি ডাকছে, অশোক-পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ায় রং ধরেছে, পাতায় পাতায় হিল্লোল, এখনো ঘুমাবে বুঝি? ওঠো, জাগো, দ্বার খুলে বেরিয়ে পড়ো!
ভালো করে চোখ মেলতেই দেখি, দেবদূতের মতো কে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। স্পষ্ট নয়_আবছা আবছা। তাঁর গুচ্ছ গুচ্ছ চুল, শ্মশ্রুমণ্ডিত সৌম্যমূর্তি অনেকটা যেন আমার দাদুর মতো! না না, কিছুটা যেন যিশুখ্রিস্টের মতো। গৌতম বুদ্ধের মতো কি? নাহ্! গৌতম বুদ্ধের তো দাড়ি নেই! তবে কে? কে? আমি এবার শুধালাম_তুমি কে গো? তোমায় তো আমি ঠিক চিনতে পারছি না!
_আমার নাম রবীন্দ্রনাথ। কাছের মানুষেরা ডাকে রবি বলে।
_ হ্যাঁ গো, হ্যাঁ! এবার ঠিক চিনতে পেরেছি। আমি তোমার অনেক লেখা পড়েছি। আমার পড়ার বইতে তোমার ছবিও আছে। কিন্তু সে যেন একটু অন্যরকম। একটু বেশি বুড়ো, কপালে আর ভ্রূর মাঝখানে ভাঁজ! তোমার তো তা নেই!
_হুম্, তাই তো। ছবিতে কপালে, ভ্রূর মাঝখানে ভাঁজ, এখন তা নেই! কী জানো তো, আমি যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখি বা ভাবি, তখন আমার ভ্রূর মাঝখানে ভাঁজ পড়ে। এখন তো আমি তোমার সঙ্গে খুশিখুশি কথা বলছি, আনন্দে মেতে আছি, বেশ ঝরঝরে ফুরফুরে চিন্তা ভাবনাহীন! সে জন্য আমার কপালে আর ভ্রূর মাঝখানে ভাঁজ নেই। আর যাঁরা আমার ওই ছবিটা ক্যামেরায় তুলেছেন বা এঁকেছেন, তাঁরা হয়তো চিন্তাশীল গুরুগম্ভীর রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন। সে যা-ই হোক, এবার তুমি ওঠো; চলো, বাইরে চলো।
_কোথায় যাব আমরা?
_বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে-সমুদ্রে ঘুরে বেড়াব আমরা। যেখানে আকাশের শেষ নীল মিশে গেছে পৃথিবীর শেষ সবুজে সেখানে যাব।
_বাহ! সে বেশ মজা হবে। আচ্ছা, আমি তোমায় কী বলে ডাকব?
_কেন, বন্ধু!
_ওমা, আমি তো অনেক ছোটো।
_তাতে কী? ছোটো-বড়োয় বুঝি বন্ধুত্ব হয় না? আমি তো ঈশ্বরকেও বন্ধু বলে ডাকি। আমার বন্ধুরা তো সব প্রায় তোমারই মতো। ছোটোদের মধ্যেই তো ঈশ্বর বাস করেন। কারণ, তাঁরা খাঁটি। তাঁদের মধ্যে বিষয়বুদ্ধি নেই, ভেদবুদ্ধি নেই, তাঁরা হিসেবী নয়। কী, কথাটা মনে ধরল না বুঝি? আমাকে তোমার বন্ধু বানাতে বুঝি মোটেও ইচ্ছে করছে না?
_না-না, খুব ইচ্ছে করছে। তোমাকে তো বন্ধুই মনে হচ্ছে! আচ্ছা, ওই যে দূরে কয়েকটা তালগাছ দাঁড়িয়ে আকাশে উঁকি মারছে, আর তার পাশ দিয়ে একটা ছোট নদী চলে গেছে এঁকেবেঁকে_ওখানে যাবে?
_হ্যাঁ-হ্যাঁ, চলো!
_জানো, তোমার ওই তালগাছ কবিতার মতো আমারও আকাশে ওই তারাদের দেশে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে।
-হ্যাঁ, তা তো করবেই! সব ভাবুক মানুষেরই নানা রকম ইচ্ছে করে। আর সব মানুষই কম-বেশি ভাবুক। সবাই তার ইচ্ছে-ডানা মেলে দিয়ে যেখানে খুশি সেখানে চলে যেতে পারে!
_তোমার সেই গানের মতো? 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে/মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা মনে মনে।'
_ঠিক তাই।
_আচ্ছা বন্ধু, তোমার কী হতে ইচ্ছে করে?
_অনেক কিছু হতে ইচ্ছে করে। এক এক সময় এক একটা। কখনো খেয়াঘাটের মাঝি, কখনো চুড়িওয়ালা, কখনো ঢেউ, কখনো চাঁপাফুল, কখনো ইচ্ছামতী নদী, একতারা হাতে বাউল, রাজমিস্ত্রি, ফুলবাগানের মালি, পাহারাওয়ালা, দইওয়ালা...
_অমলের মতো?
_হ্যাঁ, অমলের মতো। জানো তো, আমিও ছোটবেলায় অমলেরই মতো বন্দি ছিলাম। পরিচারকদের মহলে দক্ষিণপূর্ব ঘরেই আমাদের দিন কাটত। সেই ঘরের দক্ষিণের জানালার ওই পারেই ছিল আমার পৃথিবী। সেখান থেকে আকাশ দেখতাম, পুকুরের কালো জলে গাছপালার ছায়া, প্রতিবেশীদের স্নানের ভঙ্গি; কেউ নাক চেপে টুপ করে ডুব দিয়ে ওঠে, কেউ গলা জলে দাঁড়িয়ে মন্ত্রপাঠ করে, কেউ সাঁতার কাটে। শুনতাম পাতার শব্দ, ফেরিওয়ালাদের ফেরি করার নানা রকম সুর_চুড়ি চা-ই চুড়ি, তোপ্সে মাছ নেবে গো, তো... পসে মাছ! চৈত্র-বৈশাখ মাসে বরফওয়ালা হেঁকে যেত 'বরীফ'। ফুলওয়ালা ঝুড়ি ভরতি বেলফুলের মালা নিয়ে কী সুন্দর করে যে ডাকত_'ফুল নেবে ফুল, বেলফুল, জুঁঁইফুল চম্পা, চামেলি_' রাস্তার দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ডাক শুনে মন কেমন উথাল-পাথাল করে উঠত। মনে হতো ওরা কতো স্বাধীন, ওরা কতো সুখী! সে কথা মনে করেই অনেক পরে লিখেছিলুম, খাঁচার পাখি আর বনের পাখি নিয়ে কবিতা 'দুই পাখি'।
_জানো, আমাদের পাড়াতেও অনেক ফেরিওয়ালা খুব সুন্দর সুর করে ডেকে যায়। 'মালাই কুল্ফি বরফ', শাড়ি কাপ...ড়, লেইস ফি...তা, অবাক জলপান ঘুগ্নি দা...না! আর সবচেয়ে সুন্দর করে যে ফেরি করে সে হলো বাবুল বিস্কুটের ফেরিওয়ালা। তার গোলগোল চশমা, শাদা-শাদা দাড়ি। হাতে টিনের বাঙ্ ভর্তি বিস্কুট। সে গান গেয়ে বলে :
রস পড়ে টস্টস্
বাবুল বিস্কুট!
দাঁতে কাটে কুট্কুট্
বাবুল বিস্কুট!
ছেলে খায়, মেয়ে খায়,
বুড়ো খায়, বুড়ি খায়,
সকলেই আরো চায়!
রস পড়ে টস্টস্
বাবুল বিস্কুট
দাঁতে কাটে কুট্কুট্
বাবুল বিস্কুট।
-বাহ্ব্বা! এ তো ভারি সুন্দর! তোমার বাবুল বিস্কুটওয়ালা তো আমার সব ফেরিওয়ালাকেই হার মানিয়ে দিল গো মেয়ে! আর যেন কী বললে? গোলগোল চশমা, শাদা-শাদা দাড়ি! সে কি আমিই নাকি গো? আমার তো এখন বাবুল বিস্কুটওয়ালা হবারই ইচ্ছে হচ্ছে!
_ঠিক আছে, ঠিক আছে; তুমি বাবুল বিস্কুটওয়ালা হও, কিংবা ঠ্যালাগাড়িওয়ালা হও, জমিদার হও, কুলি হও, রিকশাওয়ালা হও, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা গুরু, যা খুশি হও। এবার বলো, তুমি টাইম মেশিনের কথা শুনেছ কি না!
_ওমা, টাইম মেশিনের কথা কে না শুনেছে! আরে পাগলি, আমি তো টাইম মেশিনে চড়েই তোর এখানে এসেছি।
_সত্যি বলছ?
_এক্কেবারে সত্যি। চুপিচুপি একটা কথা বলি শোন। সবার মনের ভেতরেই একটা টাইম মেশিন আছে। ওটা শুধু চালাতে জানতে হয়। আমি চালাতে শিখেছি। তোকেও শিখিয়ে দেব। চল্ টাইম মেশিনে করে একটু ঘুরে আসি। তুই আমার হাত ধরে থাক। যখন চোখে খুলতে বলব, তখন চোখ খুলবি।
_ও বন্ধু! আমার তো কেমন ভয় করছে! চোখ খুলব?
_এ-ই, এখন খোল।
_ইস্! দেরি হয়ে গেল। চলো, চলো, বন্ধু পা চালিয়ে এসো। চলো আমরা মঞ্চের ওই কোণে গিয়ে বসি। গত চবি্বশ বছর পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার আমাদের শোষণ করেছে, বঞ্চনা করেছে। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এবার রাস্তায় নেমেছি, স্বাধীনতা_বিজয়_মুক্তি না নিয়ে ফিরব না। 'জাগো জাগো বাঙালি জাগো', 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।' 'বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ' আজকে সারারাত গান গাইবে_'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো', 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি', 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা', 'নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়', 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী', 'সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে', 'একবার তোরা মা বলিয়া ডাক, জগৎজনের শ্রবণ জুড়াক', 'যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা', 'বাঁধ ভেঙে দাও', 'চলো যাই, চলো যাই, চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে' তোমার লেখা এমন ২৫-৩০টা গান আমরা এই অসহযোগ আন্দোলনে প্রতিদিন গাইছি, বিভিন্ন স্থানে মঞ্চ বানিয়ে। কাজী নজরুল ইসলামের 'কারার ঐ লৌহ কপাট', 'এই শিকল পরা ছল' 'বলো ভাই মাভৈ: মাভৈ:', 'দুর্গমগিরি-কান্তার মরু'_এই গানগুলোও আমরা প্রতিদিন গাই।
_কাজীর এই গানগুলো যে কী দুর্দান্ত হয়েছে না! আমার এই বুড়ো হাড়েও নাচন লাগিয়ে দেয়। আমি ওর গানের ভীষণ ভক্ত। ছেলেটার ভেতরের তেজ, দেশপ্রেম আর মানবতাবোধ এই গানগুলোর মধ্যে একই সঙ্গে অকৃত্রিমভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। সে জন্যই ওকে আমার 'বসন্ত' গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি। কাজীও আমাকে খুব ভালোবাসে। ওর কোনো কিছুতে কোনো কৃত্রিমতা নেই।
_জানো, গাত পরশু দিন অর্থাৎ ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা তোলা হয়েছিল প্রায় সবখানে। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' আর 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে'_গান দুটো আমরা বারবার গেয়েছি।
_জানি তো! তোরা সবাই যে আমাকে আর আমার গানকে ভীষণ ভালোবাসিস, সেটা আমি জানি। এটা তো আমারই দেশ রে! আমার সব সৃষ্টির উৎসস্থল। এই দেশের সহজ-সরল মানুষগুলোকে বাইরের দস্যুরা ঠকায়, লুণ্ঠন করে এ আমার প্রাণে সয় না। তোরা এই প্রজন্মের মানুষেরা দেশ স্বাধীন করে যেন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকিস না। ফুলে-ফসলে সুন্দর করে গড়ে তুলিস। কিন্তু আজ কেমন যেন একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। একটা ভয়ংকর বিষাক্ত সাপ যেন ফণা তুলে ধেয়ে আসছে, সমস্ত আকাশটা যেন কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, প্রচণ্ড প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের আভাস পাচ্ছি আমি। চল ঘরে ফিরে চল। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। সাহস হারাস্নে। সামনে অনেক কাজ। 'এই কথাটা ধরেই রাখিস, মুক্তি তোকে পেতেই হবে।'
_উহ্! প্রলয় শুরু হলো নাকি? সবাই এমন ছুটছে কেন? আকাশটা কি ভেঙে পড়বে?
হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসেছি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। এবার প্রস্তুত হতে হবে। বৃষ্টি থামতেই ঝকঝকে রোদ। আকাশে-বাতাসে সুর ভাসছে_
'হে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ,
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন।'
আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্ধশততম রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালন করা হবে।
সবাই যেন শিক্ষা পায়, চিকিৎসা পায়, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান পায়, সে দিকে তোরা নতুন প্রজন্মের মানুষেরা খেয়াল রাখিস। তরুণরা সব পারে।
ভালো করে চোখ মেলতেই দেখি, দেবদূতের মতো কে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। স্পষ্ট নয়_আবছা আবছা। তাঁর গুচ্ছ গুচ্ছ চুল, শ্মশ্রুমণ্ডিত সৌম্যমূর্তি অনেকটা যেন আমার দাদুর মতো! না না, কিছুটা যেন যিশুখ্রিস্টের মতো। গৌতম বুদ্ধের মতো কি? নাহ্! গৌতম বুদ্ধের তো দাড়ি নেই! তবে কে? কে? আমি এবার শুধালাম_তুমি কে গো? তোমায় তো আমি ঠিক চিনতে পারছি না!
_আমার নাম রবীন্দ্রনাথ। কাছের মানুষেরা ডাকে রবি বলে।
_ হ্যাঁ গো, হ্যাঁ! এবার ঠিক চিনতে পেরেছি। আমি তোমার অনেক লেখা পড়েছি। আমার পড়ার বইতে তোমার ছবিও আছে। কিন্তু সে যেন একটু অন্যরকম। একটু বেশি বুড়ো, কপালে আর ভ্রূর মাঝখানে ভাঁজ! তোমার তো তা নেই!
_হুম্, তাই তো। ছবিতে কপালে, ভ্রূর মাঝখানে ভাঁজ, এখন তা নেই! কী জানো তো, আমি যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখি বা ভাবি, তখন আমার ভ্রূর মাঝখানে ভাঁজ পড়ে। এখন তো আমি তোমার সঙ্গে খুশিখুশি কথা বলছি, আনন্দে মেতে আছি, বেশ ঝরঝরে ফুরফুরে চিন্তা ভাবনাহীন! সে জন্য আমার কপালে আর ভ্রূর মাঝখানে ভাঁজ নেই। আর যাঁরা আমার ওই ছবিটা ক্যামেরায় তুলেছেন বা এঁকেছেন, তাঁরা হয়তো চিন্তাশীল গুরুগম্ভীর রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন। সে যা-ই হোক, এবার তুমি ওঠো; চলো, বাইরে চলো।
_কোথায় যাব আমরা?
_বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে-সমুদ্রে ঘুরে বেড়াব আমরা। যেখানে আকাশের শেষ নীল মিশে গেছে পৃথিবীর শেষ সবুজে সেখানে যাব।
_বাহ! সে বেশ মজা হবে। আচ্ছা, আমি তোমায় কী বলে ডাকব?
_কেন, বন্ধু!
_ওমা, আমি তো অনেক ছোটো।
_তাতে কী? ছোটো-বড়োয় বুঝি বন্ধুত্ব হয় না? আমি তো ঈশ্বরকেও বন্ধু বলে ডাকি। আমার বন্ধুরা তো সব প্রায় তোমারই মতো। ছোটোদের মধ্যেই তো ঈশ্বর বাস করেন। কারণ, তাঁরা খাঁটি। তাঁদের মধ্যে বিষয়বুদ্ধি নেই, ভেদবুদ্ধি নেই, তাঁরা হিসেবী নয়। কী, কথাটা মনে ধরল না বুঝি? আমাকে তোমার বন্ধু বানাতে বুঝি মোটেও ইচ্ছে করছে না?
_না-না, খুব ইচ্ছে করছে। তোমাকে তো বন্ধুই মনে হচ্ছে! আচ্ছা, ওই যে দূরে কয়েকটা তালগাছ দাঁড়িয়ে আকাশে উঁকি মারছে, আর তার পাশ দিয়ে একটা ছোট নদী চলে গেছে এঁকেবেঁকে_ওখানে যাবে?
_হ্যাঁ-হ্যাঁ, চলো!
_জানো, তোমার ওই তালগাছ কবিতার মতো আমারও আকাশে ওই তারাদের দেশে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে।
-হ্যাঁ, তা তো করবেই! সব ভাবুক মানুষেরই নানা রকম ইচ্ছে করে। আর সব মানুষই কম-বেশি ভাবুক। সবাই তার ইচ্ছে-ডানা মেলে দিয়ে যেখানে খুশি সেখানে চলে যেতে পারে!
_তোমার সেই গানের মতো? 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে/মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা মনে মনে।'
_ঠিক তাই।
_আচ্ছা বন্ধু, তোমার কী হতে ইচ্ছে করে?
_অনেক কিছু হতে ইচ্ছে করে। এক এক সময় এক একটা। কখনো খেয়াঘাটের মাঝি, কখনো চুড়িওয়ালা, কখনো ঢেউ, কখনো চাঁপাফুল, কখনো ইচ্ছামতী নদী, একতারা হাতে বাউল, রাজমিস্ত্রি, ফুলবাগানের মালি, পাহারাওয়ালা, দইওয়ালা...
_অমলের মতো?
_হ্যাঁ, অমলের মতো। জানো তো, আমিও ছোটবেলায় অমলেরই মতো বন্দি ছিলাম। পরিচারকদের মহলে দক্ষিণপূর্ব ঘরেই আমাদের দিন কাটত। সেই ঘরের দক্ষিণের জানালার ওই পারেই ছিল আমার পৃথিবী। সেখান থেকে আকাশ দেখতাম, পুকুরের কালো জলে গাছপালার ছায়া, প্রতিবেশীদের স্নানের ভঙ্গি; কেউ নাক চেপে টুপ করে ডুব দিয়ে ওঠে, কেউ গলা জলে দাঁড়িয়ে মন্ত্রপাঠ করে, কেউ সাঁতার কাটে। শুনতাম পাতার শব্দ, ফেরিওয়ালাদের ফেরি করার নানা রকম সুর_চুড়ি চা-ই চুড়ি, তোপ্সে মাছ নেবে গো, তো... পসে মাছ! চৈত্র-বৈশাখ মাসে বরফওয়ালা হেঁকে যেত 'বরীফ'। ফুলওয়ালা ঝুড়ি ভরতি বেলফুলের মালা নিয়ে কী সুন্দর করে যে ডাকত_'ফুল নেবে ফুল, বেলফুল, জুঁঁইফুল চম্পা, চামেলি_' রাস্তার দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ডাক শুনে মন কেমন উথাল-পাথাল করে উঠত। মনে হতো ওরা কতো স্বাধীন, ওরা কতো সুখী! সে কথা মনে করেই অনেক পরে লিখেছিলুম, খাঁচার পাখি আর বনের পাখি নিয়ে কবিতা 'দুই পাখি'।
_জানো, আমাদের পাড়াতেও অনেক ফেরিওয়ালা খুব সুন্দর সুর করে ডেকে যায়। 'মালাই কুল্ফি বরফ', শাড়ি কাপ...ড়, লেইস ফি...তা, অবাক জলপান ঘুগ্নি দা...না! আর সবচেয়ে সুন্দর করে যে ফেরি করে সে হলো বাবুল বিস্কুটের ফেরিওয়ালা। তার গোলগোল চশমা, শাদা-শাদা দাড়ি। হাতে টিনের বাঙ্ ভর্তি বিস্কুট। সে গান গেয়ে বলে :
রস পড়ে টস্টস্
বাবুল বিস্কুট!
দাঁতে কাটে কুট্কুট্
বাবুল বিস্কুট!
ছেলে খায়, মেয়ে খায়,
বুড়ো খায়, বুড়ি খায়,
সকলেই আরো চায়!
রস পড়ে টস্টস্
বাবুল বিস্কুট
দাঁতে কাটে কুট্কুট্
বাবুল বিস্কুট।
-বাহ্ব্বা! এ তো ভারি সুন্দর! তোমার বাবুল বিস্কুটওয়ালা তো আমার সব ফেরিওয়ালাকেই হার মানিয়ে দিল গো মেয়ে! আর যেন কী বললে? গোলগোল চশমা, শাদা-শাদা দাড়ি! সে কি আমিই নাকি গো? আমার তো এখন বাবুল বিস্কুটওয়ালা হবারই ইচ্ছে হচ্ছে!
_ঠিক আছে, ঠিক আছে; তুমি বাবুল বিস্কুটওয়ালা হও, কিংবা ঠ্যালাগাড়িওয়ালা হও, জমিদার হও, কুলি হও, রিকশাওয়ালা হও, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা গুরু, যা খুশি হও। এবার বলো, তুমি টাইম মেশিনের কথা শুনেছ কি না!
_ওমা, টাইম মেশিনের কথা কে না শুনেছে! আরে পাগলি, আমি তো টাইম মেশিনে চড়েই তোর এখানে এসেছি।
_সত্যি বলছ?
_এক্কেবারে সত্যি। চুপিচুপি একটা কথা বলি শোন। সবার মনের ভেতরেই একটা টাইম মেশিন আছে। ওটা শুধু চালাতে জানতে হয়। আমি চালাতে শিখেছি। তোকেও শিখিয়ে দেব। চল্ টাইম মেশিনে করে একটু ঘুরে আসি। তুই আমার হাত ধরে থাক। যখন চোখে খুলতে বলব, তখন চোখ খুলবি।
_ও বন্ধু! আমার তো কেমন ভয় করছে! চোখ খুলব?
_এ-ই, এখন খোল।
_ইস্! দেরি হয়ে গেল। চলো, চলো, বন্ধু পা চালিয়ে এসো। চলো আমরা মঞ্চের ওই কোণে গিয়ে বসি। গত চবি্বশ বছর পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার আমাদের শোষণ করেছে, বঞ্চনা করেছে। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এবার রাস্তায় নেমেছি, স্বাধীনতা_বিজয়_মুক্তি না নিয়ে ফিরব না। 'জাগো জাগো বাঙালি জাগো', 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।' 'বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ' আজকে সারারাত গান গাইবে_'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো', 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি', 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা', 'নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়', 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী', 'সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে', 'একবার তোরা মা বলিয়া ডাক, জগৎজনের শ্রবণ জুড়াক', 'যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা', 'বাঁধ ভেঙে দাও', 'চলো যাই, চলো যাই, চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে' তোমার লেখা এমন ২৫-৩০টা গান আমরা এই অসহযোগ আন্দোলনে প্রতিদিন গাইছি, বিভিন্ন স্থানে মঞ্চ বানিয়ে। কাজী নজরুল ইসলামের 'কারার ঐ লৌহ কপাট', 'এই শিকল পরা ছল' 'বলো ভাই মাভৈ: মাভৈ:', 'দুর্গমগিরি-কান্তার মরু'_এই গানগুলোও আমরা প্রতিদিন গাই।
_কাজীর এই গানগুলো যে কী দুর্দান্ত হয়েছে না! আমার এই বুড়ো হাড়েও নাচন লাগিয়ে দেয়। আমি ওর গানের ভীষণ ভক্ত। ছেলেটার ভেতরের তেজ, দেশপ্রেম আর মানবতাবোধ এই গানগুলোর মধ্যে একই সঙ্গে অকৃত্রিমভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। সে জন্যই ওকে আমার 'বসন্ত' গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি। কাজীও আমাকে খুব ভালোবাসে। ওর কোনো কিছুতে কোনো কৃত্রিমতা নেই।
_জানো, গাত পরশু দিন অর্থাৎ ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা তোলা হয়েছিল প্রায় সবখানে। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' আর 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে'_গান দুটো আমরা বারবার গেয়েছি।
_জানি তো! তোরা সবাই যে আমাকে আর আমার গানকে ভীষণ ভালোবাসিস, সেটা আমি জানি। এটা তো আমারই দেশ রে! আমার সব সৃষ্টির উৎসস্থল। এই দেশের সহজ-সরল মানুষগুলোকে বাইরের দস্যুরা ঠকায়, লুণ্ঠন করে এ আমার প্রাণে সয় না। তোরা এই প্রজন্মের মানুষেরা দেশ স্বাধীন করে যেন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকিস না। ফুলে-ফসলে সুন্দর করে গড়ে তুলিস। কিন্তু আজ কেমন যেন একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। একটা ভয়ংকর বিষাক্ত সাপ যেন ফণা তুলে ধেয়ে আসছে, সমস্ত আকাশটা যেন কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, প্রচণ্ড প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের আভাস পাচ্ছি আমি। চল ঘরে ফিরে চল। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। সাহস হারাস্নে। সামনে অনেক কাজ। 'এই কথাটা ধরেই রাখিস, মুক্তি তোকে পেতেই হবে।'
_উহ্! প্রলয় শুরু হলো নাকি? সবাই এমন ছুটছে কেন? আকাশটা কি ভেঙে পড়বে?
হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসেছি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। এবার প্রস্তুত হতে হবে। বৃষ্টি থামতেই ঝকঝকে রোদ। আকাশে-বাতাসে সুর ভাসছে_
'হে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ,
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন।'
আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্ধশততম রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালন করা হবে।
সবাই যেন শিক্ষা পায়, চিকিৎসা পায়, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান পায়, সে দিকে তোরা নতুন প্রজন্মের মানুষেরা খেয়াল রাখিস। তরুণরা সব পারে।
No comments