দেশহীন মানুষের কথা-গারো, সাঁওতাল, চাকমা কি বাঙালি? by সঞ্জীব দ্রং
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ৯ আগস্ট ‘কারও মনে দুখ দিয়ো না’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছেন। কলামের শেষ অংশে ওমর খৈয়ামের কবিতার একটি লাইন লিখেছেন, ‘কারও মনে দুখ দিয়ো না, করো বরং হাজার পাপ—।’ লেখাটি পড়ার পর আমার স্ত্রী মিতালী চিসিম বললেন, ‘স্যারকে মেসেজ পাঠাও।’ আমি তখনই মোবাইলে মেসেজ পাঠালাম।
তাতে লিখলাম, ‘প্রিয় স্যার, আজ আদিবাসী দিবস। আপনার লেখা মন ভরে পড়লাম। এখন শহীদ মিনারে আছি। এখানে বৃষ্টিভেজা সকালে হাজারো আদিবাসী মানুষ, সরকার কেন মানুষকে এত কষ্ট দেয়? পরম করুণাময় আপনাকে আশীর্বাদ করুন।’ জাফর ইকবাল স্যার কি জানেন, নতুন সংবিধানে কী লেখা আছে আদিবাসীদের সম্পর্কে।
গত ৩০ জুন থেকে গারো, সাঁওতাল, মণিপুরি, খাসি, চাকমা, ত্রিপুরা—সবাই ‘বাঙালি’। সংবিধানের ৬(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ একজন গারো কি বাঙালি? চাকমা কি বাঙালি? সাঁওতাল কি বাঙালি? ওই ম্রো কি বাঙালি? জাফর ইকবাল স্যার বান্দরবানে তাঁর শৈশবে শঙ্খ নদের তীরে যাঁদের সঙ্গে মিশেছেন, তাঁরা কি বাঙালি? স্যার লিখেছেন, ‘শুধু ভাষা নয়, তাদের গায়ের রং, মুখের ছাপ, পোশাক, আচার-আচরণ সেগুলোও ভিন্ন ছিল, কিন্তু সেই শৈশবে আমি নিজের মতো করে আবিষ্কার করেছিলাম, এই ভিন্নতাটুকুই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বড় হয়ে বুঝেছি, বৈচিত্র্যটাই হচ্ছে সৌন্দর্য।’
এই ধরিত্রী সুন্দর। কারণ, এখানকার ৯০টি দেশে প্রায় ৩৭ কোটি আদিবাসী মানুষ আছে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘আমরা আদিবাসীদের অধিকার এবং সবার জন্য সমতা, ন্যায়বিচার ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে আমাদের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করছি। আদিবাসী জনগোষ্ঠী অসাধারণ বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব করে। পাঁচ হাজার স্বতন্ত্র জাতিতে বিভক্ত এই জনগোষ্ঠী বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে বসবাস করছে। বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা ৫ ভাগের বেশি এই আদিবাসীদের সংখ্যা আনুমানিক ৩৭ কোটি। তারা একত্রে অত্যন্ত মূল্যবান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, যা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা শিল্পকলা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে তাদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনীর প্রকাশ দেখি।’
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি উন্নয়ন-সহযোগী ও কূটনীতিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নেই; বাঙালিরাই প্রকৃত আদিবাসী।’ আমরা বলেছি, তাঁর ওই বক্তব্য সঠিক নয় এবং গ্রহণযোগ্যও নয়। স্মরণাতীত কাল থেকে এ দেশে আদিবাসীরা তাদের স্বকীয়তা, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরিচয় নিয়ে বসবাস করছে। এই জগতে কে কোথা থেকে প্রথম আবির্ভূত হয়েছে, এটি আদিবাসী বা ইনডিজিনাস পিপলসের মূল কথা নয়। এ জন্যই জাতিসংঘ ইনডিজিনাস পিপলসের কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করেনি এবং আদিবাসীরাও তা চায়নি।
জাতিসংঘ কখনো কোনো সদস্যরাষ্ট্রকে তার দেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ বলা বা না-বলার ক্ষেত্রে কোনো খবরদারি করে না। এটি অবশ্যই রাষ্ট্রের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু সরকার যখন জোর করে ‘আদিবাসীদের’ ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বা ‘উপজাতি’ বলে আখ্যায়িত করে এবং সরকার নিজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘকে বলে আদিবাসী বিষয়ে বা তার নাগরিকদের বিষয়ে কিছু বলার অধিকার বা এখতিয়ার তাদের নেই, তখন সেই রাষ্ট্রে ‘আদিবাসীদের’ প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ ও রাষ্ট্রীয় মনোভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্পষ্ট হয়ে যায়। আর রাষ্ট্র তখন তার নাগরিক বা আদিবাসীদের সঙ্গে কতখানি অমানবিক আচরণ করে, তা নিজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানিয়ে দেয়।
সম্প্রতি সরকার জাতিসংঘ আদিবাসী-বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম এবং জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে (ইকোসক) যে ভূমিকা পালন করেছে, তাতে রাষ্ট্র নিজে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হেয়প্রতিপন্ন হয়েছে এবং ইকোসকের ৫৪টি সদস্যরাষ্ট্র আদিবাসী-বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের প্রতিবেদনকে গ্রহণ করেছে। কেননা, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলে আদিবাসী বা ইনডিজিনাস বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এজেন্ডা। আমরা মনে করি, আত্মপরিচয়ের অধিকার আদিবাসীদের রয়েছে। রাষ্ট্র কোনো জাতির পরিচয় চাপিয়ে দিতে পারে না। আইএলও কনভেনশনের উদ্ধৃতি দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন, যা সঠিক নয়। আইএলও কনভেনশনের মূল কথাই হলো আত্মপরিচয়ের নীতিকে শ্রদ্ধা করা।
সরকারের আচরণে মন খারাপ হলেও আমরা আদিবাসীরা হতাশ নই। মেঘ যত ঘনকালো হোক, তা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অন্ধকারের পর নতুন ভোর হবেই, নতুন সূর্য উঠবেই। আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি দেশ বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির বর্ণময় সম্ভাবনাময় দেশ। একে আমাদের সবাই মিলে গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘ বিশ্বের জন্য যেভাবে আদিবাসীদের বিশাল অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমাদের রাষ্ট্রও একদিন তা করবে। এভাবে একটি মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠবে।
আমার প্রশ্ন, বিশ্বের আদিবাসীদের জন্য জাতিসংঘের দুয়ার যেখানে খোলা, সেখানে আমাদের দেশে আদিবাসীদের জন্য রাষ্ট্রের দুয়ার বন্ধ কেন হবে?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।গত ৩০ জুন থেকে গারো, সাঁওতাল, মণিপুরি, খাসি, চাকমা, ত্রিপুরা—সবাই ‘বাঙালি’। সংবিধানের ৬(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ একজন গারো কি বাঙালি? চাকমা কি বাঙালি? সাঁওতাল কি বাঙালি? ওই ম্রো কি বাঙালি? জাফর ইকবাল স্যার বান্দরবানে তাঁর শৈশবে শঙ্খ নদের তীরে যাঁদের সঙ্গে মিশেছেন, তাঁরা কি বাঙালি? স্যার লিখেছেন, ‘শুধু ভাষা নয়, তাদের গায়ের রং, মুখের ছাপ, পোশাক, আচার-আচরণ সেগুলোও ভিন্ন ছিল, কিন্তু সেই শৈশবে আমি নিজের মতো করে আবিষ্কার করেছিলাম, এই ভিন্নতাটুকুই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বড় হয়ে বুঝেছি, বৈচিত্র্যটাই হচ্ছে সৌন্দর্য।’
এই ধরিত্রী সুন্দর। কারণ, এখানকার ৯০টি দেশে প্রায় ৩৭ কোটি আদিবাসী মানুষ আছে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘আমরা আদিবাসীদের অধিকার এবং সবার জন্য সমতা, ন্যায়বিচার ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে আমাদের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করছি। আদিবাসী জনগোষ্ঠী অসাধারণ বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব করে। পাঁচ হাজার স্বতন্ত্র জাতিতে বিভক্ত এই জনগোষ্ঠী বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে বসবাস করছে। বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা ৫ ভাগের বেশি এই আদিবাসীদের সংখ্যা আনুমানিক ৩৭ কোটি। তারা একত্রে অত্যন্ত মূল্যবান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, যা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা শিল্পকলা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে তাদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনীর প্রকাশ দেখি।’
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি উন্নয়ন-সহযোগী ও কূটনীতিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নেই; বাঙালিরাই প্রকৃত আদিবাসী।’ আমরা বলেছি, তাঁর ওই বক্তব্য সঠিক নয় এবং গ্রহণযোগ্যও নয়। স্মরণাতীত কাল থেকে এ দেশে আদিবাসীরা তাদের স্বকীয়তা, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরিচয় নিয়ে বসবাস করছে। এই জগতে কে কোথা থেকে প্রথম আবির্ভূত হয়েছে, এটি আদিবাসী বা ইনডিজিনাস পিপলসের মূল কথা নয়। এ জন্যই জাতিসংঘ ইনডিজিনাস পিপলসের কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করেনি এবং আদিবাসীরাও তা চায়নি।
জাতিসংঘ কখনো কোনো সদস্যরাষ্ট্রকে তার দেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ বলা বা না-বলার ক্ষেত্রে কোনো খবরদারি করে না। এটি অবশ্যই রাষ্ট্রের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু সরকার যখন জোর করে ‘আদিবাসীদের’ ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বা ‘উপজাতি’ বলে আখ্যায়িত করে এবং সরকার নিজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘকে বলে আদিবাসী বিষয়ে বা তার নাগরিকদের বিষয়ে কিছু বলার অধিকার বা এখতিয়ার তাদের নেই, তখন সেই রাষ্ট্রে ‘আদিবাসীদের’ প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ ও রাষ্ট্রীয় মনোভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্পষ্ট হয়ে যায়। আর রাষ্ট্র তখন তার নাগরিক বা আদিবাসীদের সঙ্গে কতখানি অমানবিক আচরণ করে, তা নিজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানিয়ে দেয়।
সম্প্রতি সরকার জাতিসংঘ আদিবাসী-বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম এবং জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে (ইকোসক) যে ভূমিকা পালন করেছে, তাতে রাষ্ট্র নিজে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হেয়প্রতিপন্ন হয়েছে এবং ইকোসকের ৫৪টি সদস্যরাষ্ট্র আদিবাসী-বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের প্রতিবেদনকে গ্রহণ করেছে। কেননা, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলে আদিবাসী বা ইনডিজিনাস বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এজেন্ডা। আমরা মনে করি, আত্মপরিচয়ের অধিকার আদিবাসীদের রয়েছে। রাষ্ট্র কোনো জাতির পরিচয় চাপিয়ে দিতে পারে না। আইএলও কনভেনশনের উদ্ধৃতি দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন, যা সঠিক নয়। আইএলও কনভেনশনের মূল কথাই হলো আত্মপরিচয়ের নীতিকে শ্রদ্ধা করা।
সরকারের আচরণে মন খারাপ হলেও আমরা আদিবাসীরা হতাশ নই। মেঘ যত ঘনকালো হোক, তা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অন্ধকারের পর নতুন ভোর হবেই, নতুন সূর্য উঠবেই। আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি দেশ বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির বর্ণময় সম্ভাবনাময় দেশ। একে আমাদের সবাই মিলে গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘ বিশ্বের জন্য যেভাবে আদিবাসীদের বিশাল অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমাদের রাষ্ট্রও একদিন তা করবে। এভাবে একটি মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠবে।
আমার প্রশ্ন, বিশ্বের আদিবাসীদের জন্য জাতিসংঘের দুয়ার যেখানে খোলা, সেখানে আমাদের দেশে আদিবাসীদের জন্য রাষ্ট্রের দুয়ার বন্ধ কেন হবে?
sanjeebdrong@gmail.com
No comments