রবীন্দ্রনাথের কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় ভাবনা by শাইখ সিরাজ

রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে কবিতা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে ছবি, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প ও গান। সাদা দাড়ির অদ্ভুত এই মুখচ্ছবি আমাদের কাছে শিল্প আর সংস্কৃতির এক বটবৃক্ষ। রবীন্দ্রনাথ মানে বাঙালি। যুগ যুগ ধরে বাঙালির পরিচয় উজ্জ্বল করে রাখা এক দূত।


এই মানুষটি কোথায় পেয়েছিলেন এতসব শিল্পকর্মের উপকরণ? কিভাবে জীবনের গভীর জায়গাগুলো ছুঁতে পেরেছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের একজন উত্তরসূরি হয়েও? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একটাই, তা হলো_তিনি ছিলেন মাটি ও প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ একজন মানুষ। এই বন্ধন তাঁকে কখনো নিয়ে গেছে দরিদ্র প্রজাকুলের জীবনসংগ্রামের ভেতর, কখনো এই বাংলার কৃষকদের ভালোমন্দের ভাবনায়, কখনো গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিন্তায়, কখনো প্রান্তিক মানুষকে সংগঠিত হয়ে পথ চলার ভাবনায়। আমি, আমরা রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি; শুধু তাঁর সৃষ্টি দেখেছি। এই সৃষ্টির ভেতর যে রবীন্দ্রনাথ, তা জীবিত রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কম কিছু নয়। তার পরও যিনি তাঁর দুই চোখ দিয়ে দেখেছেন জীবিত রবীন্দ্রনাথকে, এমনই একজন ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া ভার। নওগাঁর পতিসরের ফয়েজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন এমনই গর্বিত একজন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এনট্রান্স পাস করেন ১৯৪৯ সালে। সম্ভবত এমন মানুষ আর এই বাংলায় নেই। ২০০৬ সালে নওগাঁর পতিসরে গিয়ে ফয়েজউদ্দিন আহমেদের দেখা পাই। তিনি শুধু রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখেনইনি, পা ছুঁয়ে সালামও করেছিলেন। ফয়েজউদ্দিন বার্ধক্যজনিত কারণেই গত বছর মৃত্যুবরণ করেন। এই ফয়েজউদ্দিনের সঙ্গে কৃষি উন্নয়নের নায়ক রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক একটি ইতিহাস যুক্ত। তা হচ্ছে ফয়েজউদ্দিনের বাবা রবীন্দ্রনাথের আনা এই বাংলার প্রথম কলের লাঙলটির চালক ছিলেন।
আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগেই রবীন্দ্রনাথ বাংলার কৃষকের মুক্তি চেয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টই দেখেছিলেন, ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া প্রান্তিক মানুষ কোনোভাবেই পারবে না এগিয়ে যেতে। ভেবেছিলেন যান্ত্রিক কৃষির কথা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির কথা। কৃষিতে মান্ধাতার আমলের চিন্তাচেতনা কোনোভাবেই যে কৃষককে এগিয়ে নিতে পারবে না_এই ভাবনা ছিল তাঁর চিন্তাচেতনার বড় অংশজুড়ে। যে বিষয়গুলো বিচ্ছিন্নভাবে গবেষকদের চিন্তাভাবনা ও গবেষণায় উঠে এলেও সত্যিকার অর্থে রবীন্দ্রনাথের এই পরিচয় এখনো বেশির ভাগ মানুষেরই অজানা। আজ আমরা যে বিশ্বায়নের ভাবনা ভাবছি, স্থানীয় সরকার উন্নয়নের কথা বলছি, কৃষকের সংগঠিত শক্তির কথা বলছি_সব কিছুই উৎসারিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সন্তান রথীন্দ্রনাথ রায় ও বন্ধুর ছেলে সন্তোষ চন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকা থেকে কৃষি ও গোষ্ঠবিদ্যা পড়িয়ে এনে ওখানে গ্রাম উন্নয়নের কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। পতিসরে এনেছিলেন কলের লাঙল। বাংলার কৃষি উৎপাদন তথা খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে এবং কৃষিকে নিষ্কণ্টক করতে তাঁর ছিল বহুমুখী তৎপরতা। এই বাংলাদেশ সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের সবচেয়ে সোনালি অধ্যায়, একইভাবে গ্রাম উন্নয়ন, সমবায়, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রান্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংগঠনিক চেতনা_সব ক্ষেত্রেই হাতে-কলমে পরীক্ষাভূমি ছিল এটিই। বিশেষ করে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি এবং এর সংলগ্ন এলাকা, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর ও শ্বশুরালয় খুলনার দক্ষিণ ডিহি। এসব এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে এখনো রবীন্দ্রনাথ এক অন্য মানুষ। শুধু কবি নন, একজন প্রজাদরদি জমিদার, উন্নয়নের এক পথপ্রদর্শক, একজন দার্শনিক, একজন সংগঠক ও একজন প্রকৃত নেতা। আমি ২০০৫ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের কৃষি, সমবায়, পল্লী উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটু খোঁজখবর করার জন্য একাধিকবার শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরে গেছি। সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। দেখেছি, অনেক কৃষকও পূর্বপুরুষের মুখে এক প্রজাদরদি জমিদারের কথা শুনেছেন_যিনি কৃষকের, জেলের, কামারের, কুমারের জীবনকে উন্নত করার জন্য ছিলেন দারুণ আন্তরিক। রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে ১৯২২ সালে তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন-ভাবনাপল্লী-পুনর্গঠন কর্মকাণ্ডকে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি সেখানকার কুঠিবাড়িতে শুরু হয় তাঁর ইনস্টিটিউট অব রুরাল রিকনস্ট্রাকশনের কাজ। রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'আমার জীবনের যে দুটি সাধনা, এখানে হয়তো তার একটি সফল হবে। কবে হবে, কেমন করে হবে, তখন তা জানতুম না। অনুর্বর ক্ষেত্রেও বীজ পড়লে দেখা যায় হঠাৎ একটি অঙ্কুর বেরিয়েছে, কোনো শুভলগ্নে। কিন্তু তখন তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সব জিনিসেরই তখন অভাব। তারপর, আস্তে আস্তে বীজ অঙ্কুরিত হতে চলল।' শ্রীনিকেতনে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হলো। তাঁর পল্লী উন্নয়নের উদ্যোগ-কল্পনা একটু একটু করে আকার পেতে লাগল। শান্তিনিকেতন থেকে মাইল দুয়েক দূরে সুরুলে এই শ্রীনিকেতন। তাঁর জীবনের যে দুটি সাধনার কথা তিনি বলেছেন, তার একটির কেন্দ্র শান্তিনিকেতন; অন্যটির শ্রীনিকেতন। যেখানকার অনেক ইতিহাস, অনেক ঘটনা, অনেক সম্ভাবনা পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্র গবেষকদের কাছে আজও এক জীবন্ত আখ্যান। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন নিয়েই ছিল রবীন্দ্রনাথের সব সময়ের চিন্তা। একদিকে শিক্ষায় মনের মুক্তি খোঁজা, অন্যদিকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে উপেক্ষিত পল্লীবাসীর উদ্ধারের পথ অনুসন্ধান। শুধুই চিন্তার ছক কেটে নয়, একেবারে হাতে-কলমে। একরকম নিজের সর্বস্ব পণ করেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন।
শ্রীনিকেতন রবীন্দ্রনাথের জন্য একপর্যায়ে হয়ে দাঁড়ায় দারুণ বিশ্বাসের এক জায়গা। তিনি কী করতে চান, কতটা পারেন, কিভাবে পারেন_এসবের প্রাথমিক উপলব্ধি একটা আকার পায় ওই পতিসর-শিলাইদহের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। একে বলা যেতে পারে পাইলট প্রজেক্ট। ষাট বিঘার মতো ছিল শ্রীনিকেতনের খামারের আয়তন। সেচের জন্য ছিল মাঝখানে বড় একটা দিঘি। গতানুগতিক ফসলের বাইরে শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদনেও নজর দেন তিনি। নজর দেন উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু পালনে। সেই সঙ্গে জমির উর্বরতা যাতে না কমে, সেদিকেও খেয়াল রাখেন। সার, বীজ_এসবের সুষ্ঠু ব্যবহারে, আর উপযুক্ত সেচে কৃষিতে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন বাড়ানোর কৌশলও হাতে-কলমে শেখানো হয় কৃষকদের। আদর্শ খামার গড়ে আশপাশের গ্রামবাসীকে ডেকে এনে তাদের তা দেখান। নতুন জ্ঞান তাদের ভেতর ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। আর রবীন্দ্রনাথ যাঁকে এই কাজগুলো করার জন্য নিয়োগ করেছিলেন, তিনি কৃষি অর্থনীতিবিদ ব্রিটিশ যুবক লিওনার্দো এল্মহার্স্ট। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় বিশ্বভারতী-শ্রীনিকেতন উদ্যোগে অর্থ সংগ্রহের আশায় দেশে-বিদেশে হন্যে হয়ে ছুটেছেন। অনেক ব্রিটিশ নাগরিককে রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে এনে যখন তাঁর পরিকল্পনার কথা শোনান, অনেকেই প্রাথমিকভাবে মনে করেছিলেন, এটি রীতমতো একটি পাগলামি ছাড়া কিছু নয় এবং ওই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। তাদের ভুল প্রমাণ করে রবীন্দ্রনাথ অল্পদিনেই বিদেশি অর্থসহায়তা জোগাড় করে তাঁর স্বপ্নের আদলেই গড়তে শুরু করেন শ্রীনিকেতন। রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশায়ই শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার দারুণ সাফল্য দেখে গেছেন।
কৃষি ও পল্লীর জনজীবনের উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আজ সভ্যতার এই বিকশিত সময়ে এসেও দারুণ উপযোগী। জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির প্রশ্নে তাঁর দর্শন সত্যিই অভাবনীয়। তিনি বলেছেন, 'কোনোমতে খেয়ে-পরে টিকে থাকতে পারে এতটুকু মাত্র ব্যবস্থা কোনো মানুষের পক্ষেই শ্রেয় নয়, তাতে তার অপমান। যথেষ্ট পরিমাণে উদ্বৃত্ত অর্থ, উদ্বৃত্ত অবকাশ মনুষ্যত্ব-চর্চার পক্ষে প্রত্যেক মানুষের প্রয়োজন।' তাঁর সৃজনশীলতার প্রেরণাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যেও অনেক খেদ রয়েছে। বলা বাহুল্য, আমাদের সমাজের অনেক উন্নয়ন ইস্যুতেই রবীন্দ্রনাথের চিন্তাচেতনা হতে পারে মডেল, কিন্তু সেগুলো তলিয়ে দেখাই হয়নি। আজ পর্যন্ত আমরা কবি-সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যতটা নাচছি, ততটা নাচছি না তাঁর দেশগড়ার সূত্রগুলো নিয়ে। বহু যুগ পার হলেও রবীন্দ্রনাথের এ দিকগুলো নিয়ে খুব বেশি গবেষণা যেমন হয়নি, তেমনি এগুলোর দিকে দৃষ্টি পড়েনি নীতিনির্ধারকদেরও। আজ সময়ের প্রয়োজনেই এ দিকটিতে মনোযোগ দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা, আমাদের কৃষি, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের গ্রাম উন্নয়ন, আমাদের সমবায়, আমাদের সমাজব্যবস্থা, আমাদের সংগঠন_এ সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বিশাল অবদানকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে আমরা যত দ্রুত আন্তরিক হতে পারব, অনুসরণ করতে পারব_তত দ্রুত আমরা খুঁজে পাব দিশেহারা প্রান্তিক মানুষের মুক্তি। বিশ্বকবির সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর এই শুভক্ষণে বাংলাভাষী সব পাঠকের কাছে বিনীত আহ্বান_আসুন, চর্চা করি উন্নয়নমনস্ক এক রবীন্দ্রনাথের।
লেখক : কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম-ব্যক্তিত্ব, পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই, shykhseraj@channelitv.net

1 comment:

  1. ধন্যবাদ। এত সুন্দর করে লিখার জন্য।
    কৃষি সমবায় - যেখানে কৃষকদের কৃষি কাজ করার জন্য আর্থিক, ও বিভিন্ন সেবা প্রদান করে থাকে। একটি কৃষি সমবায় হল একটি সমিতি যা কৃষি কাজে সম্পৃক্ত মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল সদস্যদের আর্থিক, ও কৃষি কাজ জনিত সুবিধা প্রদান করা। কৃষি সমবায়গুলো বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন উদ্দেশ্য পরিচালনা করে থাকে। এই ব্লগ পোস্টে, আমরা কৃষি সমবায় কি ? কত প্রকার, উদ্দেশ্য ও মূল ভিত্তি কীভাবে এটি কৃষি উৎপাদনকারী এবং ভোক্তাদের সমানভাবে উপকৃত করতে পারে তা অনুসন্ধান করেছি। আমরা বিভিন্ন ধরনের কৃষি সমবায়ের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করেছি।

    ReplyDelete

Powered by Blogger.