ভাষা বিতর্ক-ভাষার স্বাধীনতা ও প্রমিত বাংলা by নূরুননবী শান্ত
'রাষ্ট্রভাষা বাংলা'কে একটি আন্তর্জাতিক ভাষায়, আজকের দিনের অনিবার্য কার্যকর যোগাযোগ মাধ্যম অন্তর্জালের অন্যতম বলিষ্ঠ ভাষায় পরিণত করতে হলে বাংলার প্রমিত রূপ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। এ কথা মানতেই হবে যে, ভাষার প্রমিত রূপ কোনো স্থির অপরিবর্তনীয় মূর্তি নয়।
কিন্তু ভাষার পরিবর্তন প্রাকৃতিকরূপে সাধিত হলে তার স্বাদুতা বজায় থাকে
১৯৫২ সালে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছিল, একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের শহীদ হতে হয়েছিল, সে আন্দোলনে কিন্তু শুধু বাংলা ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ছিল না, বলা হয়েছিল_ বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। অর্থাৎ অন্য ভাষাভাষী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছিল। বাঙালিরা শুধু নিজের ভাষার স্বাধীনতার কথাই চিন্তা করেনি, বরং মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার জেনেই বাঙালি মাতৃভাষার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। সে সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা আমাদের ভেতরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে, আমাদের গণতন্ত্র শিখিয়েছে এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু বাস্তবে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা' সংবিধানেই থেকে গেল, প্রায়োগিক রূপ পেল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, প্রশাসনিক পরিভাষার যথাযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, তখন কিন্তু বাংলা ভাষার পণ্ডিতগণ দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে, বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ একটি ভাষা। ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা বাংলায় রসায়নের পাঠ্যপুস্তক লিখে এবং ড. একেএম আবদুল ওয়াহেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই বাংলায় লিখে বাংলার ক্ষমতা দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায়, উচ্চ আদালতে (এমনকি নিম্ন আদালতেও) বাংলা ভাষাকে আমরা বাঙালিরাই ভাব প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে সম্মান জানাতে পারলাম না আজ অবধি। অধিকন্তু প্রচারমাধ্যমে যে যার ইচ্ছামতো বাংলাকে ব্যবহার করতে গিয়ে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য হননে লিপ্ত হয়েছি আমরা একবিংশ শতকের বাঙালিরা। আমাদের কারও কারও মাথায় এই ভূত চেপে বসেছে যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের বাংলা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা ভাষাকে স্বকীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার আনুষ্ঠানিক তৎপরতা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেটা করার জন্য সমকালীন কোনো কোনো সাহিত্যিক, বেতার-টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নির্মাতা, সম্পাদক যা করছেন তাতে ভাষার বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অঞ্চলভেদে ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আলাদা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষায় সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক কারণে স্বভাবতই কিছু তফাত রয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিক তফাত তৈরি করার কৃত্রিম রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ভাষার বিকাশে কোনো রকম ভূমিকা রাখবে বলে মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখা যাচ্ছে না। যেহেতু এমন এক অঞ্চলের ভাষারূপকে মানবাংলার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যে অঞ্চলে প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস, সুতরাং একটা সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত বর্তমানে বিচারাধীন গোলাম আযম লিখেছিলেন, 'আমার ভাষার নাম বাংলাদেশি ভাষা'। এই কুখ্যাত লোকটির মতামত কেউ গ্রহণ করেনি। এখন আবার একটু ভিন্নরূপে ভাষার স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো বাংলাকে ব্যবহারের প্রবণতা শুরু হয়েছে। গণমাধ্যমগুলো সেই প্রচেষ্টাকে একরকম উৎসাহিত করে যাচ্ছে।
সংবিধান যে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা' বলছে, সে বাংলার বৈশ্বিক রূপটি কী? সাগরের ওপারে লন্ডন শহরে সিলেট অঞ্চলের বাঙালিদের সংখ্যাধিক্যের কারণে লন্ডনের মানুষ বাংলার যে রূপটি জানে সেই বাংলা, নাকি আজকের তরুণ-তরুণী ঢাকাইয়া-ইংরেজি-হিন্দি-আরবি-ফার্সি মিলিয়ে যে বাংলা লিখছেন-বলছে সেই বাংলা? কিংবা আজকাল টেলিভিশনের ধারাবাহিকগুলোর নানা চরিত্র বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার নামে যে বাংলায় সংলাপ বিনিময় করছেন, সেই বাংলা। এই যে আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা ঘোষণা করার যুক্তিপূর্ণ দাবি তুলেছি, সে বাংলা কোন বাংলা হবে? প্রশ্নটা এই, বাংলা ভাষার একটি সুনির্দিষ্ট রূপ না থাকলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কীরূপে হাজির হবে বাংলা? ধরা যাক, উইলিয়াম রাদিচে যদি সিলেটি বাংলা শিখতেন, ক্লিনটন বি সিলি শিখতেন ঢাকা নগরের এখনকার এক শ্রেণীর তরুণ প্রজন্মের বাংলা এবং তারা দু'জনেই যদি বাংলা ভাষা বিষয়ক কোনো আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে উপস্থিত হতেন, তাহলে তারা কোন বাংলা উপস্থাপন করতেন? সুইডেনের কবি টমাস ট্রমার যদি এখন বাংলা সাহিত্যের রসাস্বাদনের অভিপ্রায়ে শিখতে চান, কোন বাংলা শিখবেন?
'রাষ্ট্রভাষা বাংলা'কে একটি আন্তর্জাতিক ভাষায়, আজকের দিনের অনিবার্য কার্যকর যোগাযোগ মাধ্যম অন্তর্জালের অন্যতম বলিষ্ঠ ভাষায় পরিণত করতে হলে বাংলার প্রমিত রূপ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। এ কথা মানতেই হবে যে, ভাষার প্রমিত রূপ কোনো স্থির অপরিবর্তনীয় মূর্তি নয়। কিন্তু ভাষার পরিবর্তন প্রাকৃতিকরূপে সাধিত হলে তার স্বাদুতা বজায় থাকে। জোর করে ভাষাকে বদলানোর চেষ্টা করতে গেলে ভাষা বিশ্রী হয়ে পড়ে, হারিয়ে যায়, মরে যায়। ভাগীরথীর তীরের বিশেষ অঞ্চলের ভাষা একসময় প্রমিত বাংলা ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল বলে সেই রূপকেই মানদণ্ড ধরে নিয়ে আজকের মানবাংলার রূপ যাচাই করতে হবে_ এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ট রূপ তো থাকতেই হবে, যা বাংলা ভাষার বিশ্বভাষায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথ খুলে দেবে। ঢাকা, যশোর, পাবনা, রংপুর, বরিশাল_ সব অঞ্চলের ভাষার উপাদানের সমন্বয়ে মানবাংলা সমৃদ্ধতর হয়ে উঠছে নিশ্চয়ই। কিন্তু যে যার অঞ্চলের ভাষাকে মান ধরে নিয়ে, তার মধ্যে আবার ইংরেজি-হিন্দি-উর্দু-ফার্সি মিশিয়ে নিজের নিজের মতো করে বাংলা ভাষাকে ব্যবহারের প্রবণতাকে কোনোমতেই ভাষার স্বাধীনতা হিসেবে গণ্য করা যায় না, বরং স্বেচ্ছাচারিতা বলা যায়।
সম্প্রতি উচ্চ আদালত গণমাধ্যমে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের ওপর যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন, তা বাংলাদেশে প্রচারিত বিদেশি গণমাধ্যমের ওপর প্রযোজ্য হবে কি-না সে বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। অথচ ভিনদেশি বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি প্রচারমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বলায়-লেখায় বাংলা ভাষা দূষণের পেছনে কম দায়ী নয়। ভারতে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল, পত্রিকা, বই-পুস্তক কোনো কিছুই রফতানি করার সুযোগ নেই, তাহলে আমরা কেন অন্য দেশের জন্য এমন সুযোগ অবাধ করে দিয়েছি! আমাদের জ্ঞান ও বিনোদনের ভাণ্ডার আজ আর এতটা দুর্বল নয় যে, সেগুলো আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হবে। অধিকন্তু দেশে সম্প্রতি চালু হওয়া কমিউনিটি রেডিওগুলো নীতিমালা অনুযায়ী কমিউনিটির ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করবে। আদালতের রায় কি কমিউনিটি রেডিওর ওপরও প্রযোজ্য হবে?
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও আনুষ্ঠানিকভাবে ভুল বানানে বাংলা শব্দ লেখা, ভুল গঠনে বাংলা বাক্য লেখা এবং ভুল উচ্চারণে বাংলা বলা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। শুধু ভাষা শহীদদের মর্যাদা রক্ষার জন্য নয়, বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির উচ্চাসন নিশ্চিত করার স্বার্থেই একটি সুচিন্তিত বাংলা ভাষা পরিকল্পনা এখনই জরুরি।
নূরুননবী শান্ত :গল্পকার, উন্নয়নকর্মী
shantonabi@gmail.com
১৯৫২ সালে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছিল, একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের শহীদ হতে হয়েছিল, সে আন্দোলনে কিন্তু শুধু বাংলা ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ছিল না, বলা হয়েছিল_ বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। অর্থাৎ অন্য ভাষাভাষী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছিল। বাঙালিরা শুধু নিজের ভাষার স্বাধীনতার কথাই চিন্তা করেনি, বরং মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার জেনেই বাঙালি মাতৃভাষার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। সে সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা আমাদের ভেতরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে, আমাদের গণতন্ত্র শিখিয়েছে এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু বাস্তবে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা' সংবিধানেই থেকে গেল, প্রায়োগিক রূপ পেল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, প্রশাসনিক পরিভাষার যথাযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, তখন কিন্তু বাংলা ভাষার পণ্ডিতগণ দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে, বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ একটি ভাষা। ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা বাংলায় রসায়নের পাঠ্যপুস্তক লিখে এবং ড. একেএম আবদুল ওয়াহেদ চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই বাংলায় লিখে বাংলার ক্ষমতা দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায়, উচ্চ আদালতে (এমনকি নিম্ন আদালতেও) বাংলা ভাষাকে আমরা বাঙালিরাই ভাব প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে সম্মান জানাতে পারলাম না আজ অবধি। অধিকন্তু প্রচারমাধ্যমে যে যার ইচ্ছামতো বাংলাকে ব্যবহার করতে গিয়ে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য হননে লিপ্ত হয়েছি আমরা একবিংশ শতকের বাঙালিরা। আমাদের কারও কারও মাথায় এই ভূত চেপে বসেছে যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের বাংলা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা ভাষাকে স্বকীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার আনুষ্ঠানিক তৎপরতা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেটা করার জন্য সমকালীন কোনো কোনো সাহিত্যিক, বেতার-টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নির্মাতা, সম্পাদক যা করছেন তাতে ভাষার বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অঞ্চলভেদে ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আলাদা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষায় সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক কারণে স্বভাবতই কিছু তফাত রয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিক তফাত তৈরি করার কৃত্রিম রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ভাষার বিকাশে কোনো রকম ভূমিকা রাখবে বলে মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখা যাচ্ছে না। যেহেতু এমন এক অঞ্চলের ভাষারূপকে মানবাংলার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যে অঞ্চলে প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস, সুতরাং একটা সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত বর্তমানে বিচারাধীন গোলাম আযম লিখেছিলেন, 'আমার ভাষার নাম বাংলাদেশি ভাষা'। এই কুখ্যাত লোকটির মতামত কেউ গ্রহণ করেনি। এখন আবার একটু ভিন্নরূপে ভাষার স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো বাংলাকে ব্যবহারের প্রবণতা শুরু হয়েছে। গণমাধ্যমগুলো সেই প্রচেষ্টাকে একরকম উৎসাহিত করে যাচ্ছে।
সংবিধান যে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা' বলছে, সে বাংলার বৈশ্বিক রূপটি কী? সাগরের ওপারে লন্ডন শহরে সিলেট অঞ্চলের বাঙালিদের সংখ্যাধিক্যের কারণে লন্ডনের মানুষ বাংলার যে রূপটি জানে সেই বাংলা, নাকি আজকের তরুণ-তরুণী ঢাকাইয়া-ইংরেজি-হিন্দি-আরবি-ফার্সি মিলিয়ে যে বাংলা লিখছেন-বলছে সেই বাংলা? কিংবা আজকাল টেলিভিশনের ধারাবাহিকগুলোর নানা চরিত্র বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার নামে যে বাংলায় সংলাপ বিনিময় করছেন, সেই বাংলা। এই যে আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা ঘোষণা করার যুক্তিপূর্ণ দাবি তুলেছি, সে বাংলা কোন বাংলা হবে? প্রশ্নটা এই, বাংলা ভাষার একটি সুনির্দিষ্ট রূপ না থাকলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কীরূপে হাজির হবে বাংলা? ধরা যাক, উইলিয়াম রাদিচে যদি সিলেটি বাংলা শিখতেন, ক্লিনটন বি সিলি শিখতেন ঢাকা নগরের এখনকার এক শ্রেণীর তরুণ প্রজন্মের বাংলা এবং তারা দু'জনেই যদি বাংলা ভাষা বিষয়ক কোনো আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে উপস্থিত হতেন, তাহলে তারা কোন বাংলা উপস্থাপন করতেন? সুইডেনের কবি টমাস ট্রমার যদি এখন বাংলা সাহিত্যের রসাস্বাদনের অভিপ্রায়ে শিখতে চান, কোন বাংলা শিখবেন?
'রাষ্ট্রভাষা বাংলা'কে একটি আন্তর্জাতিক ভাষায়, আজকের দিনের অনিবার্য কার্যকর যোগাযোগ মাধ্যম অন্তর্জালের অন্যতম বলিষ্ঠ ভাষায় পরিণত করতে হলে বাংলার প্রমিত রূপ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। এ কথা মানতেই হবে যে, ভাষার প্রমিত রূপ কোনো স্থির অপরিবর্তনীয় মূর্তি নয়। কিন্তু ভাষার পরিবর্তন প্রাকৃতিকরূপে সাধিত হলে তার স্বাদুতা বজায় থাকে। জোর করে ভাষাকে বদলানোর চেষ্টা করতে গেলে ভাষা বিশ্রী হয়ে পড়ে, হারিয়ে যায়, মরে যায়। ভাগীরথীর তীরের বিশেষ অঞ্চলের ভাষা একসময় প্রমিত বাংলা ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল বলে সেই রূপকেই মানদণ্ড ধরে নিয়ে আজকের মানবাংলার রূপ যাচাই করতে হবে_ এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ট রূপ তো থাকতেই হবে, যা বাংলা ভাষার বিশ্বভাষায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথ খুলে দেবে। ঢাকা, যশোর, পাবনা, রংপুর, বরিশাল_ সব অঞ্চলের ভাষার উপাদানের সমন্বয়ে মানবাংলা সমৃদ্ধতর হয়ে উঠছে নিশ্চয়ই। কিন্তু যে যার অঞ্চলের ভাষাকে মান ধরে নিয়ে, তার মধ্যে আবার ইংরেজি-হিন্দি-উর্দু-ফার্সি মিশিয়ে নিজের নিজের মতো করে বাংলা ভাষাকে ব্যবহারের প্রবণতাকে কোনোমতেই ভাষার স্বাধীনতা হিসেবে গণ্য করা যায় না, বরং স্বেচ্ছাচারিতা বলা যায়।
সম্প্রতি উচ্চ আদালত গণমাধ্যমে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের ওপর যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন, তা বাংলাদেশে প্রচারিত বিদেশি গণমাধ্যমের ওপর প্রযোজ্য হবে কি-না সে বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। অথচ ভিনদেশি বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি প্রচারমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বলায়-লেখায় বাংলা ভাষা দূষণের পেছনে কম দায়ী নয়। ভারতে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল, পত্রিকা, বই-পুস্তক কোনো কিছুই রফতানি করার সুযোগ নেই, তাহলে আমরা কেন অন্য দেশের জন্য এমন সুযোগ অবাধ করে দিয়েছি! আমাদের জ্ঞান ও বিনোদনের ভাণ্ডার আজ আর এতটা দুর্বল নয় যে, সেগুলো আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হবে। অধিকন্তু দেশে সম্প্রতি চালু হওয়া কমিউনিটি রেডিওগুলো নীতিমালা অনুযায়ী কমিউনিটির ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করবে। আদালতের রায় কি কমিউনিটি রেডিওর ওপরও প্রযোজ্য হবে?
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও আনুষ্ঠানিকভাবে ভুল বানানে বাংলা শব্দ লেখা, ভুল গঠনে বাংলা বাক্য লেখা এবং ভুল উচ্চারণে বাংলা বলা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। শুধু ভাষা শহীদদের মর্যাদা রক্ষার জন্য নয়, বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির উচ্চাসন নিশ্চিত করার স্বার্থেই একটি সুচিন্তিত বাংলা ভাষা পরিকল্পনা এখনই জরুরি।
নূরুননবী শান্ত :গল্পকার, উন্নয়নকর্মী
shantonabi@gmail.com
No comments