সমাজ-নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের উৎস by সুস্মিতা চক্রবর্তী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মনোবিজ্ঞান বিভাগ আয়োজিত বইমেলার ছোট স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আচমকা একটা ছেলের কথা বিশেষভাবে কানে এসে ধাক্কা লাগায় একটু এগিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি। যে ছোট্ট স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটি উচ্চ স্বরে তার বান্ধবীকে একটি পোস্টারের ছবি দেখিয়ে নারীর প্রতি নেতিবাচক


মনোভাব উচ্চ গলায় হাজির করছিল, সেটি ছিল মূলত একটি নারী নির্যাতনের পোস্টার, যেখানে একজন নারীকে বীভৎসভাবে একটি গ্রাম্য সালিসে নির্যাতন করার প্রেক্ষাপট ভয়াবহ চিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। পোস্টারটিতে, আসলে আমাদের গ্রামসমাজের নারী নির্যাতনের প্রচলিত দৃশ্যই তুলে ধরা হয়েছে, যেন সমাজের সব স্তরের মানুষজন এ পোস্টারের মাধ্যমে এ ধরনের সহিংস আর বর্বরোচিত নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারে আর এর বিরুদ্ধে সচেতনতা আর প্রতিবাদ জারি রাখতে পারে।
যেকোনো সংবেদনশীল মানুষ এ পোস্টারটির সামনে দাঁড়িয়ে মর্মপীড়া বোধ করবেন আর এ ধরনের নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাবেন। কিন্তু লক্ষ করলাম, এই ছেলেটির মনোভাব হলো নারীবিদ্বেষী। এই হলো আমাদের সমাজ-বাস্তবতা, যেখানে অনেকেই নারীর প্রতি অত্যন্ত নেতিবাচক মনোভাব লালন করে আর নিজেদের আচার-আচরণে নানাভাবে তার প্রকাশ ঘটায়। অনেক ক্ষেত্রেই এসব আচরণ যাবতীয় সংবেদনশীলতার আর মানবিকতার সীমানা লঙ্ঘন করে, নারীর প্রতি পুরুষকে সহিংস করে তোলে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-মূল্যবোধ পুরুষকে নারীর ওপর যাবতীয় কর্তৃত্ব করার বৈধতা দেয়। নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সব নির্যাতনই সমাজে নারীকে নানা পরিসরে কোণঠাসা আর অসম্মানজনক অবস্থায় পর্যবসিত করে। পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শ-মূল্যবোধ মানুষের বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে পরিচর্চিত হয়ে থাকে প্রতিনিয়ত। এই জন্যই একজন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত তরুণের দৃষ্টিভঙ্গি আর অক্ষরবঞ্চিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে খুব বেশি ফারাক করার উপায় থাকে না। পুরুষতান্ত্রিক এ দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য যে স্তরে সমাজে-রাষ্ট্রে কাজ হওয়া উচিত, তা কখনোই হয় না।
এমনকি আমাদের পাঠ্যক্রমেও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য সে রকম কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। ফলে একটি ছেলে বা মেয়ে ছোটবেলা থেকেই প্রচলিত মূল্যবোধাশ্রিত পরিবেশে বিকশিত হয়। ফলে, গ্রাম-শহরের নানান পরিসরে নারীরা নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়।
কদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক প্রেমিক বন্ধু তার বান্ধবীকে প্রকাশ্যে মারধর করে ফেলে চলে যায়। একজন সহকর্মী ঘটনাটি আমাকে জানালে পরিস্থিতিটা বোঝার জন্য ঘটনাস্থলে গিয়ে মেয়েটিকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করি, তখন কাঁচুমাচু ভাব নিয়ে একটি ছেলে এসে জানায় যে সে মেয়েটির বন্ধু; আর ঝগড়ার একপর্যায়ে সে তার বান্ধবীকে মেরেছে! সে জন্য সে আমার কাছে ক্ষমা চায় বারবার। ছেলেটি তার ভুল বুঝতে পেরেছে বলে জানায়। আমি তাকে আমার কাছে নয়, তার বান্ধবীর কাছে ক্ষমা চাইতে বলি। ছেলেটি বেশ মন খারাপ করে ক্ষমা চেয়ে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যায়। এই যে ছেলেটির এই মারমুখী আচরণ, এটা সে এক দিনে শেখেনি। নারীর প্রতি নেতিবাচক কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব লালন করে বেড়ে ওঠার কারণেই সে তার মূল্যবোধের সঙ্গে না মিললে নারীর প্রতি সহিংস হয়ে উঠতে দ্বিধা বোধ করে না। আবার যখন কোনো নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটে, তখনো একইভাবে নিপীড়নের দায় নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেতে বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করে নারীর চরিত্র নিয়ে মুখরোচক কথাবার্তা রটনার মধ্য দিয়ে। গণমাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত নারীকে এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তুলে ধরে নানাভাবে। বিজ্ঞাপনে, সিরিয়ালে, নাটকে আর সিনেমায় পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শজাত নারী চরিত্র প্রদর্শন চলে প্রতিনিয়ত। নারীর প্রতি সংবাদ পরিবেশনের ধরন-ধারণগুলোতে এ বিষয়টি আরও প্রবল হয়ে ওঠে। সম্প্রতি গণমাধ্যমজগতের দুই পেশাদার সাংবাদিকের খুন হয়ে যাওয়া ঘটনাতেও এই একই দৃষ্টিভঙ্গি টের পাওয়া গেছে। অথচ, বর্তমান দুনিয়ায় গণমাধ্যম যদি সঠিকভাবে নারীকে মূল্যায়ন করে কাজ করত, তবে অনেক মানুষই এসব মাধ্যম থেকে ইতিবাচক কিছু শিক্ষা লাভ করতে পারত। কিন্তু, বাস্তবে ঘটে ঠিক তার উল্টোটা, যেখানে সমাজে বিদ্যমান প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ধারণাগুলোই প্রতিনিয়ত এসব গণমাধ্যমে আরও পাকাপোক্তভাবে প্রদর্শিত আর পুনরুৎপাদিত হয়ে চলে।
গণমাধ্যমে প্রচারিত এমন সব বিজ্ঞাপন আছে, যেগুলোর ভাষা শুনলে মনে হবে, পৃথিবীতে নারীর কাজ কেবল শরীরসর্বস্ব হয়ে সারা দিন প্রসাধনী নিয়ে ব্যস্ত থাকা। ফরসা হওয়ার ক্রিম মেখে ‘সুন্দরী’ হয়ে চাকরি পাওয়া, ‘সুগন্ধি’ শ্যাম্পু মেখে চুল লম্বা করে স্বামী বা প্রেমিকের মনোযোগ কাড়া প্রভৃতি। এর বাইরে বাস্তব জগতের নারীর যে লড়াই-সংগ্রাম নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা, শিক্ষার মাধ্যমে স্বোপার্জিত আয়ে পরিবারসহ টিকে থাকা কিংবা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি নারীর যে কর্মময় উপস্থিতি, সেগুলোকে প্রায়শই অদৃশ্য করে তোলা হয় প্রচলিত ছাঁচে নারীকে গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত উপস্থাপনের মাধ্যমে। একদিকে আমাদের সনাতনী মূল্যবোধ নারীর ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে অপরদিকে পুঁজিবাদী-পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ নারীকে যৌনতার মাপকাঠিতে বিচার করে স্রেফ পণ্য বানিয়ে প্রতিনিয়ত নারীর খণ্ডিত ইমেজ নির্মাণ করে চলে।
কোনো প্রতিষ্ঠানে যেকোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে দেখা যায়, সেসব অনুষ্ঠানে মেয়েদের সেজেগুজে অতিথিদের ফুল দেওয়ার কাজ করানো হয়ে থাকে। এসব কাজে ছেলেদের যুক্ত করা হয় না। কিংবা নারীদের গুণ হিসেবে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেসব মানদণ্ড স্থির করে রেখেছে, তার বাইরে গেলে নারীকে নানাভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। আমাদের বিদ্যমান সমাজ-মূল্যবোধ নারীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে শেখেনি। সমাজে ঘটে চলা অসংখ্য সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ঘটনা আর আচরণের মধ্য দিয়ে সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভঙ্গিটি প্রায়শই ভয়ংকরভাবে টের পাওয়া যায়। এর দায়ভাগ কিন্তু সমাজ-পরিবার-প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রের ওপরই শেষ পর্যন্ত বর্তায়।
সুস্মিতা চক্রবর্তী: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.