কৃষি-কৃষক কি ক্ষতিপূরণ পাবে না? by শরিফুজ্জামান শরিফ,জীবনানন্দ জয়ন্ত ও নুরুল আলম মাসুদ

কৃষকবান্ধব বীজনীতি-আইন প্রণয়ন; বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি শক্তিশালীকরণ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরালোভাবে মনিটর করা; বীজ আমদানি ও বিপণন ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নিয়ম অনুসরণ অন্যথায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়া হোক গত মৌসুমে নোয়াখালী অঞ্চলে ঝলক-১ হাইব্রিড ধান এবং রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় সবল এফ-১ হাইব্রিড


জাতের টমেটো বীজ চাষ করে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু এই ক্ষতির জন্য দায়ী কোম্পানি দুটির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; কৃষকরাও পাননি ক্ষতিপূরণ। কোম্পানি কিংবা কৃষি উন্নয়নে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবস্থাপনা এমনকি সরকারের দায়িত্বশীল কোনো অবস্থান থেকেই কৃষকের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় আসেনি।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় প্রচুর টমেটো ফলে। এখানকার কৃষকদের প্রধান অর্থকরী ফসল এটি। প্রতি মৌসুমের আয় থেকে কৃষক, বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষক তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রিক পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু ২০১০ সালে সেখানকার কৃষক একটি বহুজাতিক বীজ কোম্পানির পক্ষে ভারত থেকে আমদানিকৃত 'সবল এফ-১' হাইব্রিড জাতের টমেটো বীজ কোম্পানির নিজস্ব পরিবেশক ও তাদের মনোনীত বিক্রেতার কাছ থেকে চড়ামূল্যে সংগ্রহের পর চাষ করে কোনো ফলন পাননি। অপরদিকে আরেকটি কোম্পানির চীন থেকে আমদানিকৃত 'ঝলক-১' হাইব্রিড ধানের বীজ চাষ করেও কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঝলক বীজ আমদানিকারক কর্তৃপক্ষ এর আগেও কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা করেছিল এবং এ নিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। জানা যায়, এই কোম্পানি ২০১০ সালে 'এগ্রোজি-১' নামে আমদানিকৃত যে বীজ একই নামে বাজারে ছাড়ে তাতে হবিগঞ্জের কৃষকরা কোনো ফলন পাননি। এ বছর নাম পরিবর্তন করে ঝলক-১ নামে বাজারে ছাড়া হয় এবং এবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষ করে কৃষকরা প্রতারিত হয়েছেন। জাতীয় বীজ নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিবন্ধিত এই বীজ ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও যশোর অঞ্চলের জন্য নিবন্ধিত হলেও এটি নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরসহ সারাদেশেই বিক্রি করা হয়।
দুটি ঘটনার পরই প্রান্তিক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতিপূরণের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন, তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সমাবেশ করে প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের প্রধানদের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। জাতীয় সংসদে রাজশাহী-১-এর সাংসদ ভেজাল ও নিম্নমানের টমেটো বীজের বিষয়টি তুলে ধরেন। কিন্তু এরপরও কৃষক ক্ষতিপূরণ পাননি, শাস্তি হয়নি কোম্পানি দুটির। আমরা মর্মাহত, কৃষি অর্থনীতির বাংলাদেশে কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা করে কোম্পানিগুলো বহাল তবিয়তে মুনাফা লুটে নেয় আর কৃষককে দাবি আদায়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে হয়! প্রায় আড়াই হাজার টমেটো চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং রাজশাহী বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির ফিল্ড অফিসের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমির টমেটোর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষক যখন মরিয়া, সবল এফ-১ টমেটো বীজ প্রত্যাখ্যানে যখন সরব তখন রাজশাহীতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির দালাল-চাপরাশিরা সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন যোগাযোগ করছে তাদের ব্যবসা চালু রাখতে। এখানেই শেষ নয়, রাতের আঁধারে গোদাগাড়ীর বিভিন্ন এলাকার অভাবক্লিষ্ট চাষিদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দাবি আদায়ের আন্দোলন থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। এ ধরনের কাজ কৃষক সম্প্রদায়ের মাঝে বংশ পরম্পরায় যে সম্পর্ক ও বিশ্বাস বিদ্যমান সেখানে অবিশ্বাসের বীজ রোপণ করছে, যা পরে কৃষকদের স্ববিরোধী মনো-সামাজিক দ্বন্দ্বে ফেলবে এবং স্থায়ীভাবে কৃষি ও কৃষক সুরক্ষায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশের বীজনীতিতে বীজ খাতের বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে কৃষি ও কৃষক সুরক্ষার বিষয়টি অবহেলিত থেকে গেছে। ফলে এ ধরনের ক্ষতিগ্রস্ততার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকের কল্যাণে ভূমিকা রাখার মতো সুযোগ দৃশ্যমান নয়। আবার কৃষিনীতিতে বর্ণিত সম্প্রসারণ কর্মীদের দায়িত্বশীলতা যে ক্ষেত্রে চিহ্নিত রয়েছে তাও স্বাভাবিকভাবে দৃশ্যমান নয়। এছাড়া ভেজাল ও নিম্নমানের বীজ চাষে কৃষক যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তার পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ ভূমিকা পালন না করার বিষয়টিও ক্রিয়াশীল। এখানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, স্থানীয় বীজ-সার মনিটরিং কমিটি তাদের দায় এড়াতে পারে না। এ রকম অবস্থায় দেশজ অর্থনীতির প্রাণ সঞ্চারকারীরা নিরাপত্তাবলয় থেকে অযুত মাইল দূরেই থেকে যাচ্ছে। এ রকম অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
কৃষি ও কৃষক সুরক্ষায় আমদানিকারক দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আমদানিকৃত বীজের গুণগতমান নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। আমরা চাই কৃষি এবং কৃষককে সুরক্ষা দিতে প্রয়োজনীয় সব কর্মসূচি সরকারিভাবে গৃহীত হোক।
এযাবৎকালে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতির বিষয়টি জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিদ্যমান নীতি ও আইনে যুক্ত করা; উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ পদ্ধতি সব ফসল/উদ্ভিদ ও জাতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ বাধ্যতামূলক; কৃষি সম্প্রসারণ, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি; প্রতারক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক অনুমোদন বাতিল এবং দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান; কৃষকবান্ধব বীজনীতি-আইন প্রণয়ন; দেশে উন্নতমানের বীজ উৎপাদনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিএডিসির সম্প্রসারণ; বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি শক্তিশালীকরণ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরালোভাবে মনিটর করা; বীজ আমদানি ও বিপণন ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নিয়ম অনুসরণ অন্যথায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়া হোক। বর্তমান সরকার ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ, যেখানে কৃষি এবং কৃষক অবিচ্ছেদ্য; কৃষকও সেদিকেই তাকিয়ে আছেন।

লেখকবৃন্দ : নাগরিক অধিকারকর্মী
 

No comments

Powered by Blogger.