বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো by ড. মো. ছরোয়ার হোসেন

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো কেন? জাতির কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া আকর্ষণীয় শিরোনামে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভবত তরুণ চারজন শিক্ষকের গবেষণামূলক লেখাটি গভীর আগ্রহ সহকারে পড়তে গিয়ে ভীষণভাবে হোঁচট খেলাম এর শিরোনামের সঙ্গে ভেতরের বিষয়বস্তুর সাংঘাতিক অমিল


দেখে। লেখার প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে, 'সরকার রীতিমতো আইন করে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছরে উন্নীত করেছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে আইনটির আগে কেবল ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬৫ বছর ছিল।'
পাঠক লক্ষ করুন, সরকারের বর্তমান আইনটি করার আগে আরো চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের অবসরের বয়স ৬৫ বছর ছিল, যা লেখকরা নিজেরাই তাঁদের লেখনীতে উল্লেখ করেছেন এবং এও উল্লেখ করেছেন, এবার সমতা এনে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের জন্য এটি নিশ্চিত করা হলো। পরিষ্কার একটি বিষয় অনুধাবন করার পরও চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো নিয়ে তাঁদের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন কাদের উদ্দেশে এবং কেন, তা আমাদের মতো নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে বোধগম্য নয়। বরং বিষয়বস্তু পড়ে মনে হয়েছে, যদি লিখতেন, 'আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বয়সসীমা সমতা' কেন? তাহলে অধিক গ্রহণযোগ্য হতো।
তরুণ শিক্ষকদের চমৎকার ভাবনা ও বর্তমান লেখার বিষয়বস্তু সর্বজনীন হতো, যদি তাঁরা উল্লেখ করতেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ বছর না করে বরং যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসরের বয়স ৬৫ বছর আছে- তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমতা এনে ৬০ বছর করা হোক এবং তাহলে যে যুক্তিগুলো যেমন- বেকার সমস্যা, তরুণদের চাকরিতে প্রবেশ বাধামুক্ত ও সরকারের আর্থিক সাশ্রয় ইত্যাদি যা তাঁরা লেখনীতে উপস্থাপন করেছেন, তা মানানসই হতো। কিন্তু লেখাটি থেকে সেই মহৎ বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি বা কৌশলে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা নিজেদের চাকরির বয়সসীমা ঠিক রেখে নির্মোহ ভঙ্গি নিয়ে তদবির-তালাশ করে খুঁজে ফিরছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬০ থেকে ৬৫ বছরে উন্নীতকরণের আসল প্রয়োজনটি কী? কী বিচিত্র ভাবনা! চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি করলে তরুণ শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে জটিলতা হবে- এ বিষয়ে তাঁরা একটি মনগড়া যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন, 'পদ পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে উচ্চতর পদে যেতে হলে একজন তরুণ শিক্ষককে বিজ্ঞাপিত পদের জন্য চাকরির তুলনায় অনেক বেশি বছর চাকরিতে থাকতে হবে।' প্রিয় পাঠক, যদি সত্যই অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার ফলে তরুণ শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে জটিলতা হয়ে থাকত, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অবসরের বয়স ৬৫ থেকে কমিয়ে ৬০ বছর করার আন্দোলন করতেন; কিন্তু আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে এ ধরনের কোনো আন্দোলন বা দাবি উপস্থাপিত হয়েছে বলে জানা নেই।
তা ছাড়া আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারা জানি, একবার শিক্ষকতায় যোগদান করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী পদ না থাকলেও আপনা-আপনি পদোন্নতি বা পর্যায়োন্নয়ন হয়ে যায় এবং ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে একজন প্রভাষক অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। এখানে পদোন্নতির সঙ্গে অবসরের বয়সসীমার কোনো সম্পর্ক নেই। যদি সম্পর্ক থাকত, তাহলে কেন দীর্ঘদিন তাঁরা পদোন্নতির ক্ষেত্রে এমন বৈষম্যের শিকার হয়েও কোনো প্রতিবাদ করলেন না- সে প্রশ্ন থেকে যায়। আসলে সমস্যা চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো নয়, প্রকৃত সমস্যা হলো সমতা আনয়নে। দেশের অপেক্ষাকৃত নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির সুযোগ-সুবিধা দেশের প্রবীণ ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপর্যায়ে আনয়নের সরকারি সিদ্ধান্ত দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী ভাইয়েরা মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারছেন না। প্রসঙ্গক্রমে তাঁরা বছর চারেক আগে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা ৬৭ বছরে উন্নীতকরণের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বয়সসীমা ৬৭ বছরে উন্নীতকরণের দাবিটিকে নিম্নরুচি বলে দাবি করেছেন এবং পক্ষান্তরে বোঝাতে চেয়েছেন, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬০ থেকে ৬৫ বছর চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিও নিম্নরুচির শামিল। বিচারকদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বয়সের সমতা আনয়নের তখনকার দাবিটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির সময়সীমা ৬৭ বছরে উন্নীত হোক, তা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারেনি বা তখন তাঁরা সমর্থনও করেননি। তা ছাড়া বিষয়টি ছিল আন্তমন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সমস্যা। কিন্তু একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির বয়সসীমার মধ্যে তারতম্য থাকবে, তা প্রণিধানযোগ্য নয়।
প্রসংগত লেখার একটি জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে, 'যেভাবে চাকরির বয়সসীমা ঢালাওভাবে বাড়ানো হচ্ছে বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের প্রাইমারি স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত সব শিক্ষক, সব কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য দফায় দফায় তা বাড়ানোর দাবি উঠবে।' প্রিয় লেখকরা আপনাদের উপরোক্ত ধারণাটি সঠিক নয়। দেশের সব প্রাইমারি স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত চাকরির বয়সসীমার মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিদ্যমান।
আপনাদের দাবি অনুযায়ী ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হচ্ছে না বলে আপনারা যে দাবি লেখনীতে করেছেন, এটিও পুরোপুরি সত্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা আগে থেকেই ৬৫ বছর ছিল, তেমনি অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসর গ্রহণের প্রকৃত বয়স ৬০ বছর হলেও পর্যায়ক্রমে দুই বছর, দুই বছর ও এক বছর করে বাড়ানোর সুযোগ ছিল এবং অধিকাংশ শিক্ষকই শারীরিক যোগ্যতাসাপেক্ষে ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকরি করে অবসরে গেছেন বা এখনো যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে মেয়াদ বাড়ানোর নিয়মটি রহিত করে সরকার একটি সাধারণ আইন করে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরের বয়সসীমা সরাসরি ৬৫ বছরে উন্নীত করেছে মাত্র এবং অবসরের বয়সসীমা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ব-স্ব আইন দ্বারা কার্যকরের দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে সরকার এটি সংসদে আইন তৈরি করার মাধ্যমে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে কার্যকরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ জন্য সরকার অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য এবং আমরা যারা নবীন ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তারা সরকারের এই যুগান্তকারী ও সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সবশেষে প্রিয় সহকর্মী শিক্ষকরা উল্লেখ করেছেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বলা যায় যিনি সব ক্ষেত্রে স্মরণীয় অবদান রেখেছেন, ছাত্রদের কল্যাণে সময় ও মেধা দিতে প্রস্তুত এবং সুস্থ আছেন, তাঁকে বয়সের সময়সীমা উন্মুক্ত রেখে নির্দিষ্ট বিভাগে যুক্ত করা হোক।' আপনাদের এ মতামতের সঙ্গে আমরাও কিন্তু একমত। যদি স্বাভাবিক অবসরের পর কোনো শিক্ষক ছাত্রদের কল্যাণে সময় ও মেধা দিতে প্রস্তুত থাকেন, তবে তাঁদের বিভিন্ন বিভাগে অনারারি প্রফেসর হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে ছাত্রছাত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় উভয়েরই উপকার হবে- তবে তা হতে হবে অবশ্যই রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত। তাই আসুন দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন ও শিক্ষাদান পদ্ধতির মধ্যে সমতা এনে একযোগে যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদান ও দেশ গঠনে অবদান রাখি।

লেখক : অধ্যাপক, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
sarowar2001@rediffmail.com

No comments

Powered by Blogger.