প্রস্তুতির মার্চ-সামনের প্রশস্ত পথে সমৃদ্ধির পথচলা by প্রশান্ত মৃধা

পৃথিবীর দিকে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাওয়ার শক্তি জোগায় স্বাধীনতা। হয়তো সেখানে বা কোনোখানেই খুব আশাবাদী হওয়ার বিষয় ঘটুক বা না-ই ঘটুক, স্বাধীনতার প্রশ্নে তার চেতনা আর চৈতন্যের দৃঢ়তায় ঘাটতি নেই। ফলে স্বাধীনতা, স্বাধীনতাই। আজকের তরুণ প্রাণ যার সামনে যে বাংলাদেশ তাকে সে স্বপ্নহীন ভাবতে রাজি নয়।


সে বাংলাদেশের ক্ষুধা আছে, দারিদ্র্য আছে; কিন্তু ওই তরুণ তাকে খুব স্বপ্নহীন ভাবে না



স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত ধারণামাত্র। ব্যক্তির জীবনে, রাষ্ট্রে সর্বত্রই। সেই ধারণায় 'স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়' উচ্চারিত পঙ্ক্তি হিসেবে বেশ কাজের। পরাধীনতা ও দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে পা খুলে দাঁড়াতে সহায়ক। কেননা স্বাধীনতাহীন বাঁচা, না বাঁচার শামিল। খাঁচার বাঘ যেমন বাঘ নয়। সঙ্গে যদি কাছে বা দূর থেকে এই কথাও ভেসে আসে : 'স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন!' তখনই ওই ব্যক্তির জীবনে কি রাষ্ট্রে ভেতরে ভেতরে গোলমাল শুরু হয়! হ্যাঁ, গোলমালই। নিজের কি নিজেদের ভেতরের আত্মবিশ্বাসের ভিতে কাঁপন ধরে। স্বাধীন রাষ্ট্রে ব্যক্তির জীবনে স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্ন সব ভিতে কম্পন তোলে সত্যি! সেই কাঁপন নিয়ে প্রতিদিনের দিনযাপনে তখন আর 'স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়' মনে পড়ে না, তখন স্বাধীনতা নিজেই হয়ে দাঁড়ায় এক প্রকার সংকট!
কথাগুলো খুব তেতো শোনাল বটে! কিন্তু আমাদের জন্য সত্যিও! আমরা বলি ও জানি, আমাদের চেয়ে পরে স্বাধীন কোন কোন দেশ দাঁড়িয়ে গেছে। আমরাই নিজেদের ব্যর্থতা প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করি কোন কোন দেশ, কোন কোন জাতি 'উন্নত বিশ্বের' কাতারে দাঁড়িয়েছে তাদের কথা বলে। তখন নিজেদের ব্যর্থতা বড় হয়ে দাঁড়ায়। নিজেরা কেন সেখানে তাদের কাতারে পেঁৗছতে পারিনি_ সে হিসাবও করি। সেই প্রত্যাশায় ভর করে দাঁড়াই এ জন্য, আমরাও স্বাধীন। স্বাধীনতাই ওই স্পর্ধা, ওই আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করায়। সেখানে ওই 'উন্নত' দেশটির সঙ্গে আমাদের কোনো তফাত নেই। তারা স্বাধীন রাষ্ট্র, আমরাও।
তাহলে তফাত তাদের সঙ্গে আমাদের উন্নতিতে। উন্নতি বলতে এখানে আমরা বুঝি দেশের প্রতিজন নাগরিকের জন্য অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান। প্রতিটি শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। সঙ্গে নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনীয় নাগরিকদের সুবিধাদি। থাকে সব আইনি সহায়তা, দেশের সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ, দিনে-রাতে সর্বত্র অবাধ বিচরণ, রাষ্ট্রীয় পরিবহনের সুযোগ_ এমনতর শতেক সুবিধা। যাকে গণতন্ত্র বলি।
আমাদের ক্ষেত্রে সংকট তাহলে গণতন্ত্রের। স্বাধীনতা অর্জনের পর গণতন্ত্রের সব সুবিধা বা সুফল ঘরে তুলতে পারিনি। সোজা কথায় একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করে উঠতে পারিনি। সেটা খুব দরকার ছিল। আর পারিনি বলেই স্বাধীনতার প্রশ্নটি ঘুরেফিরে এক সংকটের প্রশ্ন হিসেবে সামনে আসে। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন_ এই কথা বড় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তারপরও স্বাধীনতা, স্বাধীনতাই। এর কোনো বিকল্প আজও আবিষ্কৃত হয়নি। হয়তো হবেও না।
আবার জীবনে-রাষ্ট্রে যত প্রকার সংকটই থাকুক, স্বাধীনতাই নিজেদের জন্য নিজেদের ব্যর্থতার স্মারক হয়ে উঠুক, তারপরও স্বাধীনতা, স্বাধীনতাই। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা তার সফলতার প্রশ্নে যেভাবে নিজেদের ব্যর্থতাকে ইঙ্গিত করি না কেন, স্বাধীনতাই আমাদের সব আত্মবিশ্বাসের উৎস। আজ নিজেদের ব্যর্থতাগুলো নিয়ে যে কথাগুলো বলতে পারি, আমরা বলি, কখনও কখনও সেই প্রশ্নে আত্মসমালোচনায় মুখর হই, তাও ওই স্বাধীনতার জন্যই। সেদিক থেকে নিজেদের ব্যর্থতাকে পরিমাপের প্রয়োজনীয় এককও স্বাধীনতা।
ফলে নিজেদের সব অপ্রাপ্তি, অক্ষমতা, অরাজকতা, অগণতান্ত্রিক মানসিকতা সবকিছুকে বুঝে নিতে পারি স্বাধীনতার প্রশ্নেই। হয়তো জাতি হিসেবে স্বাধীন না হলে এ কথাগুলো নিজেদের সামনে এসে উপস্থিত হতো না। নিজেরা দাঁড়াতামই না এই কথার সামনে যে আমাদের জন্য, প্রয়োজনীয় প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা।
তবে সেসব কিছু অর্জনে আমাদের ব্যর্থতা প্রচুর। কখনও কখনও মনে হয়, হয়তো কোনো কিছুতেই কোনো দিনও আমরা অর্জন করতে পারব না সাফল্যের চূড়া। এগুলো জাতি হিসেবে নিজেদের ব্যর্থতা হয়তো কাঙালপনাকেই সামনে আনে; কিন্তু এর পেছনে সেই জেদও কমবেশি থাকে যে, স্বাধীনতা আমাদের দিয়েছে সেই বল, প্রাণে দিয়েছে সেই শক্তি_ যা আমাদের সব সম্ভাবনার তরীকে তীরে ভিড়িয়ে এক সোনারগাঁ নিয়ে উপস্থিত করবে।
হয়তো এই প্রত্যাশা প্রত্যাশাই। হয়তো এর অনেক কিছুই আশা। স্বপ্ন। স্বপ্ন দর্শনে ক্লান্ত আমাদের চোখ। হয়তো এত স্বপ্নের ভার আমরা আর বহন করতে পারছি না। হয়তো আমাদের মনের সেই জোর নেই। হয়তো জাতি হিসেবে এখনও আমরা সেই আত্মশক্তি অর্জন করিনি। হয়তো আমাদের জনমানসের সেই মানসিক অবস্থান তত দৃঢ় নয়। হয়তো আমাদের শিক্ষা আন্তর্জাতিক মানে নয়। এমন কত প্রকার হয়তো লেখা যায়। এমনকি অগুনতি তরুণ_ স্বাধীনতার বছর দশ কি পনেরো বছর বাদে জন্ম, সবে কর্মক্ষেত্রে ঢুকছে, বিশাল একখানা পৃথিবী হাঁ করে গিলে ফেলছে তাদের_ তারা বিশ্বায়নের সন্তান। সেই তাদের শক্তিতে, নবীন প্রাণ তরুণদের ওপরে আমাদের আস্থার ঘাটতি আছে বা ঘাটতি দেখা দেয়_ সবই সত্যি। কিন্তু তাদের সামনের পৃথিবীর দিকে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাওয়ার শক্তি জোগায় স্বাধীনতা। হয়তো সেখানে বা কোনোখানেই খুব আশাবাদী হওয়ার বিষয় ঘটুক বা না-ই ঘটুক, স্বাধীনতার প্রশ্নে তার চেতনা আর চৈতন্যের দৃঢ়তায় ঘাটতি নেই। ফলে স্বাধীনতা, স্বাধীনতাই। আজকের তরুণ প্রাণ যার সামনে যে বাংলাদেশ তাকে সে স্বপ্নহীন ভাবতে রাজি নয়। সে বাংলাদেশের ক্ষুধা আছে, দারিদ্র্য আছে; কিন্তু ওই তরুণ তাকে খুব স্বপ্নহীন ভাবে না।
এসব মিলে এই জনতা, এই তারুণ্য এসব কিছু যেমন স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচা জানে না, যেটা জানে না দেশের সত্তর ভাগ মানুষ। তাদের জন্ম স্বাধীনতার পরে। একই সঙ্গে শতেক প্রশ্ন আর সংকট সামনে থাকলেও স্বাধীনতা রক্ষিত হবে তার যোগ্য ফল ঘরে তোলার ভেতর দিয়ে_ এই আশায়ও বাঁচে সবাই।
ফলে ৪১তম স্বাধীনতা দিবসের মুখে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো এক স্বাবলম্বী বাংলাদেশের মুখ দেখা খুব দূরে নয় বলে মনে হয়। শ্রমজীবী বিত্তহীন মানুষ খুব খাটতে পারে, তরুণ যুদ্ধে যেতে পারে, স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারে_ এই সম্মিলিত প্রচেষ্টাই স্বাধীনতা অর্থবহ করে তুলবে।
চলি্লশে তরুণে পরিণত হয়, সমৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ নয় একটু দেরিতে তা অর্জন করছে, আশাহীন হওয়ার নয়। কারণ, স্বাধীনতা, স্বাধীনতাই_ সে যেমন হাত বাড়িয়ে নিঃশ্বাস নিতে দেয়, বাঁচতে দেয়, বাঁচতে শেখায়। জানায় অন্ন খুব স্বাদু, পথ প্রশস্ত। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশস্ত পথে আমাদের পথচলা সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক।

হ প্রশান্ত মৃধা :কথাসাহিত্যিক শিক্ষক

No comments

Powered by Blogger.