কালের পুরাণ-মানুষ কষ্টে আছে, সরকার কী করছে by সোহরাব হাসান
মন্ত্রীর চেয়ারে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা মনে করেন সবকিছু ঠিক আছে। দেশ ভালোভাবে চলছে। যাঁরা সরকারের সমালোচনা করছেন তাঁরা হয় নির্বোধ, না-হয় ষড়যন্ত্রকারী। এই যে স্বাভাবিক বৃষ্টিতে রাজধানীতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে, পবিত্র রমজানে দুঃসহ যানজটে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম, তাতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও হোমরাচোমরাদের কিছু
আসে-যায় না; আসে-যায় না ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বাসমালিকেরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডাকলেও। ওই রাস্তায় বাস কেন, এখন প্রাইভেট গাড়িও চলাচল করতে পারে না।
একটি লেখার ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় বৃহস্পতিবার সকালে। তিনি বললেন, ওই দিন তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি ত্রিশালে যাবেন; শুক্রবার আসবেন প্রথম আলোর কার্যালয়ে। শুক্রবার দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি গতকাল ত্রিশালে গিয়েছিলেন? বললেন, না, সকালে রওনা দিয়ে ছয় ঘণ্টা পর গাজীপুর থেকে ফিরে এসেছি। ভাবুন, মানুষের ভোগান্তিটা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগে শুনতাম বিরোধী দল হরতাল-অবরোধ ডেকে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু মহাজোট সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী এতটাই দক্ষ ও যোগ্য যে কেবল ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক নয়, সারা দেশেই সড়কগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ছয়-সাত বছর ধরে কাজ হয় না।
গতকালের পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকার সঙ্গে নয়টি জেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ। মহাখালী বাস টার্মিনালে আটকে পড়া কয়েক শ যাত্রী বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু জনগণের এই বিক্ষোভ ও দুর্ভোগ যোগাযোগমন্ত্রীকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হয় না। তিনি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের স্বপ্নে বিভোর। প্রায় প্রতিদিনই টেলিভিশনে তিনি জনগণকে ভবিষ্যতের মহাসড়ক, মহারেল ও মহাসেতুর খোয়াব দেখাচ্ছেন। ভবিষ্যতের সুখের জন্য বর্তমানকে উৎসর্গ করুন। বন্দী থাকুন। কী অদ্ভুত নিয়ম!
সারা দেশের মহাসড়কগুলোর এই দুঃসহ অবস্থা হলো কেন? যোগাযোগমন্ত্রী বলবেন, অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা দিচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় বলবে, বিশ্বব্যাংক টাকা আটকে দিয়েছে। কেন দিয়েছে? বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় না করলে বুঝতে হবে পুকুর নয়, সাগর চুরি হয়েছে।
মন্ত্রী মহোদয় কি চিন্তা করতে পারেন, এ রকম একটি মহাসড়ক বন্ধ থাকলে লাখ লাখ মানুষ কতখানি দুর্ভোগে পড়তে পারে। ১২ আগস্ট প্রথম আলো খবর দিয়েছে, এই মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করা প্রকল্পের দরপত্র জালিয়াতির কারণে গাজীপুর অংশে ৩০ দশমিক ২৫ কিলোমিটারের বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চীনা কোম্পানি দরপত্রে অংশ না নিলেও তাদের কাগজপত্র জাল করে কাজ বাগিয়ে নিয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রী সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিতও ছিলেন। অতএব জনগণের দুর্ভোগের দায় তাঁকে নিতে হবে।
এখন বর্ষাকাল চলছে। এই সময় রাস্তা মেরামত করলে তা টেকসই হবে না। রাস্তা ঠিক হবে না, কিন্তু টাকাটা পানিতে যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী খননের জন্য বর্ষাকালকে বেছে নেয়। কেননা বর্ষাকালে নদী খনন না করলেও উজানের পানিতেই নদীর তলদেশ অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ও রাস্তা মেরামতের জন্য এই বর্ষাকালকে মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে। ঢাকা মহানগরের বাসিন্দারা বর্ষাকালে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি দেখতে অভ্যস্ত। এখন তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এরই নাম ডিজিটাল মেরামত।
এই যে দুর্নীতি-অনিয়ম-অব্যবস্থা, সেটি কমবেশি চলছে সব মন্ত্রণালয়ে। দ্য ইকোনমিস্ট দ্বিতীয় দফায় সরকারের অর্থনৈতিক কাজের প্রশংসা করলেও দুর্নীতির কথা পুনরুল্লেখ করেছে, উল্লেখ করেছে বৈরী ও বিদ্বেষমূলক রাজনীতির কথাও। দুর্নীতি কোথায় নেই—কাবিখা, কাবিটা, ওএমএস থেকে শুরু করে বিমান কেনা। বিমান পরিচালনা পর্ষদের ভীষণ পছন্দ কাবোর বেহাল এয়ারক্রাফট। ভালো এয়ারক্রাফটে যাত্রীসেবা ভালো হলেও কমিশন কম, চুরি কম।
সহযোগী ইত্তেফাক খবর দিয়েছে, বেহাল সড়কের জন্য ট্রাকচালকদের পথেই জীবন কাটে। চার ঘণ্টার সড়ক পার হতে লাগে ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি। এই বাড়তি সময় মানে বাড়তি শ্রমঘণ্টা, বাড়তি জ্বালানি, বাড়তি কষ্ট। এর দায় কে নেবে? রেলওয়ে ঠিকঠাকমতো চললে মানুষ বিকল্প পথে যেত। কিন্তু সারা বিশ্বে যখন রেলওয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে, যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে, তখন বাংলাদেশে কমছে। কতিপয় বাসমালিকের সুবিধার জন্য রেলওয়ের সময়সূচি পরিবর্তনও করেছে কর্তৃপক্ষ। রেলকে মেরে বেসরকারি বাসমালিকদের বাঁচানো আর কি। জনদরদি সরকার আর কাকে বলে!
আমরা সাধারণ মানুষ, সমালোচনা করলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন সরকারের বিরুদ্ধে লেগেছে, সরকারের ভালো চায় না। তারা কথায় কথায় বিএনপির আমলের তুলনা দেন। বিএনপির আমলে খারাপ ছিল বলেই মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। এখন অতীতের তুলনা কেন? সামনে দৃষ্টি দিন। সময় বেশি হাতে নেই। ইতিমধ্যে দুই বছর সাড়ে সাত মাস চলে গেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, সরকারকে তিন মাস আগে ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে হাতে সময় আছে দুই বছর দুই মাস। রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া রোজার পর কঠিন আন্দোলনের ডাক দেবেন বলেছেন। কঠিন আন্দোলন মানে মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে, কষ্ট বাড়বে।
২০১২ সালটা কেমন যাবে? সেই কঠিন সময় পার করার দুটো বিকল্প আছে। এক. জনগণের অভাব-অভিযোগ আমলে নিয়ে সেগুলো মেটানোর চেষ্টা এবং নির্বাচনের ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসা। দ্বিতীয়টি হলো সংঘাতের পথ। সংঘাত জনদুর্ভোগ বাড়াবে। সরকারের জনপ্রিয়তা কমাবে।
জনগণ যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত, তখন ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী দল দুটির নেতারা ব্যস্ত আছেন ইফতার রাজনীতিতে। কে কাকে আগামী নির্বাচনে সঙ্গে পাবেন, সেই চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। পর্দার আড়ালে ও সামনে বৈঠকের মহড়া চলছে। বিএনপির আমলে জোটের বিপরীতে মহাজোট গঠিত হয়েছিল। এখন মহা জাতীয় জোট গঠনের প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু দেখে মনে হয়, আমাদের জনদরদি রাজনীতিকেরা বুঝে ফেলেছেন, দেশ বা জনগণ কিছু নয়, জনবিচ্ছিন্ন কয়েকজন নেতাকে কাছে টানতে পারলেই কেল্লা ফতে। সব ঠিক। তাঁরা জনগণকে বাদ দিয়ে নেতার ঐক্য করছেন।
মানুষ বড় কষ্টে আছে, দুঃখে আছে। সবচেয়ে বড় দুঃখ মন্ত্রী-নেতাদের নির্দয় কথাবার্তা। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে না পেরে বাণিজ্যমন্ত্রী মানুষকে কম খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। গণপিটুনিতে মানুষ মারা যাচ্ছে, পুলিশ নিরীহ লোকদের ধরে শায়েস্তা করছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। এ রকম উন্নতির গল্প বিএনপির আমলেও শোনানো হয়েছিল। জনগণ তার জবাবও দিয়েছে। সেই রকম জবাবের জন্য আওয়ামী লীগকে হয়তো দুই-আড়াই বছর অপেক্ষা করতে হবে।
সরকার বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হবে। বিরোধী দল বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে তারা যাবে না, নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। এরপর সরকার যদি নির্বাচন করার ব্যাপারে গোঁ ধরে, তাহলে ২০০৭ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এসব হুমকি আর পাল্টা-হুমকির মধ্যে আমজনতার দুঃখ-দুর্দশা চাপা পড়ে যাচ্ছে।
একটি দেশ, তার রাজনীতি ও রাজনীতিকেরা যদি পাঁচ বছর ধরে নির্বাচনী বিতর্কে জড়িয়ে যান, তার পরিণাম কী হতে পারে, ভাবুন। নেতাদের কথাবার্তা শুনলে, বক্তব্য-বিবৃতি দেখলে মনে হবে, দেশে আর কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচন করো। এক দলকে হটাও, আরেক দলকে ক্ষমতায় বসাও। তারপর পাঁচ বছর ধরে তার দুর্নীতি-দুরাচার সহ্য করো। এই পাঁচ বছর সরকারের কোনো সমালোচনা করা যাবে না। করলে দেশদ্রোহী বা ষড়যন্ত্রকারী হতে হবে। বিরোধী দলের সমালোচনা করা যাবে না। করলে তারা কালো তালিকায় নাম লেখাবে এবং ক্ষমতায় এসে যথাব্যবস্থা নেবে। আমরা আসলে গণতন্ত্রে বাস করছি না। যথাব্যবস্থায় দিনাতিপাত করছি। এখন যতটা খারাপ আছি, ভবিষ্যতে তার চেয়েও খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? আগে পুলিশ অপরাধী ধরতে নিষ্ক্রিয় থাকলেও সাধারণ মানুষ নিরাপদে চলাচল করতে পারত। এখন পুলিশই তাদের জন্য বিপদ হয়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের কথা গত লেখায় উল্লেখ করেছি। এবার নতুন যোগ হলো কোম্পানীগঞ্জের কিশোর মিলন। আমরা এত দিন জানতাম, গণপিটুনির হাত থেকে পুলিশ আক্রান্তকে উদ্ধার করে। এখন দেখছি পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ছেড়ে দিয়ে একজন নিরীহ-নিরপরাধ কিশোরের নৃশংস মৃত্যু-দৃশ্য উপভোগ করছে। দেশে আসলে চলছে ভোগ ও উপভোগের রাজনীতি। কোথাও কারও প্রতি সামান্য সহানুভূতি নেই। সহমর্মিতা নেই। ১৫-১৬ বছরের একটি কিশোর—তাকে সন্দেহবশত এভাবে জনতা পিটিয়ে মারতে পারে! সেদিন ওই বাজারে একটি মানুষও ছিল না যে তাকে উদ্ধার করে! এই রাষ্ট্র, এই সমাজ, এই পুলিশ, এই সরকার কী জবাব দেবে মিলনের মায়ের কাছে? প্রবাসী বাবার কাছে, যিনি পুত্রের কাছে টাকা পাঠিয়েছিলেন এক খণ্ড বাস্তুভিটা কিনতে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দাবি করছেন, তাঁরা জঙ্গিবাদ দমন করেছেন। জঙ্গিবাদ দমিত হওয়ায় মানুষ নিশ্চয়ই খুশি। কিন্তু দেশে জঙ্গিবাদই কি একমাত্র সমস্যা? বিএনপির আমলে ধর্মের নামে যে জঙ্গিগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, তারা নিবৃত্ত হলেও নতুন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে ক্ষমতার আশ্রয়ে। পৃথিবীতে সব মানুষের রক্তের রং যেমন এক, তেমনি সন্ত্রাসীর চেহারাও এক—হোক তা ধর্ম কিংবা দলের নামে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মাটি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে দেবেন না। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত বিদেশি সন্ত্রাসীদের কথাই বুঝিয়েছেন। কিন্তু দেশের মাটি দেশীয় সন্ত্রাসীরা যেভাবে ব্যবহার করে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য চালাচ্ছে, তা রোধ করবে কে?
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দায়িত্বশীল পদে থেকে কিছু ব্যক্তির কাণ্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তায় সরকার বিব্রত। পরিবহনসহ সারা দেশে চাঁদাবাজি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাস, ট্রাক, লঞ্চ টার্মিনালে চাঁদাবাজি উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। (ইত্তেফাক, ১১ আগস্ট) । একই কথা বলেছেন উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও। মন্ত্রীদের তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিহাস না করারও পরামর্শ দিয়েছেন।
বিরোধী দল কিংবা আমরা সাধারণ মানুষ সরকারের সমালোচনা করলে নির্ঘাত ষড়যন্ত্রকারী হয়ে যাব। কিন্তু যখন খোদ ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল নেতারা মন্ত্রীদের কঠোর সমালোচনা করেন, ব্যর্থতার দায় না নিয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে বলছেন, তখন কী বলবেন? তারাও কি ষড়যন্ত্রকারী? তারাও কি যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তাকারী? অতএব আয়নায় নিজের চেহারা দেখুন। অন্যের সমালোচনার আগে একবার ভাবুন, জনগণের কাছে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন, তার কতটা পূরণ করতে পেরেছেন, কতটা পারেননি।
দেশের মানুষ কষ্টে আছে। আপনারা কী করছেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
একটি লেখার ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় বৃহস্পতিবার সকালে। তিনি বললেন, ওই দিন তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি ত্রিশালে যাবেন; শুক্রবার আসবেন প্রথম আলোর কার্যালয়ে। শুক্রবার দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি গতকাল ত্রিশালে গিয়েছিলেন? বললেন, না, সকালে রওনা দিয়ে ছয় ঘণ্টা পর গাজীপুর থেকে ফিরে এসেছি। ভাবুন, মানুষের ভোগান্তিটা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগে শুনতাম বিরোধী দল হরতাল-অবরোধ ডেকে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু মহাজোট সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী এতটাই দক্ষ ও যোগ্য যে কেবল ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক নয়, সারা দেশেই সড়কগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ছয়-সাত বছর ধরে কাজ হয় না।
গতকালের পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকার সঙ্গে নয়টি জেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ। মহাখালী বাস টার্মিনালে আটকে পড়া কয়েক শ যাত্রী বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু জনগণের এই বিক্ষোভ ও দুর্ভোগ যোগাযোগমন্ত্রীকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হয় না। তিনি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের স্বপ্নে বিভোর। প্রায় প্রতিদিনই টেলিভিশনে তিনি জনগণকে ভবিষ্যতের মহাসড়ক, মহারেল ও মহাসেতুর খোয়াব দেখাচ্ছেন। ভবিষ্যতের সুখের জন্য বর্তমানকে উৎসর্গ করুন। বন্দী থাকুন। কী অদ্ভুত নিয়ম!
সারা দেশের মহাসড়কগুলোর এই দুঃসহ অবস্থা হলো কেন? যোগাযোগমন্ত্রী বলবেন, অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা দিচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় বলবে, বিশ্বব্যাংক টাকা আটকে দিয়েছে। কেন দিয়েছে? বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় না করলে বুঝতে হবে পুকুর নয়, সাগর চুরি হয়েছে।
মন্ত্রী মহোদয় কি চিন্তা করতে পারেন, এ রকম একটি মহাসড়ক বন্ধ থাকলে লাখ লাখ মানুষ কতখানি দুর্ভোগে পড়তে পারে। ১২ আগস্ট প্রথম আলো খবর দিয়েছে, এই মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করা প্রকল্পের দরপত্র জালিয়াতির কারণে গাজীপুর অংশে ৩০ দশমিক ২৫ কিলোমিটারের বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চীনা কোম্পানি দরপত্রে অংশ না নিলেও তাদের কাগজপত্র জাল করে কাজ বাগিয়ে নিয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রী সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিতও ছিলেন। অতএব জনগণের দুর্ভোগের দায় তাঁকে নিতে হবে।
এখন বর্ষাকাল চলছে। এই সময় রাস্তা মেরামত করলে তা টেকসই হবে না। রাস্তা ঠিক হবে না, কিন্তু টাকাটা পানিতে যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী খননের জন্য বর্ষাকালকে বেছে নেয়। কেননা বর্ষাকালে নদী খনন না করলেও উজানের পানিতেই নদীর তলদেশ অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ও রাস্তা মেরামতের জন্য এই বর্ষাকালকে মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে। ঢাকা মহানগরের বাসিন্দারা বর্ষাকালে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি দেখতে অভ্যস্ত। এখন তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এরই নাম ডিজিটাল মেরামত।
এই যে দুর্নীতি-অনিয়ম-অব্যবস্থা, সেটি কমবেশি চলছে সব মন্ত্রণালয়ে। দ্য ইকোনমিস্ট দ্বিতীয় দফায় সরকারের অর্থনৈতিক কাজের প্রশংসা করলেও দুর্নীতির কথা পুনরুল্লেখ করেছে, উল্লেখ করেছে বৈরী ও বিদ্বেষমূলক রাজনীতির কথাও। দুর্নীতি কোথায় নেই—কাবিখা, কাবিটা, ওএমএস থেকে শুরু করে বিমান কেনা। বিমান পরিচালনা পর্ষদের ভীষণ পছন্দ কাবোর বেহাল এয়ারক্রাফট। ভালো এয়ারক্রাফটে যাত্রীসেবা ভালো হলেও কমিশন কম, চুরি কম।
সহযোগী ইত্তেফাক খবর দিয়েছে, বেহাল সড়কের জন্য ট্রাকচালকদের পথেই জীবন কাটে। চার ঘণ্টার সড়ক পার হতে লাগে ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি। এই বাড়তি সময় মানে বাড়তি শ্রমঘণ্টা, বাড়তি জ্বালানি, বাড়তি কষ্ট। এর দায় কে নেবে? রেলওয়ে ঠিকঠাকমতো চললে মানুষ বিকল্প পথে যেত। কিন্তু সারা বিশ্বে যখন রেলওয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে, যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে, তখন বাংলাদেশে কমছে। কতিপয় বাসমালিকের সুবিধার জন্য রেলওয়ের সময়সূচি পরিবর্তনও করেছে কর্তৃপক্ষ। রেলকে মেরে বেসরকারি বাসমালিকদের বাঁচানো আর কি। জনদরদি সরকার আর কাকে বলে!
আমরা সাধারণ মানুষ, সমালোচনা করলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন সরকারের বিরুদ্ধে লেগেছে, সরকারের ভালো চায় না। তারা কথায় কথায় বিএনপির আমলের তুলনা দেন। বিএনপির আমলে খারাপ ছিল বলেই মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। এখন অতীতের তুলনা কেন? সামনে দৃষ্টি দিন। সময় বেশি হাতে নেই। ইতিমধ্যে দুই বছর সাড়ে সাত মাস চলে গেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, সরকারকে তিন মাস আগে ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে হাতে সময় আছে দুই বছর দুই মাস। রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া রোজার পর কঠিন আন্দোলনের ডাক দেবেন বলেছেন। কঠিন আন্দোলন মানে মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে, কষ্ট বাড়বে।
২০১২ সালটা কেমন যাবে? সেই কঠিন সময় পার করার দুটো বিকল্প আছে। এক. জনগণের অভাব-অভিযোগ আমলে নিয়ে সেগুলো মেটানোর চেষ্টা এবং নির্বাচনের ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসা। দ্বিতীয়টি হলো সংঘাতের পথ। সংঘাত জনদুর্ভোগ বাড়াবে। সরকারের জনপ্রিয়তা কমাবে।
জনগণ যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত, তখন ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী দল দুটির নেতারা ব্যস্ত আছেন ইফতার রাজনীতিতে। কে কাকে আগামী নির্বাচনে সঙ্গে পাবেন, সেই চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। পর্দার আড়ালে ও সামনে বৈঠকের মহড়া চলছে। বিএনপির আমলে জোটের বিপরীতে মহাজোট গঠিত হয়েছিল। এখন মহা জাতীয় জোট গঠনের প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু দেখে মনে হয়, আমাদের জনদরদি রাজনীতিকেরা বুঝে ফেলেছেন, দেশ বা জনগণ কিছু নয়, জনবিচ্ছিন্ন কয়েকজন নেতাকে কাছে টানতে পারলেই কেল্লা ফতে। সব ঠিক। তাঁরা জনগণকে বাদ দিয়ে নেতার ঐক্য করছেন।
মানুষ বড় কষ্টে আছে, দুঃখে আছে। সবচেয়ে বড় দুঃখ মন্ত্রী-নেতাদের নির্দয় কথাবার্তা। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে না পেরে বাণিজ্যমন্ত্রী মানুষকে কম খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। গণপিটুনিতে মানুষ মারা যাচ্ছে, পুলিশ নিরীহ লোকদের ধরে শায়েস্তা করছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। এ রকম উন্নতির গল্প বিএনপির আমলেও শোনানো হয়েছিল। জনগণ তার জবাবও দিয়েছে। সেই রকম জবাবের জন্য আওয়ামী লীগকে হয়তো দুই-আড়াই বছর অপেক্ষা করতে হবে।
সরকার বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হবে। বিরোধী দল বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে তারা যাবে না, নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। এরপর সরকার যদি নির্বাচন করার ব্যাপারে গোঁ ধরে, তাহলে ২০০৭ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এসব হুমকি আর পাল্টা-হুমকির মধ্যে আমজনতার দুঃখ-দুর্দশা চাপা পড়ে যাচ্ছে।
একটি দেশ, তার রাজনীতি ও রাজনীতিকেরা যদি পাঁচ বছর ধরে নির্বাচনী বিতর্কে জড়িয়ে যান, তার পরিণাম কী হতে পারে, ভাবুন। নেতাদের কথাবার্তা শুনলে, বক্তব্য-বিবৃতি দেখলে মনে হবে, দেশে আর কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচন করো। এক দলকে হটাও, আরেক দলকে ক্ষমতায় বসাও। তারপর পাঁচ বছর ধরে তার দুর্নীতি-দুরাচার সহ্য করো। এই পাঁচ বছর সরকারের কোনো সমালোচনা করা যাবে না। করলে দেশদ্রোহী বা ষড়যন্ত্রকারী হতে হবে। বিরোধী দলের সমালোচনা করা যাবে না। করলে তারা কালো তালিকায় নাম লেখাবে এবং ক্ষমতায় এসে যথাব্যবস্থা নেবে। আমরা আসলে গণতন্ত্রে বাস করছি না। যথাব্যবস্থায় দিনাতিপাত করছি। এখন যতটা খারাপ আছি, ভবিষ্যতে তার চেয়েও খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? আগে পুলিশ অপরাধী ধরতে নিষ্ক্রিয় থাকলেও সাধারণ মানুষ নিরাপদে চলাচল করতে পারত। এখন পুলিশই তাদের জন্য বিপদ হয়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের কথা গত লেখায় উল্লেখ করেছি। এবার নতুন যোগ হলো কোম্পানীগঞ্জের কিশোর মিলন। আমরা এত দিন জানতাম, গণপিটুনির হাত থেকে পুলিশ আক্রান্তকে উদ্ধার করে। এখন দেখছি পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ছেড়ে দিয়ে একজন নিরীহ-নিরপরাধ কিশোরের নৃশংস মৃত্যু-দৃশ্য উপভোগ করছে। দেশে আসলে চলছে ভোগ ও উপভোগের রাজনীতি। কোথাও কারও প্রতি সামান্য সহানুভূতি নেই। সহমর্মিতা নেই। ১৫-১৬ বছরের একটি কিশোর—তাকে সন্দেহবশত এভাবে জনতা পিটিয়ে মারতে পারে! সেদিন ওই বাজারে একটি মানুষও ছিল না যে তাকে উদ্ধার করে! এই রাষ্ট্র, এই সমাজ, এই পুলিশ, এই সরকার কী জবাব দেবে মিলনের মায়ের কাছে? প্রবাসী বাবার কাছে, যিনি পুত্রের কাছে টাকা পাঠিয়েছিলেন এক খণ্ড বাস্তুভিটা কিনতে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দাবি করছেন, তাঁরা জঙ্গিবাদ দমন করেছেন। জঙ্গিবাদ দমিত হওয়ায় মানুষ নিশ্চয়ই খুশি। কিন্তু দেশে জঙ্গিবাদই কি একমাত্র সমস্যা? বিএনপির আমলে ধর্মের নামে যে জঙ্গিগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, তারা নিবৃত্ত হলেও নতুন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে ক্ষমতার আশ্রয়ে। পৃথিবীতে সব মানুষের রক্তের রং যেমন এক, তেমনি সন্ত্রাসীর চেহারাও এক—হোক তা ধর্ম কিংবা দলের নামে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মাটি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে দেবেন না। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত বিদেশি সন্ত্রাসীদের কথাই বুঝিয়েছেন। কিন্তু দেশের মাটি দেশীয় সন্ত্রাসীরা যেভাবে ব্যবহার করে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য চালাচ্ছে, তা রোধ করবে কে?
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দায়িত্বশীল পদে থেকে কিছু ব্যক্তির কাণ্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তায় সরকার বিব্রত। পরিবহনসহ সারা দেশে চাঁদাবাজি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাস, ট্রাক, লঞ্চ টার্মিনালে চাঁদাবাজি উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। (ইত্তেফাক, ১১ আগস্ট) । একই কথা বলেছেন উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও। মন্ত্রীদের তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিহাস না করারও পরামর্শ দিয়েছেন।
বিরোধী দল কিংবা আমরা সাধারণ মানুষ সরকারের সমালোচনা করলে নির্ঘাত ষড়যন্ত্রকারী হয়ে যাব। কিন্তু যখন খোদ ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল নেতারা মন্ত্রীদের কঠোর সমালোচনা করেন, ব্যর্থতার দায় না নিয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে বলছেন, তখন কী বলবেন? তারাও কি ষড়যন্ত্রকারী? তারাও কি যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তাকারী? অতএব আয়নায় নিজের চেহারা দেখুন। অন্যের সমালোচনার আগে একবার ভাবুন, জনগণের কাছে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন, তার কতটা পূরণ করতে পেরেছেন, কতটা পারেননি।
দেশের মানুষ কষ্টে আছে। আপনারা কী করছেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments