সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা কাদের টার্গেট? by মমতাজ লতিফ

যে সমাজ উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্তের নারী ঢাবি শিক্ষককে খুনি-বর্বর স্বামীর হাত থেকে রক্ষা করে না_ শিক্ষিত করার পাশাপাশি সে সমাজকে 'মানুষ' করা, মানবিক করা খুব বেশি প্রয়োজন লিমন প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক মাধ্যমিক পাস করে।


আরও কমসংখ্যক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়। এর চেয়েও কমসংখ্যক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
প্রথমেই সংঘটিত হয়েছে লিমন নামের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে 'সন্ত্রাসী' নামকরণ করে র‌্যাব কর্তৃক গুলি করার ঘটনাটি। সে দৃঢ়তার সঙ্গে অপরাধের সঙ্গে যে তার কোনো সম্পৃক্তি নেই, তা বারবার বলতে পারছে।
এরপর সংঘটিত হলো মিরসরাইয়ে প্রথম প্রজন্মের উঠতি মেধাবী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থীর দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা। প্রথম প্রজন্মের অর্ধশতাধিক স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীর মফস্বলের যে পথে এমনিই যান চলাচল কম, সেখানে যেসব ব্যাখ্যা দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বেরিয়ে আসছে, সেসব যথেষ্ট বলে মনে হয় না। ট্রাকে করে, যা প্রকৃতপক্ষে একটি ছোট পিকআপ ভ্যান, সেটিতে পঞ্চাশ-ষাট জন শিশু-কিশোর-তরুণকে তোলা সম্ভব হলো কীভাবে_ এটি একটি বড় প্রশ্ন। তাদের শিক্ষকরা তাদের সঙ্গে নেই কেন_ এটি আরও বড় প্রশ্ন। দরিদ্র নিরক্ষর বাবা-মায়েদের সন্তানদের বর্তমান সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা, বৃত্তি, পাঠ্যবই ছাড়াও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাক_ এটাই কি কোনো অশুভ শক্তি চাচ্ছে?
শবেবরাতের রাতটিকে বাছাই করে সাত তরুণ শিক্ষার্থীকে একবার 'মাদকসেবী' এরপর 'ডাকাত', তাও আবার মাত্র ৫০০০ টাকার জন্য, সাজিয়ে বর্বরতার চরম নিদর্শন হিসেবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো কেন? এদের মৃত্যু শুধু তো পরিবারের জন্য চির শোক নয়, এটি একদিকে আধুনিক শিক্ষাকে আঘাত করেছে, অপরদিকে 'আইন-শৃঙ্খলার অবনতি' প্রমাণ করতে এ নির্মম ঘটনাটি পশু হয়ে ওঠা এ সমাজেরই কাজ নয় কি? মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়া তরুণটিকে দিয়ে কি এদের ডেকে নেওয়া হয়েছিল? কেন সে প্রথমে বলল_ তারা 'নেশা' করতে গিয়েছিল? কে না জানে কল্যাণপুর, দারুসসালাম, মিরপুর, এমনকি গুলশান পর্যন্ত মাদকে সয়লাব। তাও আবার শবেবরাতের রাতটিকে বাছাই করা হলো নেশা খাওয়ার জন্য, যে রাতকে প্রকৃত নেশাখোররাও বাছাই করে না।
পরপরই 'লিমন' ইস্যু থেকে দ্রুত 'মিরসরাই' ইস্যু তৈরি হলো; এর পরপরই 'আমিনবাজার' ছাত্রহত্যা ইস্যু এবং এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবদুল কাদেরকে 'ডাকাত' চিহ্নিত করা, পায়ে চাপাতির কোপ, মারধর, থানায় আটক, সবশেষে 'ডাকাতির' ও 'অস্ত্রের' মামলা রুজু হলো।
পাঠক, ভালো করে যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে এই পরপর ঘটে যাওয়া অপঘটনাগুলোকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এদের মধ্যে কতগুলো মিল রয়েছে।
_অপঘটনাগুলোর শিকার সবাই প্রায় প্রথম প্রজন্মের মেধাবী শিক্ষার্থী।
_গণপিটুনিকে ব্যবহার করা হয়েছে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি প্রদর্শন করতে।
_নির্দিষ্ট কিছু পুলিশ সদস্য এসব অপঘটনা ঘটানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এটিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে_ হঠাৎ করে স্কুলের পিতৃতুল্য শিক্ষকরা কিশোরী ছাত্রীর ধর্ষকে পরিণত হচ্ছে! পরপর একাধিক শিক্ষকের এ ধরনের জঘন্য কাজের সংবাদ পত্রিকায় আসছে। পুলিশ, ব্যবসায়ী, গ্রাম্য মাতবর বা অন্য কেউ নয়, শিক্ষার্থীর ওপর আঘাত যখন আসছে তখন একই সঙ্গে শিক্ষকদেরও 'নরপশু'রূপে দেখা যাচ্ছে। কেন? কেন এ সময়েই একজন সফল শিক্ষিকা, উদয়ন স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ, মুক্তিযোদ্ধা শহীদ চিকিৎসক আলিম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর বাড়ির ভেতর ঢুকে গুণ্ডা ক্যাডারের দল চালককে মারধর করে পিস্তল দেখিয়ে চাবি নিয়ে গাড়িটি চালিয়ে চলে গেল? তিনি আজ ৪০ বছর ধরে একাত্তরে স্বামী ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা এবং নাগরিকের খুনিদের বিচার চেয়ে আসছেন। ৪০ বছর পর তিনি এখন টার্গেট হলেন কেন? সে জন্য এখন কী কী হচ্ছে, সেসবের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ারও প্রয়োজন আছে। দেশে ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা শুরু হয়েছে এবং এতে হাওয়া ভবন কর্তাসহ বিএনপি-ধর্মীয় জঙ্গি, যারা জামায়াতের সৃষ্টি, তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
কোকোর বিরুদ্ধে ঘুষের মামলা শুরু হয়েছে। দশ ট্র্রাক অস্ত্র মামলায় উচ্চস্তরের চারদলীয় জোট মন্ত্রী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, জামায়াত নেতা, বিএনপি নেতা ও সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া শাহ কিবরিয়া, ছায়ানটের বর্ষবরণে হামলা, উদীচী, সিপিবির সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের পুনর্তদন্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যাতে মূল আসামিদের নাম বেরিয়ে আসবে। কর্নেল তাহের হত্যায় জিয়ার যুদ্ধাপরাধীর মুখ উদ্ঘাটিত হয়েছে।
আমাদের চারধারের সমাজকে দেখে হতাশা বোধ করি। যে সমাজে প্রতিবেশী প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পুকুরে বিষ ঢেলে মাছ হত্যা করতে পারে, হাজার হাজার ফলবান বৃক্ষ নিধন করে সংখ্যালঘুর ভূমি গ্রাসের জন্য তাদের পুত্র-সন্তানকে হত্যা করে, তাদের নারীদের ধর্ষণ করে দেশত্যাগে বাধ্য করে, এমনকি যে সমাজ প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক বড় এনজিও কর্মকর্তা নাসরিন হককে তার দীর্ঘদিনের চালককে দিয়ে খুন করাতে পারে, যে সমাজ উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্তের নারী ঢাবি শিক্ষককে খুনি-বর্বর স্বামীর হাত থেকে রক্ষা করে না_ শিক্ষিত করার পাশাপাশি সে সমাজকে 'মানুষ' করা, মানবিক করা খুব বেশি প্রয়োজন।

মমতাজ লতিফ : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.