চরাচর-তাদের জীবনচিত্র বদলায় না by দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
পহেলা মে ছিল মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও পালন করা হয়েছে দিবসটি। দিবসটি পালন উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বের করা হয়েছিল মিছিল ও শোভাযাত্রা।
কোথাও কোথাও আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। আজও আমাদের সমাজে শ্রমিকরা খুবই অবহেলিত_এ সত্য অস্বীকার করা কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামও করতে পারে না। এ বছর মে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, 'শ্রমিক-মালিক সম্প্রীতি, বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি'। আমরা যদি চাশিল্পের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, শতাব্দী প্রাচীন এই শিল্পটিকে যারা টিকিয়ে রেখেছে, কত করুণ সেই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের তথা চা শ্রমিকদের জীবনযাপন। মে দিবস সফল করতে প্রতিবছরের মতো এবারও চা শ্রমিকরা নানা আয়োজন করেছিল। অথচ নির্মম বাস্তবতা হলো, আজও তাদের জীবন-মানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। দেড় শ বছর ধরে নির্যাতন-নিপীড়ন ও শোষণের জাঁতাকলেই পিষ্ট হচ্ছে তাদের জীবন। বিদ্যমান বাস্তবতায় বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য যে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক হাজিরা (মজুরি) ৪৮ টাকা। বাংলাদেশে ১৬৫টি চা বাগানে প্রায় পাঁচ লাখ চা শ্রমিকের বসবাস। দিন দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়ছে না তাদের মজুরি। মে দিবস উপলক্ষে চা শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় শ্রীমঙ্গল লেবার হাউসে আলোচনা সভায় তারা কোনো বিলাসী জীবন নয়, শুধু দুই বেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য তাদের মজুরি নূ্যনতম ২০০ টাকা নির্ধারণের দাবি জানায়। চা শ্রমিকদের কাজের স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতাসহ কোনো মৌলিক অধিকারই তারা ভোগ করতে পারে না। চরমভাবে নির্যাতিত-নিপীড়িত চা শ্রমিকদের দেখলে মনে হয়, মধ্যযুগীয় দাসপ্রথার চেয়েও নির্মম-নিষ্ঠুর তাদের জীবনযাপন। সরকার যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তখন পর্বতসম বৈষম্যের নিচে চাপা পড়ে আছে চা শ্রমিকরা। অন্যান্য শিল্পের মতো চা শ্রমিকদের জন্যও ১৯৬২ সালের বাগান আইন, ১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ মাতৃকল্যাণ আইনে (চা বাগান আইন) বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, চিত্তবিনোদন, শিশু নিবাস, শিক্ষার সুযোগ, গৃহনির্মাণ_এসব বিষয় নিশ্চিতকরণসহ শিশুশ্রম নিষিদ্ধ এবং প্রসূতিদের সবেতন ছুটির ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু চা শ্রমিকদের এসব সুযোগ-সুবিধা কেবল কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর কোনোটাই তারা ভোগ করতে পারছে না। গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য সভা-সেমিনার হয়। কিন্তু গার্মেন্ট শ্রমিকদের চেয়ে শতগুণ নির্যাতিত চা শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলার যেন কেউ নেই। একজন শ্রমিকের যেসব অধিকার ভোগ করার কথা, এর নূ্যনতমও তারা ভোগ করতে পারে না। অথচ শতাব্দী প্রাচীন এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রেখেছে চা শ্রমিকরাই। চা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দ্বিতীয় পণ্য। মনে রাখা দরকার, চা শ্রমিকরা বাঁচলে চা বাগান বাঁচবে। চা বাগান বাঁচলে আমরা উপার্জন করতে পারব বৈদেশিক মুদ্রা। তাহলে কেন বদলায় না তাদের জীবনচিত্র? অধিকার নিশ্চিত করে তাদের প্রতি যথাযথ মানবিক হলে এর ইতিবাচক প্রভাব হবে বহুমুখী_এটুকু অনুধাবন করতে পারলেই মঙ্গল।
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
No comments