চারদিক-জাতীয় পতাকা উৎসব by নাজমুল হোসেন
জাতীয় পতাকা স্বাধীনতার চেতনার প্রতীক। এক টুকরো লাল-সবুজের মাঝেই বাংলাদেশের পরিচিতি। জাতিসংঘ সদর দপ্তর অথবা নাইরোবি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে যখন লাল-সবুজের ঝান্ডা আকাশে ওড়ে, তখন তা বাংলাদেশকেই ধারণ করে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট, অলিম্পিক কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমাদের জাতীয় পতাকা দেখলে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এই ত্রয়ের যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সব আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় পতাকা নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহের কমতি নেই। আর সেই আগ্রহকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং এই প্রজন্মের কাছে জাতীয় পতাকার মূল্য তুলে ধরতেই আয়োজন করা হয়েছে দুদিনব্যাপী জাতীয় পতাকা উৎসব।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে পটুয়া কামরুল হাসান পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দেন। কারণ, মানচিত্রের কারণে পতাকা বিকৃত হতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে বঙ্গবন্ধু ওই নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নেন দেশ স্বাধীন করতে সশস্ত্র আন্দোলন করতে হবে। সে লক্ষ্যে ‘১৫ ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি ব্রিগেড গঠিত হয় সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে। নাম দেওয়া হয় ‘জয়বাংলা’ বাহিনী। জয়বাংলা বাহিনীর জন্য প্রয়োজন হয় একটি পতাকা। নির্দিষ্ট দিবস সামনে রেখে পতাকা তৈরিও সম্পন্ন হয়।
পতাকার আকার ও রং কী হবে, এ নিয়ে ছাত্রনেতারা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। একপর্যায়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আলোচনার একপর্যায়ে শাজাহান সিরাজ প্রস্তাব করলেন, পতাকার মধ্যে অবশ্যই লাল রং থাকতে হবে। আ স ম আবদুর রব বললেন, তাহলে জমিনটা হতে হবে সুবজ। মার্শাল মণি বললেন, তাহলে গাঢ় সবুজ রং দাও। কাজী আরেফ আহমেদ বললেন, এর সঙ্গে বাংলাদেশের মানচিত্র বসিয়ে দাও। এ সময় ছাত্রনেতা খসরু রাত দেড়টায় নিউমার্কেট থেকে কালি, তুলি ও কাপড় কিনে আনেন।
শিবনারায়ণ দাস এস এম হলে থাকতেন। রাত ১২টার দিকে তিনি আসেন ও পতাকার ডিজাইন তৈরির কাজে মনোযোগ দেন। ভোরে যখন পুবের আকাশে সূর্য লাল হয়ে উঠল, তখনই পতাকা তৈরির কাজ শেষ হয়। ছাত্রনেতারা ভোরের রক্তিম সূর্যের সঙ্গে পতাকাটি মিলিয়ে দেখেন। পতাকাটি সেদিন পেঁচিয়ে ঘরে রেখে দেওয়া হয় নিরাপত্তাজনিত কারণে। এই পতাকাটি ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওড়ানো হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জানলাম জাতীয় পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত সামষ্টিক ছিল, কিন্তু সম্মিলিত সিদ্ধান্তের রূপকার চিলেন শিব নারায়ন দাশ। খুব কমসংখ্যক লোকই এ নামের সঙ্গে পরিচিত।
জাতীয় পতাকা উৎসব নিয়ে দুই মাস ধরে কাজ করছি। ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছি। আগ্রহবশত গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। মণিপুরিপাড়ায় তাঁর বাসায় গিয়ে জাতীয় পতাকা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম। বসতে বললেন ড্রইংরুমে। অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলো।
শিবনারায়ণ দাশের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ী থানায়। কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র হলেও ১৯৬২ সালে পরীক্ষা দিতে পারেননি। কলেজিয়েট স্কুল থেকে পরের বছর এসএসসি পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএ পাস করেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি নেন। কুমিল্লার সন্তান শিবনারায়ণ দাসের রাজনীতির হাতেখড়ি ধীরেন্দ্রনাথের হাত ধরে। রাজনীতির ময়দানে দ্রুত ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেন। একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ছিলেন কুমিল্লা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর আক্রোশের শিকার হয়ে হারিয়েছেন তাঁর বাবাকে। তাঁর শহীদ বাবার মৃতদেহ খুঁজে পাননি। তার পরও পিছু হটেননি শিবনারায়ণ দাস। জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। কিন্তু গত ৪০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাঁর হাতে মুক্তিযোদ্ধার সনদ তুলে দিয়েছে। আমরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
আরেকটি প্রশ্ন। গত ৪০ বছর কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর রেওয়াজ চালু হয়নি? আমার স্কুল ছিল রংপুরে। স্কুলে যখন পড়তাম সকালে কুচকাওয়াজে যোগ দিতাম। দেখতাম জাতীয় সংগীত গেয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো। এখনো আমার স্কুলে এই রীতি বহাল। কিন্তু জাতীয় পতাকার উৎপত্তিস্থলে পড়তে এসে এই প্রশ্নটি মনে ঘুরপাক খেত। বিশেষ দিবস ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না, এ নিয়ে নানামুখী ব্যাখ্যা। অদ্ভুত যুক্তি শুনে সন্তুষ্ট হতে পারতাম না। প্রথম জাতীয় পতাকা উৎসবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে এ প্রশ্নটি করেছিলাম।
কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? ধন্যবাদ জানাই দৈনিক প্রথম আলোকে। তারা এই বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করার পর নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অবশেষে সিন্ডিকেট এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এখন প্রশাসনিক ভবন ও উপাচার্যের বাসভবনে প্রতি কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রতিবার রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি দুই পতাকা; জাতীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। পতপত করে উড়ছে পরস্পর। প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিই।
নাজমুল হোসেন
Pressfreedom1971@gmail.com
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এই ত্রয়ের যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সব আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় পতাকা নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহের কমতি নেই। আর সেই আগ্রহকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং এই প্রজন্মের কাছে জাতীয় পতাকার মূল্য তুলে ধরতেই আয়োজন করা হয়েছে দুদিনব্যাপী জাতীয় পতাকা উৎসব।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে পটুয়া কামরুল হাসান পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দেন। কারণ, মানচিত্রের কারণে পতাকা বিকৃত হতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে বঙ্গবন্ধু ওই নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নেন দেশ স্বাধীন করতে সশস্ত্র আন্দোলন করতে হবে। সে লক্ষ্যে ‘১৫ ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি ব্রিগেড গঠিত হয় সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে। নাম দেওয়া হয় ‘জয়বাংলা’ বাহিনী। জয়বাংলা বাহিনীর জন্য প্রয়োজন হয় একটি পতাকা। নির্দিষ্ট দিবস সামনে রেখে পতাকা তৈরিও সম্পন্ন হয়।
পতাকার আকার ও রং কী হবে, এ নিয়ে ছাত্রনেতারা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। একপর্যায়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আলোচনার একপর্যায়ে শাজাহান সিরাজ প্রস্তাব করলেন, পতাকার মধ্যে অবশ্যই লাল রং থাকতে হবে। আ স ম আবদুর রব বললেন, তাহলে জমিনটা হতে হবে সুবজ। মার্শাল মণি বললেন, তাহলে গাঢ় সবুজ রং দাও। কাজী আরেফ আহমেদ বললেন, এর সঙ্গে বাংলাদেশের মানচিত্র বসিয়ে দাও। এ সময় ছাত্রনেতা খসরু রাত দেড়টায় নিউমার্কেট থেকে কালি, তুলি ও কাপড় কিনে আনেন।
শিবনারায়ণ দাস এস এম হলে থাকতেন। রাত ১২টার দিকে তিনি আসেন ও পতাকার ডিজাইন তৈরির কাজে মনোযোগ দেন। ভোরে যখন পুবের আকাশে সূর্য লাল হয়ে উঠল, তখনই পতাকা তৈরির কাজ শেষ হয়। ছাত্রনেতারা ভোরের রক্তিম সূর্যের সঙ্গে পতাকাটি মিলিয়ে দেখেন। পতাকাটি সেদিন পেঁচিয়ে ঘরে রেখে দেওয়া হয় নিরাপত্তাজনিত কারণে। এই পতাকাটি ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওড়ানো হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জানলাম জাতীয় পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত সামষ্টিক ছিল, কিন্তু সম্মিলিত সিদ্ধান্তের রূপকার চিলেন শিব নারায়ন দাশ। খুব কমসংখ্যক লোকই এ নামের সঙ্গে পরিচিত।
জাতীয় পতাকা উৎসব নিয়ে দুই মাস ধরে কাজ করছি। ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছি। আগ্রহবশত গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। মণিপুরিপাড়ায় তাঁর বাসায় গিয়ে জাতীয় পতাকা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম। বসতে বললেন ড্রইংরুমে। অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলো।
শিবনারায়ণ দাশের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ী থানায়। কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র হলেও ১৯৬২ সালে পরীক্ষা দিতে পারেননি। কলেজিয়েট স্কুল থেকে পরের বছর এসএসসি পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএ পাস করেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি নেন। কুমিল্লার সন্তান শিবনারায়ণ দাসের রাজনীতির হাতেখড়ি ধীরেন্দ্রনাথের হাত ধরে। রাজনীতির ময়দানে দ্রুত ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেন। একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ছিলেন কুমিল্লা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর আক্রোশের শিকার হয়ে হারিয়েছেন তাঁর বাবাকে। তাঁর শহীদ বাবার মৃতদেহ খুঁজে পাননি। তার পরও পিছু হটেননি শিবনারায়ণ দাস। জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। কিন্তু গত ৪০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাঁর হাতে মুক্তিযোদ্ধার সনদ তুলে দিয়েছে। আমরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
আরেকটি প্রশ্ন। গত ৪০ বছর কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর রেওয়াজ চালু হয়নি? আমার স্কুল ছিল রংপুরে। স্কুলে যখন পড়তাম সকালে কুচকাওয়াজে যোগ দিতাম। দেখতাম জাতীয় সংগীত গেয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো। এখনো আমার স্কুলে এই রীতি বহাল। কিন্তু জাতীয় পতাকার উৎপত্তিস্থলে পড়তে এসে এই প্রশ্নটি মনে ঘুরপাক খেত। বিশেষ দিবস ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না, এ নিয়ে নানামুখী ব্যাখ্যা। অদ্ভুত যুক্তি শুনে সন্তুষ্ট হতে পারতাম না। প্রথম জাতীয় পতাকা উৎসবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে এ প্রশ্নটি করেছিলাম।
কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? ধন্যবাদ জানাই দৈনিক প্রথম আলোকে। তারা এই বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করার পর নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অবশেষে সিন্ডিকেট এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এখন প্রশাসনিক ভবন ও উপাচার্যের বাসভবনে প্রতি কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রতিবার রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি দুই পতাকা; জাতীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। পতপত করে উড়ছে পরস্পর। প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিই।
নাজমুল হোসেন
Pressfreedom1971@gmail.com
No comments