ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প-দেশের স্বার্থ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে

আবার বিপত্তিতে বাংলাদেশ। মরুকরণের আশঙ্কাও এখন আরো বাস্তব। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোর গতিপথ কৃত্রিমভাবে বদলে ফেলা হলে, প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হলে, এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বেই। সেই প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সেটা ভেবে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না।


ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে অভিন্ন নদীগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়ে জটিলতা কম নেই। ফারাক্কার প্রভাব আমাদের পরিবেশের ওপর পড়েছে। তিস্তা নিয়ে কোনো সমঝোতায় যাওয়া এখনো সম্ভব হয়নি। ওদিকে বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন জটিলতা। এখন অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহ লিংক ক্যানাল বা সংযোগ খালের মাধ্যমে অন্যদিকে প্রবাহিত করা হবে। অন্যকথায় বলা যায়, নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
ভারতের এই প্রকল্পটি একেবারে নতুন নয়। অটল বিহারি বাজপেয়ী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তখন এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। সেই টাস্কফোর্স একটি প্রতিবেদনও দিয়েছিল ভারত সরকারের কাছে। ওই সময় টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়, তা হচ্ছে- ১৬টি সংযোগ খাল দিয়ে ভারতের ৩৮টি নদ-নদীর মধ্যে আন্তসংযোগ ঘটানো হবে। পাশাপাশি অনেক জলাধার নির্মাণ করা হবে। সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান ও তামিলনাড়ু এলাকায়। এতে গঙ্গায় যে পানি সংকট হবে, তা পূরণ করা হবে ব্রহ্মপুত্রের পানি দিয়ে। এভাবে মোট ১৭৪ বিলিয়ন কিউসেক পানি খরাপীড়িত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে। টাস্কফোর্সের সেই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভারতের ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের সুবিধা হবে। এসব জমিতে সব রকম ফসল ফলানো সম্ভব হবে। এই প্রকল্প নিয়ে ভারত আগ্রহী হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের আপত্তিসহ নিজ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের আপত্তির মুখে পড়ে ভারত গত এক দশক এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের উচ্চ আদালত আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প যথাযথ সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার আদেশ দেওয়ায় নতুন করে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আদালতের রায় ভারত কার্যকর করতে গেলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প একটি বড় বিষয়। এটা বাস্তবায়ন করতে ভারতের ৫০ বছর সময় লাগবে। যেহেতু নদীর পানি সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়েই ভাবতে হবে। প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদি হলেও বাংলাদেশের জন্য এটা গবেষণার বিষয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের তিন প্রধান নদী গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে এখনো পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি কোনো বাধার মুখে পড়েনি। অভিন্ন নদীগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পানি বাংলাদেশে আসে। আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এ নদীটি ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন আছে। আছে জাতিসংঘ সনদ। এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ ধারণা করতে পারে, ভারত ইচ্ছা করলেই একতরফাভাবে অভিন্ন নদীগুলোর ওপর আন্তনদী সংযোগের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। বিশেষ করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে প্রথমবারের মতো সিদ্ধান্ত নেন, অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা করবে দুই দেশ। কিন্তু যেখানে আদালতের একটি রায় রয়েছে, সেখানে কতটুকু কার্যকর হবে এসব সিদ্ধান্ত, তা ভাবার বিষয়।
আমরা আস্থা রাখতে চাই ভারত সরকার ও সেখানকার উচ্চ আদালতের ওপর। বিশেষ করে এই নদী প্রত্যাহারের প্রভাব যখন সেই দেশের বিভিন্ন রাজ্যে পড়বে, তখন ভারত সরকার ও আদালতকে বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। বিশেষত মানবিক বিপর্যয়ের দিকটি তো আদালতকে বিবেচনা করতেই হবে।

No comments

Powered by Blogger.