আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-২৩)-অমৃতের মতো ... by আলী যাকের
গেণ্ডারিয়ায় থাকতে ঘটনাচক্রে ভাইয়ার সঙ্গে ব্রজেন দাস ওরফে ব্রজেনদার পরিচয়। ব্রজেনদার একটা ডাকনাম ছিল। লাড্ডুদা। আমরা সেই নামেই ডাকতাম। লাড্ডুদা ছিলেন পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু, আধাডজন বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন এবং তাঁর অনেক বাংলাদেশি,
ভারতীয় এবং ভিনদেশি ছাত্রছাত্রীকে তিনি সাহায্য করেছেন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে। তবে সে কথা পরে। ব্রজেনদার সঙ্গে পরিচয়ের পর ভাইয়া বললেন যে ব্রজেনদা গেণ্ডারিয়া স্টেশনের পাশে যতীন দাসের দিঘিতে সাঁতার প্র্যাকটিস করবেন। তাঁর চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট হবেন ভাইয়া স্বয়ং। আমাদের হবে সহায়ক ভূমিকা। সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে ব্রজেনদা একটা বাইসাইকেলে করে সকাল সকাল যতীন দাসের দিঘিতে হাজির হয়ে যেতেন। সঙ্গে থাকত গোল করে বাঁধা লম্বা পাটের দড়ি। যেটির মাপ ছিল ২০০ মিটার। ব্রজেনদা পানিতে নেমেই মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত 'ভুড়ুৎ' শব্দ করে সাঁতার কাটতে আরম্ভ করতেন। আমাদের কাজ ছিল তিনি কতবার ওই দীর্ঘ দিঘি পার হলেন তার একটা হিসাব রাখা, তাঁর সঙ্গে মাঝেমধ্যে সাঁতারে সঙ্গ দেওয়া এবং সাঁতার শেষে তিনি কত দূরত্ব অতিক্রম করলেন তা ওই দড়ি দিয়ে মেপে তাঁকে জানানো। এভাবে তাঁর অনুশীলনের শুরু। এসব অনুশীলনের মাঝে ব্রজেনদা আমাদের হাতে ধরে শিখিয়েছেন কিভাবে ফ্রি স্টাইল সাঁতারে হাত ঘোরাতে হয়, দম নিতে হয়, নিঃশ্বাস ছাড়তে হয় ইত্যাদি। যেদিন লাড্ডুদা আমাদের কাজে খুশি হতেন, সেদিন তিনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে তৎকালীন নর্থব্রুক হল রোডে (বাংলাবাজারের কাছে) একটি চায়ের দোকানে গিয়ে ডিম অমলেট আর ছানা খাওয়াতেন। আমরা ওই পুরস্কারের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম এবং তাঁর সঙ্গে আরো বেশি পরিশ্রম করতাম দ্বিগুণ অনুপ্রাণিত হয়ে।
মাসখানেকের মধ্যে আমরা এসব ব্যাপারে দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম। অবলীলায় তখনকার প্রমত্ত বুড়িগঙ্গা পার হয়ে যাই। এই সেদিন পূতিগন্ধময় বুড়িগঙ্গার ওপর একটা লঞ্চের দোতলায় বসে ভাবছিলাম আমাদের কৈশোর ও যৌবনের বুড়িগঙ্গার কী হাল হয়েছে আজ? যাকগে সেসব কথা। ব্রজেনদা যে শেষ পর্যন্ত অত বড় মাপের সাঁতারু হবেন, সেটা আমি কল্পনাও করিনি। কিছুদিনের মধ্যে আমরা জানতে পারলাম যে এবারের পাকিস্তান অলিম্পিক ঢাকায় হতে যাচ্ছে এবং ব্রজেনদা সেই অলিম্পিকে ১০০ ও ৪০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে অংশ নেবেন। আমরা শুনে খুবই উৎফুল্ল হলাম, যদিও ভাইয়া বললেন যে এই অলিম্পিকে ব্রজেনদার জয়ী হওয়া দুষ্কর। কেননা তাঁর প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাঁতারু হাবিলদার মোহাম্মদ রমজান, যার দৈর্ঘ্য ছয় ফুট তিন ইঞ্চি এবং তিনি তখন উভয় সাঁতারে পাকিস্তান রেকর্ডের অধিকারী। তবে বাঙালির তো একটি ব্যাপার আছে। তারা কখনো হতোদ্যম হতে জানে না। যা কিছু সত্য বলে জানে, তার জন্য মরণপণ যুদ্ধ করতেও তারা প্রস্তুত। লাড্ডুদা লেগে গেলেন দিনে ১০ ঘণ্টা প্র্যাকটিসে। প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালীই হোক, তাঁকে আমরা হারাবই_এই উদ্যম নিয়ে আমরাও লাড্ডুদার সঙ্গে একইভাবে লড়ে যেতে লাগলাম। ক্রমেই অলিম্পিক সাঁতারের দিন চলে এল। লাড্ডুদা আমাদের জন্য বিশেষ পাসের বন্দোবস্ত করেছিলেন। ভাইয়া, আমি আর আমার আরেক বন্ধু ঢাকায় সুইমিং পুলে দর্শকের সারিতে সেদিন আসন পেয়েছিলাম। এর আগে হিট এবং সেমিফাইনাল হয়ে গেছে। উভয় সাঁতারে দ্বিতীয় হয়ে লাড্ডুদা ফাইনাল ছয়জনের মধ্যে একজন নির্বাচিত হন। মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। সব প্রতিযোগী প্রস্তুত। পিস্তলের আওয়াজে সাঁতার শুরু হয়ে গেল। একটু অবাক হলাম। কই, লাড্ডুদা তো তাঁর স্বভাবসুলভ মুখ দিয়ে 'ভুড়ুৎ' শব্দটি করলেন না? আমরা সবাই জানি যে অলিম্পিক সুইমিং পুল ৫০ মিটার দীর্ঘ হয়। এই ৫০ মিটার যেন লাড্ডুদাকে চেনাই গেল না। তিনি অর্ধেক সময় পার করলেন তৃতীয় স্থানে। প্রথম স্থানে বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে হাবিলদার রমজান। মনটা দমে গেল। ৫০ মিটার শেষে সমারসল্ট দিয়ে লাড্ডুদা দ্বিতীয় ৫০ মিটার শুরু করলেন। শোনা গেল তাঁর গগনবিদারী 'ভুড়ুৎ' শব্দটি। ভাইয়া চিৎকার করে উঠলেন, 'ওই তো লাড্ডুদা।' তখন আমরা সবাই সমস্বরে বলছি, 'লাড্ডুদা, লাড্ডুদা।' পুলের চারপাশের সব বাঙালি আমাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছে। কেবল শোনা যাচ্ছে, 'লাড্ডুদা, লাড্ডুদা।' পুলের ৩ নম্বর ট্র্যাকে যেন একটা উন্মত্ত দানব স্পিডবোটের ক্ষিপ্রতায় এগিয়ে চলেছে সামনে। প্রথম ১৫ মিটারে দ্বিতীয় প্রতিযোগী পেছনে পড়ে গেলেন। ৩০ মিটারের মাথায় ব্রজেনদা অতিক্রম করলেন হাবিলদার রমজানকে। জাহাজ ছুটে চলেছে। থামায় তাকে কে? প্রায় চার ফিটের ব্যবধানে ওই অপ্রতিরোধ্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে আমাদের লাড্ডুদা ছুঁলেন ফিনিশিং লাইন। ছুঁয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন। পানির মধ্যে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেন সেই শব্দটি 'ভুড়ুৎ'। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত দুটো তুলে বিজয় চিহ্নটি এঁকে দিলেন যেন আকাশেই বুঝিবা।
মুখে মৃদু হাসি। মনে হলো, এ জয় যেন আমাদেরই এবং আমাদের ছাড়িয়ে সব বাঙালির। এরপর ৪০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে লাড্ডুদা অনায়াসে তাঁর সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেছনে ফেলে স্বর্ণ জয় করে নিলেন। এই দুই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভঙ্গ হলো পাকিস্তান অলিম্পিকের পুরনো রেকর্ড। নতুন রেকর্ড প্রতিষ্ঠা করলেন আমাদেরই ব্রজেনদা। এ নিয়ে বাঙালি ক্রীড়া অনুরাগীদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল। ব্রজেনদাকে নিয়ে সবারই টানাটানি। কিন্তু সেদিকে ব্রজেনদার ভ্রূক্ষেপ নেই। সুইমিং পুল থেকে বেরিয়ে এসেই একেবারে আমাদের মাঝখানে চলে এলেন। ভাবটা ছিল এমন যে এ তো জানাই ছিল। বললেন, 'চল যাওয়া যাক।' জিজ্ঞেস করলাম, 'কোথায়?' একটু হেসে বললেন, 'ফরাশগঞ্জ।' প্রথমেই যাওয়া হলো তাঁর বাড়িতে। সেখানে গুরুজনদের প্রণামাদি সারার পর এসে বললেন, 'কী রে একটা মামলেট হবে?' আমরা দল বেঁধে চললাম। সেই ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে ডিমের অমলেট সেদিন মনে হয়েছিল অমৃতের মতো। (চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মাসখানেকের মধ্যে আমরা এসব ব্যাপারে দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম। অবলীলায় তখনকার প্রমত্ত বুড়িগঙ্গা পার হয়ে যাই। এই সেদিন পূতিগন্ধময় বুড়িগঙ্গার ওপর একটা লঞ্চের দোতলায় বসে ভাবছিলাম আমাদের কৈশোর ও যৌবনের বুড়িগঙ্গার কী হাল হয়েছে আজ? যাকগে সেসব কথা। ব্রজেনদা যে শেষ পর্যন্ত অত বড় মাপের সাঁতারু হবেন, সেটা আমি কল্পনাও করিনি। কিছুদিনের মধ্যে আমরা জানতে পারলাম যে এবারের পাকিস্তান অলিম্পিক ঢাকায় হতে যাচ্ছে এবং ব্রজেনদা সেই অলিম্পিকে ১০০ ও ৪০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে অংশ নেবেন। আমরা শুনে খুবই উৎফুল্ল হলাম, যদিও ভাইয়া বললেন যে এই অলিম্পিকে ব্রজেনদার জয়ী হওয়া দুষ্কর। কেননা তাঁর প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাঁতারু হাবিলদার মোহাম্মদ রমজান, যার দৈর্ঘ্য ছয় ফুট তিন ইঞ্চি এবং তিনি তখন উভয় সাঁতারে পাকিস্তান রেকর্ডের অধিকারী। তবে বাঙালির তো একটি ব্যাপার আছে। তারা কখনো হতোদ্যম হতে জানে না। যা কিছু সত্য বলে জানে, তার জন্য মরণপণ যুদ্ধ করতেও তারা প্রস্তুত। লাড্ডুদা লেগে গেলেন দিনে ১০ ঘণ্টা প্র্যাকটিসে। প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালীই হোক, তাঁকে আমরা হারাবই_এই উদ্যম নিয়ে আমরাও লাড্ডুদার সঙ্গে একইভাবে লড়ে যেতে লাগলাম। ক্রমেই অলিম্পিক সাঁতারের দিন চলে এল। লাড্ডুদা আমাদের জন্য বিশেষ পাসের বন্দোবস্ত করেছিলেন। ভাইয়া, আমি আর আমার আরেক বন্ধু ঢাকায় সুইমিং পুলে দর্শকের সারিতে সেদিন আসন পেয়েছিলাম। এর আগে হিট এবং সেমিফাইনাল হয়ে গেছে। উভয় সাঁতারে দ্বিতীয় হয়ে লাড্ডুদা ফাইনাল ছয়জনের মধ্যে একজন নির্বাচিত হন। মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। সব প্রতিযোগী প্রস্তুত। পিস্তলের আওয়াজে সাঁতার শুরু হয়ে গেল। একটু অবাক হলাম। কই, লাড্ডুদা তো তাঁর স্বভাবসুলভ মুখ দিয়ে 'ভুড়ুৎ' শব্দটি করলেন না? আমরা সবাই জানি যে অলিম্পিক সুইমিং পুল ৫০ মিটার দীর্ঘ হয়। এই ৫০ মিটার যেন লাড্ডুদাকে চেনাই গেল না। তিনি অর্ধেক সময় পার করলেন তৃতীয় স্থানে। প্রথম স্থানে বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে হাবিলদার রমজান। মনটা দমে গেল। ৫০ মিটার শেষে সমারসল্ট দিয়ে লাড্ডুদা দ্বিতীয় ৫০ মিটার শুরু করলেন। শোনা গেল তাঁর গগনবিদারী 'ভুড়ুৎ' শব্দটি। ভাইয়া চিৎকার করে উঠলেন, 'ওই তো লাড্ডুদা।' তখন আমরা সবাই সমস্বরে বলছি, 'লাড্ডুদা, লাড্ডুদা।' পুলের চারপাশের সব বাঙালি আমাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছে। কেবল শোনা যাচ্ছে, 'লাড্ডুদা, লাড্ডুদা।' পুলের ৩ নম্বর ট্র্যাকে যেন একটা উন্মত্ত দানব স্পিডবোটের ক্ষিপ্রতায় এগিয়ে চলেছে সামনে। প্রথম ১৫ মিটারে দ্বিতীয় প্রতিযোগী পেছনে পড়ে গেলেন। ৩০ মিটারের মাথায় ব্রজেনদা অতিক্রম করলেন হাবিলদার রমজানকে। জাহাজ ছুটে চলেছে। থামায় তাকে কে? প্রায় চার ফিটের ব্যবধানে ওই অপ্রতিরোধ্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে আমাদের লাড্ডুদা ছুঁলেন ফিনিশিং লাইন। ছুঁয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন। পানির মধ্যে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেন সেই শব্দটি 'ভুড়ুৎ'। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত দুটো তুলে বিজয় চিহ্নটি এঁকে দিলেন যেন আকাশেই বুঝিবা।
মুখে মৃদু হাসি। মনে হলো, এ জয় যেন আমাদেরই এবং আমাদের ছাড়িয়ে সব বাঙালির। এরপর ৪০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে লাড্ডুদা অনায়াসে তাঁর সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেছনে ফেলে স্বর্ণ জয় করে নিলেন। এই দুই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভঙ্গ হলো পাকিস্তান অলিম্পিকের পুরনো রেকর্ড। নতুন রেকর্ড প্রতিষ্ঠা করলেন আমাদেরই ব্রজেনদা। এ নিয়ে বাঙালি ক্রীড়া অনুরাগীদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল। ব্রজেনদাকে নিয়ে সবারই টানাটানি। কিন্তু সেদিকে ব্রজেনদার ভ্রূক্ষেপ নেই। সুইমিং পুল থেকে বেরিয়ে এসেই একেবারে আমাদের মাঝখানে চলে এলেন। ভাবটা ছিল এমন যে এ তো জানাই ছিল। বললেন, 'চল যাওয়া যাক।' জিজ্ঞেস করলাম, 'কোথায়?' একটু হেসে বললেন, 'ফরাশগঞ্জ।' প্রথমেই যাওয়া হলো তাঁর বাড়িতে। সেখানে গুরুজনদের প্রণামাদি সারার পর এসে বললেন, 'কী রে একটা মামলেট হবে?' আমরা দল বেঁধে চললাম। সেই ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে ডিমের অমলেট সেদিন মনে হয়েছিল অমৃতের মতো। (চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments