সাদাকালো-কথিত মাজার ও 'লাল সালু'র নয়া অধ্যায় by আহমদ রফিক
দৃশ্যচিত্রটা খুবই উত্তেজনার- কারো জন্য হতাশা, কারো কারো জন্য প্রত্যাশাপূরণ। দেখতে কর্মযজ্ঞের মতো মনে হলেও আসলে তা অবৈধ স্থাপনা ধ্বংসের যান্ত্রিক তৎপরতা এবং তা বৃষের মতো প্রবল শক্তিতে। এত দিন যা সব কিছু ধর্মের নামে অবৈধ কর্মকাণ্ড, অনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, এমনকি অসামাজিক ব্যবসা তথা অর্থ উপার্জনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত বলে
অভিযোগ উঠেছিল এবং তা মাজারের ভক্তি চর্চার আড়ালে সেসবের সহায়ক স্থাপনা ভেঙে পড়তে দেখে উপস্থিত শিক্ষক, ছাত্র, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন এই ভেবে- যাক, কাজটা তাহলে ঠিকই শেষ হলো। ধন্যবাদ উচ্চ আদালতের দুই বিচারপতিকে।
হ্যাঁ, শনিবার দিনের প্রথমার্ধে হাইকোর্টের পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রশাসনের একাধিক বিভাগ শহীদ মিনারের পেছনে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তৈরি কথিত তেল শা মাজার নামের অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলে। ভাঙা হয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে জেলা প্রশাসক ও অন্যদের তৎপরতায়। সামান্য কাজ, কিন্তু এর পেছনে উত্তেজনা ছিল প্রবল। কারণ ঘটনার সঙ্গে ধর্ম ও ভক্তিবাদিতার মতো বিষয়াদি জড়িত ছিল। কিন্তু তা সত্যিকার ধর্মচর্চা নয়।
ধর্মের আড়ালে এবং মানুষের ভক্তিবাদী চেতনার সুযোগে তাদের প্রতারণার মাধ্যমে জাগতিক বৈষয়িক সুবিধা আদায় এবং আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন, শাদা বাংলায় ধর্মীয় ব্যবস্থাপনা একুশ শতকের আধুনিককালেও বাংলাদেশে সচল। সমাজে প্রচলিত ধর্ম ব্যবসা নিয়ে সেই কবে অসাধারণ গুণী কথাসাহিত্যিক ওয়ালিউল্লাহ লিখেছিলেন 'লাল সালু' উপন্যাস। উন্মোচিত হয় ধর্মের নামে সামাজিক অন্যায়ের চালচিত্র।
আশ্চর্য, সমাজে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমিতে একুশ শতকের বাংলাদেশে আজও ওই 'লাল সালু' উপাখ্যান শেষ হয়নি। বিশেষভাবে চলছে গ্রামেগঞ্জে, শিক্ষার আলো, আধুনিক চেতনার প্রকাশ যেসব স্থানে এখনো ধর্মীয় সংস্কার, রক্ষণশীলতা, ভিত্তিহীন ভক্তিবাদিতার অন্ধকার দূর করতে পারেনি। ছোটবড় শহরে যা মাঝেমধ্যে দেখা যায়। তাই বলে খাস রাজধানী ঢাকা মহানগরে মাজার ব্যবসা, যেখানে মেট্রোপলিটন আধুনিকতার উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটার কথা।
কিন্তু না, আমরা এখনো সে মেট্রোপলিটন আধুনিক মননশীলতা অর্জন করতে পারিনি। যদি পারতাম, তাহলে চোখের সামনে তেল শা মাজার গড়ে উঠতে পারত না- পারত না ঢাকার মতো শহর-নগরে ভুয়া বা ভেজাল মাজার গড়ে উঠতে। তার চেয়েও বড় কথা, চোখের সামনে ভুয়া মাজার জেগে ওঠার ক্ষেত্রে আমাদের মননশীলতা তাতে বাধা সৃষ্টি করত।
কিন্তু তা করেনি এ কারণে যে আমাদের আধুনিক চেতনায় ধর্মীয় আচার-আচরণ নিয়ে এখনো রক্ষণশীল স্পর্শকাতরতা কাজ করে। আমরা ভক্তির কাছে যুক্তিকে হারিয়ে থাকি। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুক্তির বদলে ভক্তিতে মুক্তি খুঁজি। ঢাকার কথিত মাজারগুলোতে জনসমাগম তার প্রমাণ। অন্ধ তামসিকতায়ও আকর্ষণ কম নয়। তাই বাংলাদেশে মাজার সংস্কৃতি এতটা ব্যাপক হতে পেরেছে, যেমন গ্রামগঞ্জে, তেমনি শহর-নগরে। পেরেছে, কারণ শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা আমাদের মনোগহনের সংস্কারাচ্ছন্ন কোণগুলো আলোকিত করতে পারেনি।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শিক্ষিত শ্রেণীর মননধর্মে এখানে গভীর পার্থক্য বিরাজমান। পাশ্চাত্য সমাজ ভোগবাদী হয়েও অনেকাংশে যুক্তিবাদী, ধর্মান্ধতার প্রভাব সেখানে এতটা প্রবল নয়। ধর্মবাদিতা তাদের কর্মযজ্ঞে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এ ক্ষেত্রে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে প্রবল গুণগত ফারাক। আর বাংলাদেশ এ দিক থেকে সম্ভবত এক নম্বরে থাকার দাবি রাখতে পারে। বাংলাদেশি সমাজে আধুনিকতা ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব এখনো দূর হয়নি, বিশেষ করে বৃহত্তর ক্ষেত্রে।
প্রমাণ অনেক উদাহরণের মধ্যে এই একটি ক্ষেত্রে। দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে একটি সাদামাটা কবর ঘিরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি মাজার তৈরি হয়ে তার ক্রমশ বাড়বাড়ন্ত ঘটে চলেছে, অথচ আমরা আধুনিক চেতনার নগরবাসী তা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ জানাইনি। জানাননি আমাদের এ-কালের চিকিৎসকরা, যাঁরা একসময় এই কবরের চারপাশে তৈরি বাঁশের ছাউনির মেডিক্যাল ব্যারাক অর্থাৎ মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে বসবাস করেছেন সেই ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে। আসলে বিষয়টাকে আমরা উপেক্ষা করেছি। উপেক্ষা করেছি আমাদের দেখা একটি সাধারণ কবর মাজারের মর্যাদা পাওয়া সত্ত্বেও।
ঘটনা সম্পর্কে সম্প্রতি 'এটিএন নিউজ'-এর চৌকস সাংবাদিক মাসুদের প্রশ্নের জবাবে বিশদ ব্যাখ্যায় বলতে হয়, চলি্লশের দশকের একেবারে শেষদিক থেকে গড়ে ওঠা এক দশক স্থায়ী মেডিক্যাল হোস্টেলটির কথা, যেখানে ছিল গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ২০টি ব্যারাক- ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঠিক পশ্চিম দিকের বিস্তৃত প্রাঙ্গণজুড়ে। সেখানেই দেখেছি, যেমন আমার ছাত্রবন্ধুরাও দেখেছেন ১৪ ও ১৫ নম্বর ব্যারাকের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এক চিলতে একটি কবর। পূর্বোক্ত সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, একেবারেই সাদামাটা একটি কবর, যা কোনো সাধকের নয়। দীর্ঘ সময়ে তেমন দাবি কেউ করেননি।
বাঁশের ছাউনির অস্থায়ী হোস্টেল ক্রমশ ভাঙা পড়ে দুটো কারণে। প্রথমত সেক্রেটারিয়েট রোডসংলগ্ন স্থানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরি করার প্রয়োজনে- যে জন্য প্রথমে ১২ ও ২০ নম্বর ব্যারাক দুটো ভাঙা হয়। পরে ধীরে-সুস্থে বাকিগুলো। দ্বিতীয় কারণ, বকশিবাজারে মেডিক্যাল ছাত্রদের জন্য নয়া পাকা হোস্টেল নির্মাণ ও ছাত্রদের নয়া অবস্থানে বসবাস। পড়ো জমিতে বেশ কিছু সময় পর গড়ে তোলা হয় সেবিকাসদন ও হাসপাতালের জন্য ডিসপেন্সারি ভবন।
আমাদের দেশে যা হয়ে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। পড়ে থাকা জমিতে কিছু অসাধু ব্যক্তি ওই কবরটিকে গড়ে তোলে ভুয়া নাম দিয়ে একটি মাজাররূপে। প্রতিবাদ তখনই হওয়া উচিত ছিল- বাধা দেওয়া উচিত ছিল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কেউ তা দেননি। সবার চোখে ক্রমশ বেড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা, অবৈধ ব্যবসার টানে। সমাজ-সচেতন নাগরিক কেউ আপত্তি বা প্রতিবাদ করেননি।
ক্রমে যখন এই বাড়বাড়ন্তের স্থাপত্য শহীদ মিনারের পরিবেশ ছাপিয়ে যেতে শুরু করে, তখন তা কারো কারো চোখে পড়ে। বিশেষ করে পঞ্চাশের দশকের আমগাছটি কাটা উপলক্ষে। তখন বিষয়টি তৎকালীন হাসপাতাল পরিচালকের নজরে আনি, কিন্তু তাতে কিছু কাজ হয়নি। গাছ ঠিকই কাটা পড়ে এবং কথিত মাজারের বাড়বাড়ন্ত ঘটতে থাকে। আরো কিছুকাল পর বিষয়টি নজরে আসে কোনো কোনো তরুণ সাংবাদিকের।
প্রথম প্রতিবাদী প্রতিবেদন ছাপা হয় জনকণ্ঠে, তরুণ সাংবাদিক মোরসালিনের কলমে। যতদূর মনে পড়ে, তার অনুরোধে সঠিক ঘটনার বিবরণ দিয়ে ছোট একটি নিবন্ধ লিখি। এরপর আমাদেরই এক কনিষ্ঠ সতীর্থ কবর সম্বন্ধে বিবরণ লেখেন। সেখানে বলা হয়, যত দূর জানা গেছে, কবরটি মেডিক্যাল হাসপাতালের এক কর্মচারীর। এ ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করা সম্ভব নয় এ জন্য যে হোস্টেল তৈরির সময় এটি সেখানে ছিল, তবে তা যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নয়, তার প্রমাণ- দীর্ঘসময়ে এ দাবি কেউ তোলেননি।
কিছুটা ঢেউ তুলে বিষয়টি সেখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এর সম্প্রসারণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে আরেক তরুণ সাংবাদিক নওশাদ জামিল কালের কণ্ঠে সচিত্র প্রতিবাদী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। অনুরুদ্ধ হয়ে এ বিষয়ে ছোট নিবন্ধ লিখি। আর সে খবরের সুবাদে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের কল্যাণে তা নজরে আসে উচ্চ আদালতের এবং সমাজ-সচেতন বিচারপতিদ্বয় এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেনের সুবিবেচনাপ্রসূত নির্দেশ জারি হয় শহীদ মিনারের পাশে অবস্থিত কবর ছাড়া সব অবৈধ স্থাপনা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উচ্ছেদ করার। বিচারপতিদ্বয়কে এ জন্য আমাদের অভিনন্দন।
এ নির্দেশের বলেই সরকারের গণপূর্ত বিভাগ, ঢাকার জেলা প্রশাসন ও শাহবাগ থানার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে শনিবার ওই উচ্ছেদ কর্মকাণ্ড শুরু হয়, যা আগেই বলা হয়েছে। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক অনেকে উপস্থিত ছিলেন। খবরে প্রকাশ, উচ্ছেদের সময় কথিত জনৈক খাদেমের উক্তি : 'সাংবাদিকরা উল্টাপাল্টা লেইখা দিল আর উচ্ছেদ শুরু হইল। জবাব পাইয়া যাইব।' সেই সঙ্গে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি- যে জন্য সংশ্লিষ্ট তরুণ সাংবাদিককে পুলিশ প্রহরায় অকুস্থল ত্যাগ করতে হয়। ধর্মের নামে এ ধরনের শক্তির প্রকাশ তো নতুন কিছু নয়।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, উচ্ছেদকাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। কিছু বাকি রয়ে গেছে। আদালত যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন, ঠিক ততটা উচ্ছেদ হয়নি। আমরা আশা করব, অচিরেই সে কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন হবে। আর কথিত খাদেম মো. মান্নানকে বলি, সাংবাদিকরা উল্টাপাল্টা লেখেননি। আমরা যারা এককালে ওই কবরটিকে দেখেছি ও ঘটনা জানি, তারা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে ওই কবর ঘিরে অসাধু স্বার্থের টানে যুক্তিহীনভাবে কথিত মাজার গড়ে উঠেছে কল্পিত তেল শার নামে। এ অবৈধ কাজটি ওই খাদেমসহ বিশেষ চক্রের। এর উচ্ছেদবিষয়ক নির্দেশনা দিয়ে আদালত সঠিক কাজই করেছেন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। সবশেষে বলি, খবরে প্রকাশ, উদ্ধারকৃত জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যত দূর জানি, এ জায়গাটি তো ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক, কবি
হ্যাঁ, শনিবার দিনের প্রথমার্ধে হাইকোর্টের পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রশাসনের একাধিক বিভাগ শহীদ মিনারের পেছনে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তৈরি কথিত তেল শা মাজার নামের অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলে। ভাঙা হয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে জেলা প্রশাসক ও অন্যদের তৎপরতায়। সামান্য কাজ, কিন্তু এর পেছনে উত্তেজনা ছিল প্রবল। কারণ ঘটনার সঙ্গে ধর্ম ও ভক্তিবাদিতার মতো বিষয়াদি জড়িত ছিল। কিন্তু তা সত্যিকার ধর্মচর্চা নয়।
ধর্মের আড়ালে এবং মানুষের ভক্তিবাদী চেতনার সুযোগে তাদের প্রতারণার মাধ্যমে জাগতিক বৈষয়িক সুবিধা আদায় এবং আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন, শাদা বাংলায় ধর্মীয় ব্যবস্থাপনা একুশ শতকের আধুনিককালেও বাংলাদেশে সচল। সমাজে প্রচলিত ধর্ম ব্যবসা নিয়ে সেই কবে অসাধারণ গুণী কথাসাহিত্যিক ওয়ালিউল্লাহ লিখেছিলেন 'লাল সালু' উপন্যাস। উন্মোচিত হয় ধর্মের নামে সামাজিক অন্যায়ের চালচিত্র।
আশ্চর্য, সমাজে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমিতে একুশ শতকের বাংলাদেশে আজও ওই 'লাল সালু' উপাখ্যান শেষ হয়নি। বিশেষভাবে চলছে গ্রামেগঞ্জে, শিক্ষার আলো, আধুনিক চেতনার প্রকাশ যেসব স্থানে এখনো ধর্মীয় সংস্কার, রক্ষণশীলতা, ভিত্তিহীন ভক্তিবাদিতার অন্ধকার দূর করতে পারেনি। ছোটবড় শহরে যা মাঝেমধ্যে দেখা যায়। তাই বলে খাস রাজধানী ঢাকা মহানগরে মাজার ব্যবসা, যেখানে মেট্রোপলিটন আধুনিকতার উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটার কথা।
কিন্তু না, আমরা এখনো সে মেট্রোপলিটন আধুনিক মননশীলতা অর্জন করতে পারিনি। যদি পারতাম, তাহলে চোখের সামনে তেল শা মাজার গড়ে উঠতে পারত না- পারত না ঢাকার মতো শহর-নগরে ভুয়া বা ভেজাল মাজার গড়ে উঠতে। তার চেয়েও বড় কথা, চোখের সামনে ভুয়া মাজার জেগে ওঠার ক্ষেত্রে আমাদের মননশীলতা তাতে বাধা সৃষ্টি করত।
কিন্তু তা করেনি এ কারণে যে আমাদের আধুনিক চেতনায় ধর্মীয় আচার-আচরণ নিয়ে এখনো রক্ষণশীল স্পর্শকাতরতা কাজ করে। আমরা ভক্তির কাছে যুক্তিকে হারিয়ে থাকি। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুক্তির বদলে ভক্তিতে মুক্তি খুঁজি। ঢাকার কথিত মাজারগুলোতে জনসমাগম তার প্রমাণ। অন্ধ তামসিকতায়ও আকর্ষণ কম নয়। তাই বাংলাদেশে মাজার সংস্কৃতি এতটা ব্যাপক হতে পেরেছে, যেমন গ্রামগঞ্জে, তেমনি শহর-নগরে। পেরেছে, কারণ শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা আমাদের মনোগহনের সংস্কারাচ্ছন্ন কোণগুলো আলোকিত করতে পারেনি।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শিক্ষিত শ্রেণীর মননধর্মে এখানে গভীর পার্থক্য বিরাজমান। পাশ্চাত্য সমাজ ভোগবাদী হয়েও অনেকাংশে যুক্তিবাদী, ধর্মান্ধতার প্রভাব সেখানে এতটা প্রবল নয়। ধর্মবাদিতা তাদের কর্মযজ্ঞে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এ ক্ষেত্রে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে প্রবল গুণগত ফারাক। আর বাংলাদেশ এ দিক থেকে সম্ভবত এক নম্বরে থাকার দাবি রাখতে পারে। বাংলাদেশি সমাজে আধুনিকতা ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব এখনো দূর হয়নি, বিশেষ করে বৃহত্তর ক্ষেত্রে।
প্রমাণ অনেক উদাহরণের মধ্যে এই একটি ক্ষেত্রে। দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে একটি সাদামাটা কবর ঘিরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি মাজার তৈরি হয়ে তার ক্রমশ বাড়বাড়ন্ত ঘটে চলেছে, অথচ আমরা আধুনিক চেতনার নগরবাসী তা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ জানাইনি। জানাননি আমাদের এ-কালের চিকিৎসকরা, যাঁরা একসময় এই কবরের চারপাশে তৈরি বাঁশের ছাউনির মেডিক্যাল ব্যারাক অর্থাৎ মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে বসবাস করেছেন সেই ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে। আসলে বিষয়টাকে আমরা উপেক্ষা করেছি। উপেক্ষা করেছি আমাদের দেখা একটি সাধারণ কবর মাজারের মর্যাদা পাওয়া সত্ত্বেও।
ঘটনা সম্পর্কে সম্প্রতি 'এটিএন নিউজ'-এর চৌকস সাংবাদিক মাসুদের প্রশ্নের জবাবে বিশদ ব্যাখ্যায় বলতে হয়, চলি্লশের দশকের একেবারে শেষদিক থেকে গড়ে ওঠা এক দশক স্থায়ী মেডিক্যাল হোস্টেলটির কথা, যেখানে ছিল গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ২০টি ব্যারাক- ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঠিক পশ্চিম দিকের বিস্তৃত প্রাঙ্গণজুড়ে। সেখানেই দেখেছি, যেমন আমার ছাত্রবন্ধুরাও দেখেছেন ১৪ ও ১৫ নম্বর ব্যারাকের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এক চিলতে একটি কবর। পূর্বোক্ত সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, একেবারেই সাদামাটা একটি কবর, যা কোনো সাধকের নয়। দীর্ঘ সময়ে তেমন দাবি কেউ করেননি।
বাঁশের ছাউনির অস্থায়ী হোস্টেল ক্রমশ ভাঙা পড়ে দুটো কারণে। প্রথমত সেক্রেটারিয়েট রোডসংলগ্ন স্থানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরি করার প্রয়োজনে- যে জন্য প্রথমে ১২ ও ২০ নম্বর ব্যারাক দুটো ভাঙা হয়। পরে ধীরে-সুস্থে বাকিগুলো। দ্বিতীয় কারণ, বকশিবাজারে মেডিক্যাল ছাত্রদের জন্য নয়া পাকা হোস্টেল নির্মাণ ও ছাত্রদের নয়া অবস্থানে বসবাস। পড়ো জমিতে বেশ কিছু সময় পর গড়ে তোলা হয় সেবিকাসদন ও হাসপাতালের জন্য ডিসপেন্সারি ভবন।
আমাদের দেশে যা হয়ে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। পড়ে থাকা জমিতে কিছু অসাধু ব্যক্তি ওই কবরটিকে গড়ে তোলে ভুয়া নাম দিয়ে একটি মাজাররূপে। প্রতিবাদ তখনই হওয়া উচিত ছিল- বাধা দেওয়া উচিত ছিল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কেউ তা দেননি। সবার চোখে ক্রমশ বেড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা, অবৈধ ব্যবসার টানে। সমাজ-সচেতন নাগরিক কেউ আপত্তি বা প্রতিবাদ করেননি।
ক্রমে যখন এই বাড়বাড়ন্তের স্থাপত্য শহীদ মিনারের পরিবেশ ছাপিয়ে যেতে শুরু করে, তখন তা কারো কারো চোখে পড়ে। বিশেষ করে পঞ্চাশের দশকের আমগাছটি কাটা উপলক্ষে। তখন বিষয়টি তৎকালীন হাসপাতাল পরিচালকের নজরে আনি, কিন্তু তাতে কিছু কাজ হয়নি। গাছ ঠিকই কাটা পড়ে এবং কথিত মাজারের বাড়বাড়ন্ত ঘটতে থাকে। আরো কিছুকাল পর বিষয়টি নজরে আসে কোনো কোনো তরুণ সাংবাদিকের।
প্রথম প্রতিবাদী প্রতিবেদন ছাপা হয় জনকণ্ঠে, তরুণ সাংবাদিক মোরসালিনের কলমে। যতদূর মনে পড়ে, তার অনুরোধে সঠিক ঘটনার বিবরণ দিয়ে ছোট একটি নিবন্ধ লিখি। এরপর আমাদেরই এক কনিষ্ঠ সতীর্থ কবর সম্বন্ধে বিবরণ লেখেন। সেখানে বলা হয়, যত দূর জানা গেছে, কবরটি মেডিক্যাল হাসপাতালের এক কর্মচারীর। এ ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করা সম্ভব নয় এ জন্য যে হোস্টেল তৈরির সময় এটি সেখানে ছিল, তবে তা যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নয়, তার প্রমাণ- দীর্ঘসময়ে এ দাবি কেউ তোলেননি।
কিছুটা ঢেউ তুলে বিষয়টি সেখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এর সম্প্রসারণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে আরেক তরুণ সাংবাদিক নওশাদ জামিল কালের কণ্ঠে সচিত্র প্রতিবাদী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। অনুরুদ্ধ হয়ে এ বিষয়ে ছোট নিবন্ধ লিখি। আর সে খবরের সুবাদে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের কল্যাণে তা নজরে আসে উচ্চ আদালতের এবং সমাজ-সচেতন বিচারপতিদ্বয় এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেনের সুবিবেচনাপ্রসূত নির্দেশ জারি হয় শহীদ মিনারের পাশে অবস্থিত কবর ছাড়া সব অবৈধ স্থাপনা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উচ্ছেদ করার। বিচারপতিদ্বয়কে এ জন্য আমাদের অভিনন্দন।
এ নির্দেশের বলেই সরকারের গণপূর্ত বিভাগ, ঢাকার জেলা প্রশাসন ও শাহবাগ থানার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে শনিবার ওই উচ্ছেদ কর্মকাণ্ড শুরু হয়, যা আগেই বলা হয়েছে। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক অনেকে উপস্থিত ছিলেন। খবরে প্রকাশ, উচ্ছেদের সময় কথিত জনৈক খাদেমের উক্তি : 'সাংবাদিকরা উল্টাপাল্টা লেইখা দিল আর উচ্ছেদ শুরু হইল। জবাব পাইয়া যাইব।' সেই সঙ্গে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি- যে জন্য সংশ্লিষ্ট তরুণ সাংবাদিককে পুলিশ প্রহরায় অকুস্থল ত্যাগ করতে হয়। ধর্মের নামে এ ধরনের শক্তির প্রকাশ তো নতুন কিছু নয়।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, উচ্ছেদকাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। কিছু বাকি রয়ে গেছে। আদালত যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন, ঠিক ততটা উচ্ছেদ হয়নি। আমরা আশা করব, অচিরেই সে কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন হবে। আর কথিত খাদেম মো. মান্নানকে বলি, সাংবাদিকরা উল্টাপাল্টা লেখেননি। আমরা যারা এককালে ওই কবরটিকে দেখেছি ও ঘটনা জানি, তারা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে ওই কবর ঘিরে অসাধু স্বার্থের টানে যুক্তিহীনভাবে কথিত মাজার গড়ে উঠেছে কল্পিত তেল শার নামে। এ অবৈধ কাজটি ওই খাদেমসহ বিশেষ চক্রের। এর উচ্ছেদবিষয়ক নির্দেশনা দিয়ে আদালত সঠিক কাজই করেছেন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। সবশেষে বলি, খবরে প্রকাশ, উদ্ধারকৃত জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যত দূর জানি, এ জায়গাটি তো ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক, কবি
No comments