কবিগুরুর জীবনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা by সুভাষ সিংহ রায়

১. ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হলো। রবীন্দ্রনাথ 'নাইট' উপাধি পরিত্যাগ করলেন। ওই বছরের ১৩ এপ্রিল সংঘটিত হয় ইতিহাসের জঘন্যতম জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড। এদিন অমৃতসরের চারদিকে পাকা প্রাচীরের ভেতর চলছিল একটি ব্রিটিশবিরোধী সভা। বের হওয়ার পথ ছিল একটাই।


হঠাৎ ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে একদল সেনা বেপয়োরা গুলিবর্ষণ করে। ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালানোর পর গুলি ফুরিয়ে যায়। এই হত্যাকাণ্ড এমনই জঘন্য ছিল যে, কতজন মারা গিয়েছিল, তার চেয়ে দেখার বিষয় ছিল কতজন বেঁচে ছিল। এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কবিগুরু ইংরেজদের দেওয়া 'নাইট' উপাধি পরিত্যাগ করেন। অন্যদিকে গভর্নর জেনারেলের একজন এঙ্িিকউটিভ কাউন্সিলেস্যার শংকরণ নায়ার বার্ষিক ৬৪ হাজার টাকা বেতনের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন; কিন্তু 'নাইট' খেতাব বর্জন করেননি। অথচ কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশনে চাকরি ত্যাগ করার জন্য স্যার শংকরণ নায়ারকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হলেও 'নাইট' পরিত্যাগ করার জন্য রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রোমা রোলাঁ যখন মানুষের স্বাধীনতাবিষয়ক দলিল তৈরি করেন, সেই দলিলে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে দুজন ব্যক্তির নাম রয়েছে এবং তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন।
২. কবিগুরু যখন মহাপ্রয়াণে যান, তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। রবীন্দ্র প্রয়াণে কলকাতার এক নাগরিক শোকসভায় তিনি বলেছিলেন, 'আপনারা যতই বলুন তিনি বিশ্বের কবি, সারা ভারতের কবি, আমরা বাঙালিরা তাঁর ওপর আমাদের দাবি একতিলও ছাড়ছি না। তাঁর সাধনা ও আরাধনার প্রথম যজ্ঞশালা বাংলাদেশ, শেষ যজ্ঞশালাও বাংলাদেশ। এই যজ্ঞশালার আলোই সারা ভারতকে, সারা বিশ্বকে উদ্ভাসিত করেছে। আমরা তাঁর গর্বে গর্বিত। তাঁকে ছাড়া বাঙালি অস্তিত্বহীন। বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ রবীন্দ্রনাথ।'
৩. রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষর ছিল অত্যন্ত দর্শনীয়। যত বয়স বেড়েছে, তাঁর হাতের লেখাও তত সুন্দর হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁরা বলেন, 'গুরুদেব যতই বৃদ্ধ হয়েছেন, তাঁর রূপ ততই বৃদ্ধি পেয়েছে।' রবীন্দ্রনাথ সর্বদাই হাতের লেখার প্রতি যত্নশীল ছিলেন। রবীন্দ্রলিপিতে একদিকে যেমন আছে শিল্পসৌন্দর্য, তেমনি অন্যদিকে আছে স্ট্রাকচার বা গঠনমূলক সৌন্দর্য। এ ছাড়া তাঁর হস্তাক্ষরের বড় গুণ সহজপাঠ্যতা। গুরুদেবকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, 'লেখাটা যেন আমার বড় গিনি্ন, আটপৌরে। সে সব সময় সবার সামনেই বের হয়। কোনো দ্বিধা-সংকোচ নেই। ছবি হলো আমার ছোট গিনি্ন_তাকে একটু তোয়াজ করলেই সে ভোলে। কিন্তু আমার মেজ গিনি্ন আমার গান। সে যখন আমার কাছে আসে, তখন কাউকেই সে সইতে পারে না। বড় অভিমানী। কেউ এল কি, অমনি সে যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল, কত সাধ্যসাধনা করে তবে আবার ফিরিয়ে আনতে হয়।'
৪. কবিগুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আর সি মজুমদারের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মেয়েকে একটি কবিতা লিখে দিয়েছেন_এ কথা জগন্নাথ হলের ছাত্ররা জানতে পেরে পরদিন সকালে কবির কাছে বলল, "আমরা জগন্নাথ হল থেকে 'বাসন্তিকা' নামের একটি পত্রিকা বের করে থাকি। আমাদের সেই পত্রিকায় যদি দয়া করে একটি কবিতা লিখে দেন।" কবিগুরু জগন্নাথ হলের সেই সময়কার ছাত্রদের অনুরোধ ফেলতে পারেননি। 'এই কথাটি মনে রেখো/তোমাদের এই হাসিখেলায়/আমি তো গান গেয়েছিলেম/জীর্ণপাতা ঝরার বেলায়'।
সেবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি জায়গায় শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। এসএম হলের এক সংবর্ধনায় কবির বসার আসনের ঠিক ওপরে বৈদ্যুতিক পাখায় এমনভাবে বড় বড় অনেক গাঁদাফুল রাখা হয়েছিল যে কবি যেই না আসনে বসলেন, অমনি পাখা খুলে দেওয়ায় সেই ফুল তাঁর গায়ে পড়তে থাকল। চারদিক থেকে করতালি ধ্বনিত হলো। রবীন্দ্রনাথের পাশে বসেছিলেন রমেশ চন্দ্র মজুমদার। কবি তাঁকে বললেন, 'দেখো, সাহিত্যের একটা বড় রহস্যের সমাধান হয়ে গেল।' রমেশ চন্দ্র বললেন, 'কী রহস্য?' কবি বললেন, 'কালিদাসের রঘুবংশে পড়েছিলাম, মহারাজা অজের সাথে তাঁর রাণী ইন্দুমতী যখন কথা বলছিলেন, এমন সময় ওপর থেকে তাঁর মাথা ও গায়ে ফুল পড়ায় তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়েন এবং তাঁর প্রাণবিয়োগ হয়।' আমি বরাবরই ভাবতাম, ফুলের ঘায়ে মূর্ছা বা মৃত্যু কবির নিছক কল্পনা মাত্র। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, ফুলের ঘায়ে মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু এ কথা সত্য, তিনি এসএম হলের ছাত্রদের সংবর্ধনায় বিমোহিত হয়েছিলেন। কবি বক্তব্যের শুরুতে যেভাবে বলেছিলেন, তা ছিল এ রকম : 'প্রাচীনকালে আমাদের দেশের রাজারা দিগ্বিজয় করে ফিরলে তাঁদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করা হতো। আমি কি আমার দেশের জন্য তেমনি কিছু জয় করে এনেছি, যার জন্য আমাকেও পুষ্প বর্ষণ করে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হচ্ছে?' তখন এসএম হলের প্রভোস্ট ছিলেন স্যার এ এফ রহমান। তাঁর সভাপতিত্বেই রবীন্দ্র সংবর্ধনায় হলের চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হলের জীবন-সদস্যও করা হয়েছিল। মুসলিম হলের পক্ষ থেকে কবিকে যে সুদীর্ঘ অভিনন্দনপত্র দেওয়া হয়েছিল, তার একটি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করা যেতে পারে : 'হে পুণ্যচিত্ত, অনন্ত রূপ পিয়াসী সাধক,/আমাদের আদর্শ কর্মপ্রাণ, স্নেহপ্রবণ, ভক্ত বীর/হজরত মহম্মদের জীবনের মূলমন্ত্রটি তোমার ছন্দে/বেশ সুন্দর অভিব্যক্ত হইয়াছে_/বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।/অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ।'

লেখক : রাজনীতিক ও ফার্মাসিস্ট

No comments

Powered by Blogger.