কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-নিজের জবাব নিজেকে দিন by রণজিৎ বিশ্বাস

: ডাক্তারের কাছে রোগ ও ব্যবহারজীবীর কাছে অপরাধ লুকানো যায় না- কথাটি আপনি মানেন?: মানি। এটি কি আবার না মানার কথা নাকি! : কতটুকু মানেন? : পুরোপুরি। হান্ড্রেড পারসেন্ট। : ডাক্তারের উচিত বাছ-বিচার ও পরিচয় বিচার না করে সবার চিকিৎসা করা।


ব্যবহারজীবীর উচিত তাকে যে ব্যবহার করতে চায়, তার ব্যবহারে লেগে যাওয়া। এটি মানেন?
: প্রথমটি পুরোপুরি মানি। দ্বিতীয়টি মানি শর্তসাপেক্ষে।
: মনে করুন, আপনি ডাক্তার।
: মনে করলাম। মনে করতে আমার ভালোই লাগে।
: আপনার হাসপাতালে কিংবা ক্লিনিকে এক রোগী এলো- যে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষ মেরেছে, পাকিস্তানিদের নাজায়েজ আওলাদের মতো কাজ করেছে; নিজের বন্ধুকে, প্রতিবেশীকে, সহপাঠীকে, বন্ধুর ভাই ও বাবাকে এবং নিজের শিক্ষককে হত্যা করেছে; হিন্দুকে জোরজবরদস্তি মুসলমান বানিয়েছে, যেন ওরাই শুধু পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে চাচ্ছে, সেই রোগীকে আপনি কী করবেন?
: কেন! চিকিৎসা করব! আমার জ্ঞান, বুদ্ধি ও দক্ষতার প্রয়োগ করে তাকে সারিয়ে তুলব!
: এইটি আমি বুঝলাম না! তাকে আপনি সারিয়ে তুলবেন কেন? যখন আপনি জানেন যে সে কীটানুকীট, সে পাশবাতিপাশব, সে যুদ্ধাপরাধী, সে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক, সে কালপ্রিটের বাচ্চা কালপ্রিট ও হারামির বাচ্চা হারামি, সে মানুষের সম্পদ লুট করেছে, বাড়িতে আগুন দিয়েছে, প্রতিবেশীর জায়াজননী কন্যা ভাগিনীর চোখের মণিতে তাকিয়ে শুচিতা নষ্ট করেছে ও তাদের সম্ভ্রমের চূড়ান্ত লাঞ্ছনা করেছে, উপাসনালয়ের পবিত্র মেঝেয় সার বেঁধে বসিয়ে বলেছে তোর ধর্মে থাকলে মরবি, আমার ধর্মে আসলে বাঁচবি, তারপর তাদের ধর্মান্তরিত করে স্বয়ং বিধাতাকে সাম্প্রদায়িক করে তুলেছে- তাকে আপনি শ্রমনিবিড় মনযোগী চিকিৎসায় সারিয়ে তুলবেন কেন?
: তাকে আমি সারিয়ে তুলবোই। অন্তত আমার চেষ্টা জারি রাখবোই। আমার একটা দর্শন আছে, আমার একটা আদর্শ আছে, আমার একটা দায় আছে।
আপনি কি সুস্থ আছেন?
: পুরোপুরি।
: আপনার দায়টা কার কাছে?
: আমার জাতির কাছে, আমার বিবেকের কাছে, আমার হৃৎকন্দরের ন্যায়ালয়ের কাছে।
: আপনি তো জানেন, সে মানব নামের কলঙ্ক।
: জানি।
: তারপরও তাকে আপনি সুস্থ করবেন কেন?
: সেটি যদি বুঝতে পারতেন, আমাকে তো এ প্রশ্ন শুনতে হতো না। তাকে আমি সারিয়ে তুলতে চাইব, যাতে সে আইনের বিধান অনুযায়ী সুস্থাবস্থায় 'যথাপ্রাপ্য' বুঝে নিতে পারে। মানুষ যেন বুঝতে পারে- এই কাজের এই শাস্তি। ৪০ বছর পরে হলেও তা বুঝে নিতে হয়। না নিয়ে উপায় নেই।
আমার ক্লিনিকে বা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসে মারা গেলে আপনি কি মনে করেন, তার শাস্তি পুরো হবে? না, যথোপযুক্ত ও মানানসই হবে! আপনি যখন অত ফটরফটর করছেন একটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে।
: করুন। আপনার সব প্রশ্নের জবাব দেব। আমার বুকের ভেতর এখন যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদী, মানবতাবিরোধী, বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা ও তার বেনিফিশিয়ারি, সাম্প্রদায়িক, ছদ্মসাম্প্রদায়িক ও যুদ্ধাপরাধীদের পালক পোষকদের নামে আগুন জ্বলছে।
: একই কারণে, একই প্রকোষ্ঠের 'মানবায়বপাশব'গুলোকে 'রাখ' ও 'খাক' করে দিয়ে উপযুক্ত গন্তব্যে পাঠিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, বুকের ভেতর আগুন নিয়ে অপেক্ষমাণ দেশের প্রায় সব মানুষের একই অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের সময় গুটিকয় কুলাঙ্গার ছাড়া সবাই দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিল এবং স্বাধীনতার জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে যে যার মতো লড়েছিল। দেশের অবস্থা এখনো সে রকম। গুটিকয় নির্লজ্জ ও কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রাণী ছাড়া দেশের সবাই চাইছে যুদ্ধাপরাধীরা তাদের উপযুক্ত শাস্তি পাক, তাদের যা প্রাপ্য কড়ায়-গণ্ডায় ও সুদে-আসলে বুঝে নিক। অনেক বছর পরে হলেও 'নগদানগদ'। এবার আপনাকে প্রশ্নটা করি। আগুন জ্বলা বুকে অবিকল্প প্রশ্ন।
বিশ্বাসঘাতকতায় মীরজাফর শিশুত্বে নামানো খন্দকার মুশতাক যেভাবে মারা গেল, যেভাবে মারা গেল তার চ্যালাসাঙ্গাতদের আরো কয়েকজন, যেভাবে মারা গেল পবিত্র সংবিধানে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢোকানো একটি মানুষ, যেভাবে বিদেশে মারা গেল অভাবনীয় নিষ্ঠুর এক মানুষের দ্বারা সসম্মান পুনর্বাসিত জাতির জনকের আত্মস্বীকৃত খুনিদের একজন, তাতে কী আপনি শান্তি পেয়েছেন? আমাকে জবাব দিতে হবে না, মনে মনে ভাবুন। নিজের জবাব নিজেকে দিন। বিচারের আগে সেভাই যদি মারা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের কেউ, আপনা আগুনজ্বলা বুকের ভেতর কি ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকবে?
: বলব?
: না। আমাকে কিছু বলবেন না। নিজেকে বলুন। যুক্তি দিয়ে, জবাব দিয়ে আগে নিজে অন্তরকে, আত্মাকে ও নিজের অন্তরাত্মাকে তুষ্ট করুন। সংসারে আত্মার শান্তি খুব বড় শান্তি, এত বড় যে, তার চেয়ে বড় আর কিছু নেই। এবার আসুন।
'যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ব্যবহারজীবীদের ভূমিকা নিয়ে তো কিছু বললেন না।
: আজ আর না। মন টানছে না। ক্লান্তও হয়ে গেছি। যুদ্ধাপরাধীদের প্রাপ্তিবিলম্বের কারণে ও তাদের এবং তাদের সমর্থকদের জন্য জমে ওঠা ঘৃণার আঁচে আগুনের ভাপে-তাপে ভাজাভাজা আর আঙরা-আঙরাও হয়ে উঠেছি। আজ থাক, আরেকদিন আসবেন। যতদিন দেহে আছে প্রাণ, কণ্ঠনালিতে আছে প্রাণের বায়ু, তত দিন কথা বলব।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.