রাজনীতি-চাই সমঝোতা ও সৌহার্দ্য by সৈয়দ আবুল মকসুদ
স্বাধীনতা-পরবর্তী চার দশকের মধ্যে রাজনীতির ক্ষেত্রে ২০১১ ছিল একটি অন্য রকম বছর। যদিও বাইরে থেকে দেখতে বছরটি অন্য যেকোনো বছরের মতোই স্বাভাবিক। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরটির স্বাভাবিক দিকগুলো কী? একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে। সংসদে ক্ষমতাসীনদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। একাধিক বিরোধী দলও রয়েছে। তারা সংখ্যায় কম। তারা অতীতের বিরোধী দলের মতোই নানা অজুহাতে অভিমান করে সংসদে যায় না। সংসদের বাইরে সরকারি দল
ও বিরোধী দল সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, লংমার্চ, আলোচনা-সভা, গাড়ি ভাঙচুর প্রভৃতি সারা বছর প্রতিযোগিতা দিয়ে চালিয়ে গেছে। তবে মোটামুটি জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল।
সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন ঘটে সংসদে। সরকারের নীতি-নির্ধারণী কর্মকাণ্ড নিয়ে মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা সংসদে আলোচনা করেন। বিরোধী দলের, এমনকি সরকারি দলের সদস্যরাও তার পক্ষে-বিপক্ষে বলেন। জনগণের দাবিদাওয়া ও আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটে সংসদীয় বিতর্কে। সরকার কোন ক্ষেত্রে কী করছে, তা জনগণ জানতে পারে সংসদের আলোচনা থেকে। অর্থাৎ দেশের রাজনীতির পুরো চিত্র পাওয়া যায় সংসদ থেকে। সেই বিবেচনায় ২০১১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ছিল একেবারেই অকার্যকর, যদিও অধিবেশন বসেছে নিয়মিত।
গত বছর প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বহুবার বহু দেশ সফর করেছেন। সে সব সফরে বাংলাদেশ কী অর্জন করেছে, কী কী সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে, তা সংসদে আলোচনা করা হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বহু বছরের মধ্যে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সেটি প্রথম সফর। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে কিছু সমস্যাও রয়েছে। সে সব সমস্যা কর্মকর্তা পর্যায়ে নয়, রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার বিষয়। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে কী সব বিষয় আলোচনা হলো, কী অর্জিত হলো, কী পাওয়া গেল না, কেন পাওয়া গেল না, তা নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। এসব ব্যাপারে বিরোধী দলের ভূমিকাও শূন্য। তারা সংসদে গিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ও টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বিরোধী দল বাইরে রাস্তাঘাটে অর্থহীন হইচই করেছে, সস্তা রাজনীতি করেছে, সংসদে গিয়ে অর্থবহ কিছু করেনি।
একালে জাতীয় রাজনীতি আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বৈদেশিক সম্পর্ক রাজনীতির একটি বড় বিষয়। দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির স্বার্থে তা উপেক্ষার বিষয় নয়। এ বছর মহাজোট সরকার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দাতা দেশ এবং উন্নয়ন-সহযোগী দাতা সংস্থার আস্থা হারিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমী বিশ্বের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে।
যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর কাজ স্থগিত হয়েছে। যদিও সরকার তা স্বীকার করছে না। বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণে ঋণ দেবে না। অন্যান্য দাতা সংস্থাও গররাজি। দেশের জন্য, সরকারের জন্য সে এক বড় অপবাদ ও অসম্মান। বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত হলো না। তাতে মানুষ যদি মনে করে অভিযোগ অসত্য নয়, তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। এসব ব্যাপারে সংসদ নীরব।
বছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে সংবিধান সংশোধনের কারণে। সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে সরকার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিদের মতামত নিয়েছে। সেটি ছিল ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দিয়েছেন, তার কিছুই গ্রহণ করেনি সরকার। সে সব নিয়ে সংসদে আলোচনাও হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সর্বোচ্চ আদালত চার লাইনে একটি রায় ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। ১০ জন প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন আদালতে অ্যামিকাস কিউরি। তাঁরা কেউই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পরামর্শ দেননি। আদালতের সম্পূর্ণ রায় এখনো জানা যায়নি। তার আগেই তড়িঘড়ি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলো। সরকারি দলের অধিকাংশ প্রবীণ নেতা তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে ছিলেন না বলে শোনা যায়। বিরোধী দল অন্য কোনো ইস্যু না পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতেই রাজনীতি উত্তপ্ত রেখেছে।
অসুস্থ রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত বিচিত্র কর্মকাণ্ড ছিল বছরটির বৈশিষ্ট্য। হঠাৎ করে সরকার ঘোষণা দিল ঢাকাকে দুই ভাগ করার। সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতারা এবং নাগরিক সমাজ থেকে আপত্তি তোলা হলো। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো বিভক্তির বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রচার করল। ঘোরতর সরকার-সমর্থক কলাম লেখকেরাও ঢাকা ভাগ করা থেকে বিরত থাকতে সরকারকে পরামর্শ দিলেন। ঢাকাবাসী মিটিং-মিছিল করলেন। কিন্তু সরকার কারও কথার মূল্য দিল না। সাড়ে চার মিনিটে সংসদে স্থানীয় সরকার সংশোধন বিল পাস হলো। রাজধানী নগর দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। বিরোধী দলের নির্বাচিত মেয়রকে সরিয়ে সেখানে বসানো হয়েছে দুজন অনির্বাচিত কর্মকর্তাকে।
প্রায় সব মানুষের ধারণা, ঢাকা সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হলে সরকারি দলের প্রার্থীর পরাজয়ের আশঙ্কায় ঢাকাকে ভাগ করা হয়েছে। আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল বছরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর মধ্যে। কিন্তু যে প্রার্থীকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সমর্থন দেন, সেই প্রার্থী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। বিদ্রোহী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। তাঁর বিজয় সরকারকে বিব্রত করে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সরকারের শ্রদ্ধাবোধ কম—নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়। সৎ ও নিবেদিত নেতাদের চেয়ে দলে বিতর্কিতদের মূল্য বেশি।
গত বছর যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসর ঘাতক দালালদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে শুনানি হচ্ছে। তবে ট্রাইব্যুনালে লোকবল কম। তা বাড়াতে হবে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধীদের সংখ্যা সারা দেশে বহু। তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সে জন্য ট্রাইব্যুনালের পরিসর বাড়ানো প্রয়োজন। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারে শেখ হাসিনার সরকার আন্তরিক।
এ বছর সরকার সবচেয়ে সফল যে ব্যাপারে তা হলো, ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দমন করতে পেরেছে। গত ১০ বছরে তারা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছিল, ২০১১ সালে তা পারেনি। দেশকে তারা নিয়ে যেতে চেয়েছিল মধ্যযুগে, সেটা মহাজোট সরকার থামাতে পেরেছে শক্ত হাতে।
বছরটিতে বিরোধী দলের রাজনীতি হতাশাজনক। রুটিন মিটিং-মিছিল তারা করেছে। শেষ দিকে খালেদা জিয়া বিশাল গাড়িবহর নিয়ে ‘রোডমার্চ’ করেছেন। তাতে তাদের কর্মী ও সমর্থকদের মনোবল চাঙা হয়েছে। তবে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে বিরোধী দল কোনো জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
প্রধান বিরোধী দল কয়েকটি ইস্যুতে হরতাল দিয়েছে। ওই সব কর্মসূচিতে বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ দমনমূলক। হরতালের দিন তাদের সভা-সমাবেশের ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডারদের নিপীড়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর পুলিশি নির্যাতন সরকারকেই বিব্রত করেছে। তাতে বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একালের রাজনীতি আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতায় দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষ দিশেহারা। এর মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শেয়ারবাজারে। তাঁরা সারা বছরই রাজপথে ছিলেন। শেয়ারবাজার সমস্যার সমাধানে সরকারের ভূমিকা ছিল শূন্য।
এ যুগে কোনো দেশের রাজনীতিই শুধু দেশের মানুষ বিচার-বিবেচনা করে না। তার মূল্যায়ন হয় বহির্বিশ্বেও। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে বাইরের বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন সুখকর নয়। বছরের শেষ সপ্তাহে দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীর থিংক ট্যাংক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্থান হয়েছে ১৬৭ দেশের মধ্যে ৮৩তম। বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারকে বলা হয়েছে ‘হাইব্রিড রিজিস’। অর্থাৎ আমাদের গণতন্ত্র স্থবির—গতিশীল ও টেকসই নয়।
গত বছর সরকার জনগণকে কোনো আশার আলো দেখাতে পারেনি। এমন কিছু তাদের সামনে তুলে ধরতে পারেনি, যা মানুষকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী করতে পারে। জাতিকে করে তুলেছে অবসাদগ্রস্ত শুধু নয়, আতঙ্কগ্রস্তও। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে প্রতিহিংসা ও সংঘাতের রাজনীতি একটি বিপজ্জনক পর্যায়ে যেতে পারে আগামী দুই বছরে।
নতুন বছরের শুরুতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তাঁরা কোনো হঠকারী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেবেন না। প্রবীণ ও নতুন নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পূর্ববর্তী বছরের ভুল সিদ্ধান্তগুলো সংশোধন করার উদ্যোগ নেবেন। সংঘাত ও প্রতিহিংসা নয়, সমঝোতা ও সৌহার্দ্য দেখতে চাই। বিরোধী দলেরও উচিত হবে সরকারের ভালো উদ্যোগে সমর্থন দেওয়া। আমাদের নেতাদের একটি জায়গায় এসে দাঁড়াতেই হবে। পরস্পরের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। সব ব্যাপারে অনমনীয় থাকলে শেষ পর্যন্ত কারোরই লাভ হয় না। প্রতিপক্ষের প্রতি কঠোর নয়, কিছুটা সুনম্য হতেই হবে।
বর্তমান বছরটি সরকার, বিরোধী দল ও জনগণের জন্য শুভ হোক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম-লেখক।
সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন ঘটে সংসদে। সরকারের নীতি-নির্ধারণী কর্মকাণ্ড নিয়ে মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা সংসদে আলোচনা করেন। বিরোধী দলের, এমনকি সরকারি দলের সদস্যরাও তার পক্ষে-বিপক্ষে বলেন। জনগণের দাবিদাওয়া ও আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটে সংসদীয় বিতর্কে। সরকার কোন ক্ষেত্রে কী করছে, তা জনগণ জানতে পারে সংসদের আলোচনা থেকে। অর্থাৎ দেশের রাজনীতির পুরো চিত্র পাওয়া যায় সংসদ থেকে। সেই বিবেচনায় ২০১১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ছিল একেবারেই অকার্যকর, যদিও অধিবেশন বসেছে নিয়মিত।
গত বছর প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বহুবার বহু দেশ সফর করেছেন। সে সব সফরে বাংলাদেশ কী অর্জন করেছে, কী কী সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে, তা সংসদে আলোচনা করা হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বহু বছরের মধ্যে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সেটি প্রথম সফর। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে কিছু সমস্যাও রয়েছে। সে সব সমস্যা কর্মকর্তা পর্যায়ে নয়, রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার বিষয়। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে কী সব বিষয় আলোচনা হলো, কী অর্জিত হলো, কী পাওয়া গেল না, কেন পাওয়া গেল না, তা নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। এসব ব্যাপারে বিরোধী দলের ভূমিকাও শূন্য। তারা সংসদে গিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ও টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বিরোধী দল বাইরে রাস্তাঘাটে অর্থহীন হইচই করেছে, সস্তা রাজনীতি করেছে, সংসদে গিয়ে অর্থবহ কিছু করেনি।
একালে জাতীয় রাজনীতি আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বৈদেশিক সম্পর্ক রাজনীতির একটি বড় বিষয়। দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির স্বার্থে তা উপেক্ষার বিষয় নয়। এ বছর মহাজোট সরকার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দাতা দেশ এবং উন্নয়ন-সহযোগী দাতা সংস্থার আস্থা হারিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমী বিশ্বের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে।
যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর কাজ স্থগিত হয়েছে। যদিও সরকার তা স্বীকার করছে না। বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণে ঋণ দেবে না। অন্যান্য দাতা সংস্থাও গররাজি। দেশের জন্য, সরকারের জন্য সে এক বড় অপবাদ ও অসম্মান। বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত হলো না। তাতে মানুষ যদি মনে করে অভিযোগ অসত্য নয়, তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। এসব ব্যাপারে সংসদ নীরব।
বছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে সংবিধান সংশোধনের কারণে। সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে সরকার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিদের মতামত নিয়েছে। সেটি ছিল ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দিয়েছেন, তার কিছুই গ্রহণ করেনি সরকার। সে সব নিয়ে সংসদে আলোচনাও হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সর্বোচ্চ আদালত চার লাইনে একটি রায় ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। ১০ জন প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন আদালতে অ্যামিকাস কিউরি। তাঁরা কেউই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পরামর্শ দেননি। আদালতের সম্পূর্ণ রায় এখনো জানা যায়নি। তার আগেই তড়িঘড়ি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলো। সরকারি দলের অধিকাংশ প্রবীণ নেতা তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে ছিলেন না বলে শোনা যায়। বিরোধী দল অন্য কোনো ইস্যু না পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতেই রাজনীতি উত্তপ্ত রেখেছে।
অসুস্থ রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত বিচিত্র কর্মকাণ্ড ছিল বছরটির বৈশিষ্ট্য। হঠাৎ করে সরকার ঘোষণা দিল ঢাকাকে দুই ভাগ করার। সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতারা এবং নাগরিক সমাজ থেকে আপত্তি তোলা হলো। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো বিভক্তির বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রচার করল। ঘোরতর সরকার-সমর্থক কলাম লেখকেরাও ঢাকা ভাগ করা থেকে বিরত থাকতে সরকারকে পরামর্শ দিলেন। ঢাকাবাসী মিটিং-মিছিল করলেন। কিন্তু সরকার কারও কথার মূল্য দিল না। সাড়ে চার মিনিটে সংসদে স্থানীয় সরকার সংশোধন বিল পাস হলো। রাজধানী নগর দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। বিরোধী দলের নির্বাচিত মেয়রকে সরিয়ে সেখানে বসানো হয়েছে দুজন অনির্বাচিত কর্মকর্তাকে।
প্রায় সব মানুষের ধারণা, ঢাকা সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হলে সরকারি দলের প্রার্থীর পরাজয়ের আশঙ্কায় ঢাকাকে ভাগ করা হয়েছে। আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল বছরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর মধ্যে। কিন্তু যে প্রার্থীকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সমর্থন দেন, সেই প্রার্থী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। বিদ্রোহী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। তাঁর বিজয় সরকারকে বিব্রত করে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সরকারের শ্রদ্ধাবোধ কম—নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়। সৎ ও নিবেদিত নেতাদের চেয়ে দলে বিতর্কিতদের মূল্য বেশি।
গত বছর যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসর ঘাতক দালালদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে শুনানি হচ্ছে। তবে ট্রাইব্যুনালে লোকবল কম। তা বাড়াতে হবে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধীদের সংখ্যা সারা দেশে বহু। তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সে জন্য ট্রাইব্যুনালের পরিসর বাড়ানো প্রয়োজন। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারে শেখ হাসিনার সরকার আন্তরিক।
এ বছর সরকার সবচেয়ে সফল যে ব্যাপারে তা হলো, ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দমন করতে পেরেছে। গত ১০ বছরে তারা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছিল, ২০১১ সালে তা পারেনি। দেশকে তারা নিয়ে যেতে চেয়েছিল মধ্যযুগে, সেটা মহাজোট সরকার থামাতে পেরেছে শক্ত হাতে।
বছরটিতে বিরোধী দলের রাজনীতি হতাশাজনক। রুটিন মিটিং-মিছিল তারা করেছে। শেষ দিকে খালেদা জিয়া বিশাল গাড়িবহর নিয়ে ‘রোডমার্চ’ করেছেন। তাতে তাদের কর্মী ও সমর্থকদের মনোবল চাঙা হয়েছে। তবে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে বিরোধী দল কোনো জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
প্রধান বিরোধী দল কয়েকটি ইস্যুতে হরতাল দিয়েছে। ওই সব কর্মসূচিতে বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ দমনমূলক। হরতালের দিন তাদের সভা-সমাবেশের ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডারদের নিপীড়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর পুলিশি নির্যাতন সরকারকেই বিব্রত করেছে। তাতে বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একালের রাজনীতি আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতায় দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষ দিশেহারা। এর মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শেয়ারবাজারে। তাঁরা সারা বছরই রাজপথে ছিলেন। শেয়ারবাজার সমস্যার সমাধানে সরকারের ভূমিকা ছিল শূন্য।
এ যুগে কোনো দেশের রাজনীতিই শুধু দেশের মানুষ বিচার-বিবেচনা করে না। তার মূল্যায়ন হয় বহির্বিশ্বেও। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে বাইরের বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন সুখকর নয়। বছরের শেষ সপ্তাহে দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীর থিংক ট্যাংক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্থান হয়েছে ১৬৭ দেশের মধ্যে ৮৩তম। বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারকে বলা হয়েছে ‘হাইব্রিড রিজিস’। অর্থাৎ আমাদের গণতন্ত্র স্থবির—গতিশীল ও টেকসই নয়।
গত বছর সরকার জনগণকে কোনো আশার আলো দেখাতে পারেনি। এমন কিছু তাদের সামনে তুলে ধরতে পারেনি, যা মানুষকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী করতে পারে। জাতিকে করে তুলেছে অবসাদগ্রস্ত শুধু নয়, আতঙ্কগ্রস্তও। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে প্রতিহিংসা ও সংঘাতের রাজনীতি একটি বিপজ্জনক পর্যায়ে যেতে পারে আগামী দুই বছরে।
নতুন বছরের শুরুতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তাঁরা কোনো হঠকারী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেবেন না। প্রবীণ ও নতুন নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পূর্ববর্তী বছরের ভুল সিদ্ধান্তগুলো সংশোধন করার উদ্যোগ নেবেন। সংঘাত ও প্রতিহিংসা নয়, সমঝোতা ও সৌহার্দ্য দেখতে চাই। বিরোধী দলেরও উচিত হবে সরকারের ভালো উদ্যোগে সমর্থন দেওয়া। আমাদের নেতাদের একটি জায়গায় এসে দাঁড়াতেই হবে। পরস্পরের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। সব ব্যাপারে অনমনীয় থাকলে শেষ পর্যন্ত কারোরই লাভ হয় না। প্রতিপক্ষের প্রতি কঠোর নয়, কিছুটা সুনম্য হতেই হবে।
বর্তমান বছরটি সরকার, বিরোধী দল ও জনগণের জন্য শুভ হোক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম-লেখক।
No comments