উচ্চশিক্ষা স্তরে পাঠ্যবই-জ্ঞানের রাজ্যে কূপমণ্ডূকতা নয়
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ানো বিষয়ের পাঠ্যবই বিদেশি ভাষায় থাকলে তার বাংলা ভাষ্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এ জন্য পৃথক আইন প্রণীত হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু সহজে বুঝতে পারে, সে লক্ষ্যেই এমন আয়োজন। যে কোনো দেশেই মাতৃভাষায় পড়াশোনা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর জন্য সহজ। এ বিবেচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ প্রশংসিত হবে। মানবিক, ব্যবসায় ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের বই বাংলা ভাষায় রচিত হলে ইংরেজিতে কাঁচা
শিক্ষার্থীরা অবশ্যই উপকৃত হবে। বাংলা একটি সমৃদ্ধ ভাষা। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেসব পাঠ্যবই ছাত্রছাত্রীর জন্য অবশ্য পঠনীয় হিসেবে সুপারিশ করে তার সব না হোক, বেশিরভাগ বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশ করার উদ্যোগ থাকতে হবে। এ জন্য জনবল ও অর্থ দরকার এবং তার আয়োজন সরকারকে করতে হবে। আমাদের এ ভূখণ্ড জনবহুল এবং উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। এ কারণে বইয়ের গ্রাহক পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া এ ধরনের কাজে মূল বিনিয়োগ আসার কথা সরকারি সূত্র থেকে। জ্ঞানের প্রসারে সব ধরনের সহায়তার নীতি অনুসরণ করলে বইয়ের দাম সাধারণের আয়ত্তেই থাকার কথা। তবে একই সঙ্গে কিছু সতর্কবার্তাও দিয়ে রাখা ভালো। বিশ্বায়নের যুগে বিভিন্ন দেশের মানুষ পরস্পর আরও কাছে চলে আসছে। ভাষা-সংস্কৃতির ব্যবধান এ ক্ষেত্রে জোরালো প্রতিবন্ধক নয়। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের একটি সুবিধা যে, এখানে স্কুলের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ইংরেজি পড়ানো হয়। ফলে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতে পড়াশোনা সহজ হয়। আবার এটাও দেখা যায় ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, জাপানসহ আরও অনেক দেশে পড়তে গিয়ে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা কয়েক মাসের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা রপ্ত করে এবং সে ভাষাতেই উচ্চতর কোর্সের পড়াশোনা সমাপ্ত করে। এভাবে একটি বিদেশি ভাষাও রপ্ত হয়, যা তাদের কর্মজীবনেও সহায়তা করে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে লাখ লাখ শিক্ষার্থী থাকে তারাও বাংলার পাশাপাশি অন্তত একটি বিদেশি ভাষা স্বচ্ছন্দে লিখতে ও বলতে পারলে জ্ঞানের জগতে বিচরণের কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু পাঠ্যবই নয়, এর বাইরেও রয়েছে জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার এবং তা থেকে নিজের জন্য যত রসদ আহরণ করা যায় ততই ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল। এ জন্য পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি আরও অনেক বই নাগালে থাকা আবশ্যক। উচ্চতর পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ের বাংলায় অনুবাদ শুভ উদ্যোগ। একই সঙ্গে নানা ভাষার উল্লেখযোগ্য রচনাও বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা থাকা চাই। এ কাজে বাংলা একাডেমী বিশেষভাবে তৎপর হতে পারে। বিষয়টিকে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তাদের নিয়মিত কাজের অংশ করা যায়। প্রত্যেকেই রাখতে পারে বিশেষ অনুবাদ বিভাগ, যার সঙ্গে যুক্ত করা চলে আমাদের সমৃদ্ধ প্রকাশনা শিল্পকে। সাহিত্যের পাশাপাশি বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানবিক বিষয়_ সবকিছুকেই গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে কিন্তু বাংলাদেশের লেখকদের বইও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন পড়বে আমাদের লেখকদের বইয়ের প্রতি বিশ্বব্যাপী আগ্রহ সৃষ্টি করা। তাতে বাংলাদেশের পরিচিতিও বাড়বে এবং আমাদের লেখকদের জন্যও সৃষ্টি হতে থাকবে বিপণনের নতুন ক্ষেত্র। তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে, জ্ঞানের রাজ্যে কূপমণ্ডূকতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
No comments