ওশান সিটির এমডির কোন তথ্য ঠিক? by কবির হোসেন
ওশান গ্রুপের পরিচালক এবং ওশান সিটি লিমিটেড ও ওশান আর্থ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খন্দকার আলী আজম বাবলার বিরুদ্ধে ভুয়া পরিচয় ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। ‘যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করায়’ মাগুরা জেলা আইনজীবী সমিতি গত শনিবার আলী আজমকে সংবর্ধনা দেয়। এ উপলক্ষে শহরে আলী আজমের ছবিসহ ব্যানার-পোস্টার ও তোরণ করা হয়। আলী আজমের ছবি দেখে শহরের
সচেতন লোকজন কিছুটা বিস্মিত হন এবং প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে ফোন করে তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্য দেন।
সংবর্ধনা চলাকালেই জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, আলী আজম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তাই তারা আজমের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বর্জন করেছে।
বাবার নাম: অনুষ্ঠানে আলী আজমের একটি লিখিত জীবনবৃত্তান্ত বিতরণ ও পড়ে শোনানো হয়। জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, খন্দকার আলী আজম বাবলার বাবা মৃত খন্দকার আবদুস সামাদ। মা মৃত আমেনা বেগম।
কিন্তু আলী আজমের ছোট ভাই শহরের টগর ইলেকট্রনিকসের মালিক অহিদুর রহমান টগর জানান, তাঁর বাবার নাম মো. শফিউদ্দিন। তিনি শফি দারোগা নামে পরিচিত ছিলেন। মায়ের নামে আমেনা বেগম। বাবলা তাঁর মেজো ভাই। সেজো ভাই বাকু কক্সবাজার এবং নোয়া ভাই টিটুল কুয়াকাটায় ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
মেজো ভাই বাবলা সম্পর্কে জানতে চাইলে টগর ছাপানো একটি জীবনবৃত্তান্ত এগিয়ে দিয়ে বলেন, এটা মেজো ভাই দিয়ে গেছেন। পড়লে সব জানতে পারবেন। এতে লেখা আছে, আলী আজমের মাগুরায় শফিউদ্দিন বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তবে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রুহুল আমিন খান গতকাল প্রথম আলোকে জানান, এই নামে জেলায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই।
জন্মতারিখ ও মুক্তিযুদ্ধ: অনুষ্ঠানে বলা হয়, ‘ড. আলী আজম’ ১৪ বছর বয়সে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনবৃত্তান্তের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর জন্মতারিখ ১৯৬১ সালের ৩ এপ্রিল। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র নয় বছর আট মাস।
এ বিষয়ে পরে প্রথম আলোর ঢাকা অফিস থেকে জানতে চাইলে আলী আজম জানান, জন্মের তথ্যটি ভুল লেখা হয়েছে। এটা ৫৭ সাল হবে। অনুষ্ঠানে তা বলাও হয়েছে।
আলী আজমের সংবর্ধনা যখন চলছিল, তখন মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, আলী আজম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোল্লা নবুওয়াত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী সমিতি আলী আজমের সংবর্ধনায় আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু আলী আজম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তাই আমরা অনুষ্ঠান বর্জন করেছি।’
এ বিষয়ে আলী আজম বলেন, ‘অনুষ্ঠানে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকেও সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। আমার ব্যাপারে আপনি আকবর বাহিনীর আকবর চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করেন।’
আকবর হোসেন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলী আজম বাবলা মুক্তিযোদ্ধা কি না, তা আমি জানি না। সে যদি বলে বেড়ায় সেটা তার ব্যাপার। সে প্রমাণ করুক। তবে ওই সময় সে ছোট ছিল।’
শিক্ষাগত যোগ্যতা: জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, আলী আজম ১৯৭৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে যশোর বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয়, ১৯৭৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ড থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সম্মিলিত মেধাতালিকায় তৃতীয় হন। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে স্নাতকোত্তর করেন।
কোন স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন জানতে চাইলে আলী আজম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চুয়াডাঙ্গা ভি জে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি করেছি।’
চুয়াডাঙ্গা ভি জে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৭৬ সালে আলী আজম নামে কোনো ছাত্র এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্তও ওই নামে কেউ পরীক্ষা দেয়নি। এ সময়ে স্কুলের কোনো ছাত্র স্ট্যান্ডও করেনি।’
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উচ্চপর্যায়ের সূত্র নিশ্চিত করেছে, বোর্ডের রেকর্ডপত্রে ১৯৭৬ সালে বিজ্ঞান বিভাগে আলী আজম নামে কোনো শিক্ষার্থী মেধাতালিকায় স্থান পায়নি।
এই তথ্য জানালে আলী আজম বলেন, ‘তাই বলেছে? আমাকে এক দিন সময় দিলে কাগজপত্র দেখাতে পারব।’
আলী আজমের গ্রামের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার তারাউজিয়াল গ্রামে। পাশের আমতৈল গ্রামের ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমি ১৯৮৪ সালে আমতৈল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। তারাউজিয়াল গ্রামের আলী আজম বাবলা আমার সঙ্গে পড়ত। ক্লাস নাইনে ওঠার পর ও ঢাকার মিরপুরে পিপলস প্রোডাক্টস গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি। আমি এসএসসি পাস করার পর ওর মাধ্যমে ওই গার্মেন্টসে চাকরি নিই। এক বছর পর একটা অভিযোগে বাবলার চাকরি চলে যায়। কয়েক বছর পর মাগুরায় এসে বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা শুরু করে সে।’
নাসায় চাকরি এবং মাগুরা থেকে পলায়ন: জীবনবৃত্তান্তে বলা আছে, আলী আজম ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় চাকরি করেছেন।
কিন্তু মাগুরা শহরের পিটিআইপাড়ার বাসিন্দা আইনজীবী ইসলাম আলী সর্দার বলেন, ‘২০০২ সালে আলী আজম বাবলা এক হাজার টাকা ভাড়ায় আমার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। বাড়ির মধ্যে পালাডা নামে একটি এনজিও খুলে বসেন। দু-তিন মাসের মধ্যে পাওনা টাকা নিয়ে লোকজন বাড়ি আসা শুরু করলে তাঁকে চলে যেতে বলি। পরে শহরে অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া নেন তিনি।’
হাসপাতালপাড়ার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০২ সালের শেষ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আলী আজম বাবলা আমাদের বাড়ির একটি অংশ ভাড়া নিয়ে পালাডা নামে একটি সংস্থা চালাতেন। একপর্যায়ে তিনি গ্রাহকদের টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে যান।’
মাগুরা কালেক্টরেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক কুমুদরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘বাবলার বড় মেয়ে ২০০২ সালে আমার স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় কিছু না জানিয়েই স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। পরে জানতে পারি, তার বাবা পরিবার নিয়ে মাগুরা থেকে চলে গেছেন। ২০০৩ সালে আমি তাঁর বাসায় ভাতও খেয়েছি।’
জানতে চাইলে আলী আজমের দাবি, ‘আমি ১৯৮৭ সালে আমেরিকায় চলে যাই। সেখানে ফ্লোরিডায় অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ালেখা করি। মাগুরায় আমার ভাইয়েরা থাকেন। সে জন্য হয়তো ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।’
কিন্তু জীবনবৃত্তান্তে আছে, আপনি ১৯৮৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ইয়াং ওয়ানের পরিচালক (টেকনিক্যাল) ছিলেন—এই প্রশ্নের জবাবে আলী আজম বলেন, ‘জীবনীটায় কিছু তথ্য ভুল থাকতে পারে।’
এবং মামলা: শ্রীপুরের নাকোল গ্রামের গোলাম সরোয়ার এক লাখ টাকা রাখেন আলী আজমের পালাডা এনজিওতে। পালাডা গুটিয়ে আলী আজম উধাও হয়ে গেলে তিনি ২০০৫ সালে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের মামলা করেন। (মামলা নম্বর শ্রীপুর সিআর-১৩/২০০৫)। ২০০৬ সালের ৫ ডিসেম্বর আদালত আলী আজমের অনুপস্থিতিতে তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেন।
রায় ঘোষণার পাঁচ বছর পর গত ২০ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হয়ে জামিন চান আলী আজম। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গত ২২ সেপ্টেম্বর জজ আদালতে আপিল (নম্বর ৯০/১১) করেন। আপিলের শুনানি শেষে ২৭ সেপ্টেম্বর আদালত জামিন দেন। মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি।
বাদীর আইনজীবী আবদুর রশীদ বলেন, ‘আসামি আলী আজম বাবলার অনুপস্থিতিতে সাজা হয়েছে। আইন ভেঙে জজ আদালত বাদীপক্ষকে নোটিশ না করে আসামিকে জামিন দেন। তাই আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ এবং জামিনে মুক্তি পাওয়ার দিন আমরা আদালতে হাজির ছিলাম না। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ২২ সেপ্টেম্বর জামিনের আবেদন করার পর ২৭ সেপ্টেম্বর জামিন দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা শুনানির নোটিশ পেয়েছি ৯ অক্টোবর।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী ধার্য তারিখে আসামি চিহ্নিত করতে আদালতে আবেদন করব।’
জানতে চাইলে আলী আজম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এমন কোনো মামলা নেই।’
তবে মাগুরা কারাগারের কারাধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘গত ২০ সেপ্টেম্বর আলী আজম বাবলা, পিতা: শফিউদ্দিন (শফি দারোগা), গ্রাম: তারাউজিয়াল, শ্রীপুর, মাগুরা নামে একজন আসামি কারাগারে আসেন। আসামির সিরিয়াল নম্বর ১৮১৯/১১। মামলা নম্বর সিআর ১৩/২০০৫। ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।’
আলী আজম বলেন, পালাডা নামে তিনি কোনো এনজিও করেননি। পালাডা যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রতিষ্ঠানের নাম।
কিন্তু তাঁর জীবনবৃত্তান্তেই দেখা যায়, আলী আজম পালাডা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক।
প্রাতিষ্ঠানিক পদবি: জীবনবৃত্তান্তে বলা হয়, আলী আজম মিট দ্য নদী, ওশান মিডিয়া, ওশান ট্যুরিজম কনসেপ্ট, ওশান পার্ল ও অ্যাম্পায়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি দৈনিক স্বাধীনমত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। যুক্তরাষ্ট্রের আমরা ঢাকাবাসী সংগঠনের সাবেক আহ্বায়ক, যুক্তরাষ্ট্রের নেক্সট (এটি আসলে যুক্তরাজ্যের একটি ব্র্যান্ড), এফডি, ফুড মার্ট ও হ্যাকসন ট্রাক স্টকের স্বত্বাধিকারী। কুয়াকাটা ইনভেস্টরস ফোরামের সভাপতি।
কেন সংবর্ধনা: জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী সমিতির খুব গরিবি হাল। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই সংবর্ধনার আয়োজন করতে হয়েছে। আলী আজম আইনজীবী সমিতিকে ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন।’
সংবর্ধনা নিতে হেলিকপ্টারে আসেন আলী আজম। এ উপলক্ষে শহরে তোরণ নির্মাণ, ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো হয়। সংবর্ধনা শেষে তিনি হেলিকপ্টারে তারাউজিয়াল গ্রামে গিয়ে ‘নিউ আর্থ সেভ হোম’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ঢাকায় ফিরে যান।
সংবর্ধনা চলাকালেই জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, আলী আজম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তাই তারা আজমের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বর্জন করেছে।
বাবার নাম: অনুষ্ঠানে আলী আজমের একটি লিখিত জীবনবৃত্তান্ত বিতরণ ও পড়ে শোনানো হয়। জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, খন্দকার আলী আজম বাবলার বাবা মৃত খন্দকার আবদুস সামাদ। মা মৃত আমেনা বেগম।
কিন্তু আলী আজমের ছোট ভাই শহরের টগর ইলেকট্রনিকসের মালিক অহিদুর রহমান টগর জানান, তাঁর বাবার নাম মো. শফিউদ্দিন। তিনি শফি দারোগা নামে পরিচিত ছিলেন। মায়ের নামে আমেনা বেগম। বাবলা তাঁর মেজো ভাই। সেজো ভাই বাকু কক্সবাজার এবং নোয়া ভাই টিটুল কুয়াকাটায় ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
মেজো ভাই বাবলা সম্পর্কে জানতে চাইলে টগর ছাপানো একটি জীবনবৃত্তান্ত এগিয়ে দিয়ে বলেন, এটা মেজো ভাই দিয়ে গেছেন। পড়লে সব জানতে পারবেন। এতে লেখা আছে, আলী আজমের মাগুরায় শফিউদ্দিন বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তবে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রুহুল আমিন খান গতকাল প্রথম আলোকে জানান, এই নামে জেলায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই।
জন্মতারিখ ও মুক্তিযুদ্ধ: অনুষ্ঠানে বলা হয়, ‘ড. আলী আজম’ ১৪ বছর বয়সে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনবৃত্তান্তের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর জন্মতারিখ ১৯৬১ সালের ৩ এপ্রিল। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র নয় বছর আট মাস।
এ বিষয়ে পরে প্রথম আলোর ঢাকা অফিস থেকে জানতে চাইলে আলী আজম জানান, জন্মের তথ্যটি ভুল লেখা হয়েছে। এটা ৫৭ সাল হবে। অনুষ্ঠানে তা বলাও হয়েছে।
আলী আজমের সংবর্ধনা যখন চলছিল, তখন মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, আলী আজম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোল্লা নবুওয়াত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী সমিতি আলী আজমের সংবর্ধনায় আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু আলী আজম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তাই আমরা অনুষ্ঠান বর্জন করেছি।’
এ বিষয়ে আলী আজম বলেন, ‘অনুষ্ঠানে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকেও সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। আমার ব্যাপারে আপনি আকবর বাহিনীর আকবর চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করেন।’
আকবর হোসেন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলী আজম বাবলা মুক্তিযোদ্ধা কি না, তা আমি জানি না। সে যদি বলে বেড়ায় সেটা তার ব্যাপার। সে প্রমাণ করুক। তবে ওই সময় সে ছোট ছিল।’
শিক্ষাগত যোগ্যতা: জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, আলী আজম ১৯৭৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে যশোর বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয়, ১৯৭৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ড থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সম্মিলিত মেধাতালিকায় তৃতীয় হন। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে স্নাতকোত্তর করেন।
কোন স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন জানতে চাইলে আলী আজম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চুয়াডাঙ্গা ভি জে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি করেছি।’
চুয়াডাঙ্গা ভি জে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৭৬ সালে আলী আজম নামে কোনো ছাত্র এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্তও ওই নামে কেউ পরীক্ষা দেয়নি। এ সময়ে স্কুলের কোনো ছাত্র স্ট্যান্ডও করেনি।’
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উচ্চপর্যায়ের সূত্র নিশ্চিত করেছে, বোর্ডের রেকর্ডপত্রে ১৯৭৬ সালে বিজ্ঞান বিভাগে আলী আজম নামে কোনো শিক্ষার্থী মেধাতালিকায় স্থান পায়নি।
এই তথ্য জানালে আলী আজম বলেন, ‘তাই বলেছে? আমাকে এক দিন সময় দিলে কাগজপত্র দেখাতে পারব।’
আলী আজমের গ্রামের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার তারাউজিয়াল গ্রামে। পাশের আমতৈল গ্রামের ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমি ১৯৮৪ সালে আমতৈল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। তারাউজিয়াল গ্রামের আলী আজম বাবলা আমার সঙ্গে পড়ত। ক্লাস নাইনে ওঠার পর ও ঢাকার মিরপুরে পিপলস প্রোডাক্টস গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি। আমি এসএসসি পাস করার পর ওর মাধ্যমে ওই গার্মেন্টসে চাকরি নিই। এক বছর পর একটা অভিযোগে বাবলার চাকরি চলে যায়। কয়েক বছর পর মাগুরায় এসে বিদেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা শুরু করে সে।’
নাসায় চাকরি এবং মাগুরা থেকে পলায়ন: জীবনবৃত্তান্তে বলা আছে, আলী আজম ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় চাকরি করেছেন।
কিন্তু মাগুরা শহরের পিটিআইপাড়ার বাসিন্দা আইনজীবী ইসলাম আলী সর্দার বলেন, ‘২০০২ সালে আলী আজম বাবলা এক হাজার টাকা ভাড়ায় আমার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। বাড়ির মধ্যে পালাডা নামে একটি এনজিও খুলে বসেন। দু-তিন মাসের মধ্যে পাওনা টাকা নিয়ে লোকজন বাড়ি আসা শুরু করলে তাঁকে চলে যেতে বলি। পরে শহরে অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া নেন তিনি।’
হাসপাতালপাড়ার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০২ সালের শেষ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আলী আজম বাবলা আমাদের বাড়ির একটি অংশ ভাড়া নিয়ে পালাডা নামে একটি সংস্থা চালাতেন। একপর্যায়ে তিনি গ্রাহকদের টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে যান।’
মাগুরা কালেক্টরেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক কুমুদরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘বাবলার বড় মেয়ে ২০০২ সালে আমার স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় কিছু না জানিয়েই স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। পরে জানতে পারি, তার বাবা পরিবার নিয়ে মাগুরা থেকে চলে গেছেন। ২০০৩ সালে আমি তাঁর বাসায় ভাতও খেয়েছি।’
জানতে চাইলে আলী আজমের দাবি, ‘আমি ১৯৮৭ সালে আমেরিকায় চলে যাই। সেখানে ফ্লোরিডায় অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ালেখা করি। মাগুরায় আমার ভাইয়েরা থাকেন। সে জন্য হয়তো ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।’
কিন্তু জীবনবৃত্তান্তে আছে, আপনি ১৯৮৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ইয়াং ওয়ানের পরিচালক (টেকনিক্যাল) ছিলেন—এই প্রশ্নের জবাবে আলী আজম বলেন, ‘জীবনীটায় কিছু তথ্য ভুল থাকতে পারে।’
এবং মামলা: শ্রীপুরের নাকোল গ্রামের গোলাম সরোয়ার এক লাখ টাকা রাখেন আলী আজমের পালাডা এনজিওতে। পালাডা গুটিয়ে আলী আজম উধাও হয়ে গেলে তিনি ২০০৫ সালে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের মামলা করেন। (মামলা নম্বর শ্রীপুর সিআর-১৩/২০০৫)। ২০০৬ সালের ৫ ডিসেম্বর আদালত আলী আজমের অনুপস্থিতিতে তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেন।
রায় ঘোষণার পাঁচ বছর পর গত ২০ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হয়ে জামিন চান আলী আজম। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গত ২২ সেপ্টেম্বর জজ আদালতে আপিল (নম্বর ৯০/১১) করেন। আপিলের শুনানি শেষে ২৭ সেপ্টেম্বর আদালত জামিন দেন। মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি।
বাদীর আইনজীবী আবদুর রশীদ বলেন, ‘আসামি আলী আজম বাবলার অনুপস্থিতিতে সাজা হয়েছে। আইন ভেঙে জজ আদালত বাদীপক্ষকে নোটিশ না করে আসামিকে জামিন দেন। তাই আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ এবং জামিনে মুক্তি পাওয়ার দিন আমরা আদালতে হাজির ছিলাম না। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ২২ সেপ্টেম্বর জামিনের আবেদন করার পর ২৭ সেপ্টেম্বর জামিন দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা শুনানির নোটিশ পেয়েছি ৯ অক্টোবর।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী ধার্য তারিখে আসামি চিহ্নিত করতে আদালতে আবেদন করব।’
জানতে চাইলে আলী আজম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এমন কোনো মামলা নেই।’
তবে মাগুরা কারাগারের কারাধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘গত ২০ সেপ্টেম্বর আলী আজম বাবলা, পিতা: শফিউদ্দিন (শফি দারোগা), গ্রাম: তারাউজিয়াল, শ্রীপুর, মাগুরা নামে একজন আসামি কারাগারে আসেন। আসামির সিরিয়াল নম্বর ১৮১৯/১১। মামলা নম্বর সিআর ১৩/২০০৫। ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।’
আলী আজম বলেন, পালাডা নামে তিনি কোনো এনজিও করেননি। পালাডা যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রতিষ্ঠানের নাম।
কিন্তু তাঁর জীবনবৃত্তান্তেই দেখা যায়, আলী আজম পালাডা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক।
প্রাতিষ্ঠানিক পদবি: জীবনবৃত্তান্তে বলা হয়, আলী আজম মিট দ্য নদী, ওশান মিডিয়া, ওশান ট্যুরিজম কনসেপ্ট, ওশান পার্ল ও অ্যাম্পায়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি দৈনিক স্বাধীনমত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। যুক্তরাষ্ট্রের আমরা ঢাকাবাসী সংগঠনের সাবেক আহ্বায়ক, যুক্তরাষ্ট্রের নেক্সট (এটি আসলে যুক্তরাজ্যের একটি ব্র্যান্ড), এফডি, ফুড মার্ট ও হ্যাকসন ট্রাক স্টকের স্বত্বাধিকারী। কুয়াকাটা ইনভেস্টরস ফোরামের সভাপতি।
কেন সংবর্ধনা: জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী সমিতির খুব গরিবি হাল। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই সংবর্ধনার আয়োজন করতে হয়েছে। আলী আজম আইনজীবী সমিতিকে ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন।’
সংবর্ধনা নিতে হেলিকপ্টারে আসেন আলী আজম। এ উপলক্ষে শহরে তোরণ নির্মাণ, ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো হয়। সংবর্ধনা শেষে তিনি হেলিকপ্টারে তারাউজিয়াল গ্রামে গিয়ে ‘নিউ আর্থ সেভ হোম’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ঢাকায় ফিরে যান।
No comments