ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক-পুরো সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ! by পান্না বালা

৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দুপুরের দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের চুমুরদি থেকে বাবলাতলা এলাকায় কয়েকজন শ্রমিক সড়কের পাশের খাদ থেকে মাটি কেটে রাস্তার কিনারে ফেলছিলেন। জানা গেল, তাঁরা মাদারীপুর সড়ক বিভাগের শ্রমিক। কাজের তত্ত্বাবধায়ক মো. শহীদ জানান, ‘গাড়িগুলো পাশ দিতে যাইয়া কিনারে আইসা যাতে উল্টাইয়া না যায়, সে জন্য মাটি দেওয়া হচ্ছে।’ এই সড়কে নিয়মিত বাস চালান গৌরাঙ্গ সিকদার। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর ঝুঁকির ও আতঙ্কের মধ্যে


গাড়ি চালাতে হয়। কোনো কোনো জায়গায় কিনারে এক থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত মাটি নেই। অন্য গাড়িকে পাশ দিতে গেলে যেকোনো সময় বাস উল্টে যাওয়ার ভয় থাকে।’ হানিফ পরিবহনের চালক মো. মোমিন খান বলেন, ‘পুরো সড়কই যেন মৃত্যুর ফাঁদ। জীবন বাজি রেখে চলাচল করতে হয়।’
ফরিদপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার রায় জানান, মহাসড়কের পাকা অংশ ন্যূনতম ২৪ ফুট প্রশস্ত হতে হবে। সড়কের পাশের পাকা অংশ ও কাঁচা অংশ (শোল্ডার) মিলে (দুই পাশে ছয় ফুট করে) পুরো সড়কটি কমপক্ষে ৩৬ ফুট হতে হবে। কিন্তু এর কোনো শর্তই পূরণ করতে পারেনি ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কটি বরিশাল বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়ে ফরিদপুরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে এসে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
এই মহাসড়কটির বরিশাল বাসস্ট্যান্ড থেকে মাদারীপুরের ভুরঘাটা পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটারের দায়িত্ব বরিশাল সড়ক বিভাগের। ভুরঘাটা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার অংশ মাদারীপুর সড়ক বিভাগ এবং বাকি ৩০ কিলোমিটার ফরিদপুর সড়ক বিভাগের অধীনে।
জানা যায়, ১৯৯৯ ও ২০০০ সালের বিভিন্ন সময়ে এই মহাসড়কে বিটুমিনের প্রলেপ দেওয়া হয়। এরপর গত ১১ বছরে কোনো সংস্কার করা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১০ টন ওজনের ভারবাহী পরিবহন চলাচলের জন্য। কিন্তু বর্তমানে এই সড়কে ৩০ থেকে ৪০ টন ওজনের ভারবাহী পরিবহন চলাচল করে। অত্যধিক ওজনের কারণে সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি পাঁচ বছর পর পর যেকোনো সড়কের ওপরে দুই থেকে তিন ইঞ্চি পরিমাণ বিটুমিনের প্রলেপ দিতে হয়। কিন্তু গত ১১ বছরে ওই সড়কে তা করা হয়নি। সড়কটি অপ্রশস্ত হওয়ায় অন্য গাড়িকে পাশ দিতে গিয়ে কোনো কোনো গাড়িকে সড়কের কিনারে চলে যেতে হয়, ফলে শোল্ডার ক্ষতি হয়েছে।
সরেজমিন: সরেজমিনে ফরিদপুর থেকে টেকেরহাট পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার অংশে দেখা যায়, মুন্সিবাজারের কাছে সেতুর সঙ্গে সড়কের সংযোগে মাটি নেই, সৃষ্টি হয়েছে খাদের। বাখান্ডা সেতুর পশ্চিম পাড়ে সড়কটির উত্তর অংশের অর্ধেক জায়গাজুড়ে এবড়োখেবড়ো হয়ে দেবে গেছে। এখানে প্রায় এক কিলোমিটার অংশজুড়ে সড়কের মধ্যে রয়েছে নানা আকারের গর্ত। নওপাড়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত সড়কের প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশ বিভিন্ন জায়গায় দেবে যাওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ। বাবলাতলা বাজার থেকে টেকেরহাটের চুমুরদি পর্যন্ত সড়কের পাশে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
বরিশাল সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বরিশাল-ভুরঘাটা ৪৮ কিলোমিটারের জন্য ৯৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দের আদেশ পাওয়া যায়। প্রথম পর্যায়ে ওই কার্যাদেশের মাত্র তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। টাকা পাওয়ার পর সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে।
মাদারীপুরের ভুরঘাটা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত সড়কের বেশির ভাগ অংশেই দুই পাশে এক ফুটেরও বেশি গভীর গর্ত রয়েছে।
মাদারীপুর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান জানান, পান্তাপাড়া এলাকায় সেতুর কাজ করতে গত সপ্তাহে নতুন করে ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সড়কের যেসব এলাকায় দুই পাশে মাটি নেই, তা শিগগিরই মেরামত করা হবে।
ফরিদপুর সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, শোল্ডার থেকে মাটি এক ফুট নিচে। এলাকাবাসী জানান, নগরকান্দা উপজেলার ডাঙ্গি বাশাগাড়ী থেকে কাজী করিয়াল পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার অংশ সবচেয়ে বিপজ্জনক। প্রায় দুই বছর ধরে অংশটির বিভিন্ন অংশ দেবে এক থেকে দুই ফুট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। জানা যায়, সড়কটির ওই অংশে নতুন করে নির্মাণকাজ শুরু হয়। গত জুন মাসে কাজের শুরুতে রাস্তাটি তুলে ফেলা হয়। ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র এক কিলোমিটার অংশের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি অংশের কাজ চলছে।
ফরিদপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সন্তোষ কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, ২০০০ সালের পর সড়কের ফরিদপুর অংশে কোনো সংস্কার করা হয়নি। গত এপ্রিলে ১৬ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করে আগস্টে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। টাকা বরাদ্দ না পাওয়ায় এখনো কাজ শুরু করা যায়নি।
বরিশাল বিভাগের আওতায় জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর সংস্কারের দাবিতে পরিবহন মালিক সমিতি, ট্রাক মালিক সমিতি, পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনও করেছে।
বরিশাল সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী গুলজার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরপত্র আহ্বান করা হলেও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কাজ করতে সমস্যা হয়েছে। তবে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করার জন্য অতিরিক্ত ৮০ কোটি টাকা প্রয়োজন, যা আমরা দ্রুত পাব বলে আশা করি। পেলে কাজ শুরু হবে।’
[এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সাইফুর রহমান, বরিশাল ও জহিরুল ইসলাম খান, মাদারীপুর]

No comments

Powered by Blogger.