স্বাস্থ্য-আস্থাহীনতা থেকে আস্থার ভবিষ্যতে by ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

০১১ আমাদের স্বাস্থ্য খাতে এক আলোড়ন তোলা বছর। চিকিৎসক, রোগী ও মিডিয়ার পারস্পরিক আন্তসম্পর্ক এ বছরকে এক অনন্য রূপ দান করেছে। আমরা এমন অনেক কিছুই হতে দেখেছি, যা আগে কখনোই সেভাবে হয়নি বা হয়তো টুকিটাকি হলেও তা অতটা ভয়াবহ হয়নি, তার প্রচার বা অপপ্রচার কোনোটাই হয়নি। অনেক ঘটনা কারও জন্যই আনন্দদায়ক ছিল না। বছরজুড়ে এগুলো আমাদের আলোড়িত করেছে, রোগী ও চিকিৎসক অনেককেই কষ্ট দিয়েছে।


তাই আমাদের অনেক কিছুই ভাবতে শিখিয়েছে, নতুন কিছু চেতনার জন্ম দিয়েছে এবং ভবিষ্যৎ বাস্তবসম্মত কিছু করারও প্রেরণা জুগিয়েছে।
২০১১ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা—রোগীর মৃত্যু হলেই তাঁর আত্মীয়স্বজন ‘ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু’ এসব অভিযোগ করেন। একটি হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা, হাতকড়া পরিয়ে একজন খুনি বা ডাকাতের মতো করে থানায় এবং রিমান্ডে নেওয়া। এর সঙ্গে একই অভিযোগে হাসপাতাল ভাঙচুর, চিকিৎসক, নার্সসহ হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর শারীরিক আক্রমণও চলে। এ ঘটনা স্বভাবতই চিকিৎসক সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেকেই অযথা হয়রানির ভয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর চিকিৎসা করা থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে কিছু কিছু কাগজে ও মিডিয়ায় চিকিৎসকদের দোষ দিয়ে একপেশে খবর প্রকাশের ফলে সাধারণ মানুষও সমগ্র চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। কোনো রোগী মারা গেলে তাঁর আত্মীয় ভাবতে শুরু করেন যে ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেল, দোষ পুরোটা চিকিৎসকেরই। একবারও কেউ ভাবেন না যে চিকিৎসকদের ভুল নয় জটিল রোগের কারণেও রোগীর মৃত্যু হতে পারে। যেমন, হূদেরাগ বা স্ট্রোকের রোগী অথবা লিভার ফেইলিউর কিংবা কিডনি ফেইলিউরের রোগী। এমনও শোনা যায়, শুধু হাসপাতালের বিল না দেওয়ার উদ্দেশ্যেই রোগী মারা যাওয়া মাত্র হাসপাতালে ভাঙচুর ও অন্যান্য তাণ্ডব চালানো শুরু হয়, হাসপাতালের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যেই ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তোলা হয়। সব মিলিয়ে রোগী ও চিকিৎসকের আন্তসম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।
২০১১ সালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়ে লেখালেখি—দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে অর্থের লোভ দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কিডনি নিয়ে বেআইনিভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর ফল ছিল ভয়াবহ। সাধারণ মানুষের চোখে চিকিৎসক হয়ে ওঠেন আস্থার অযোগ্য, মানবিকতা বোধহীন অপরাধী। অন্যদিকে চিকিৎসকেরা আতঙ্কে কিডনি প্রতিস্থাপন করাই বন্ধ করে দেন। সরকারও কিডনি প্রতিস্থাপন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ কারণে সমস্যায় পড়েন কিডনির রোগীরা, যাঁরা প্রতিস্থাপনের জন্য তৈরি হয়েছিলেন।
আরও কিছু কারণে ২০১১ সাল ছিল স্বাস্থ্য খাতের জন্য চরম অস্থিরতার বছর। আগের সরকারের সময় যেমন স্বাস্থ্য খাত দলীয় বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি, গত সালটিও তেমনি বর্তমান সরকারের চিকিৎসকের সংগঠনের বলয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিল। স্বাস্থ্য খাতে লোকবল নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি-বাণিজ্য, হাসপাতালে ওষুধসহ কেনাকাটায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদেরই মুঠোয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ঝুলে থাকা ছয় হাজার অডিট আপত্তি মামলার একটিরও সুরাহা হয়নি। গত বছর স্বাস্থ্য খাতে চারটি বড় বড় দুর্নীতির ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা যায়। যেমন—জাতীয় হূদরোগ হাসপাতালে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক গুণ বেশি দামে চিকিৎসাসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি কেনা, সরকারি পর্যায়ে নামসর্বস্ব ওষুধ কোম্পানির ওষুধ সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মালামাল ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে বিক্রি এবং কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। স্বাস্থ্যনীতি ও বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইনও আলোর মুখ দেখেনি।
তবে ২০১১ সালের স্বাস্থ্য খাতে অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও কিছু ভালো দিক অবশ্যই আছে। সরকার হাজার হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেছে, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। অনেক চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য পেশার ব্যক্তিরা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। নতুন হাসপাতালের নির্মাণকাজ, স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি চালু ইত্যাদি কিছু অর্জন হয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোও একটি বড় সাফল্য। বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল, প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি গড়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষের সচেতনতাও বেড়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে নির্দ্বিধায় বলা যায়। বেদখলে থাকা জমি উদ্ধার, নতুন নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু, বিভাগ সম্প্র্রসারণ, বৈকালিক বিশেষজ্ঞ সেবা চালু, দক্ষ নার্স তৈরির জন্য বিএসসি নার্সিং কোর্স চালু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অটিস্টিক শিশুদের জন্য চালু করা হয়েছে একটি সেবাকেন্দ্র, যা থেকে অনেক প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক শিশু ও তাদের পরিবার মানসম্মত সেবা পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ব্যক্তিগত উদ্যোগে অটিস্টিক শিশুদের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং তা দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে। এ ছাড়াও পেলিয়েটিভ কেয়ার, ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং সারভাইক্যাল সেন্টার চালু করা হয়েছে। যেখানে বিদেশ থেকে যেমন, ভারত ও কোরিয়ার চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেছেন।
২০১২ সালে চিকিৎসকদের প্রধান কাজ হবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং রোগী ও চিকিৎসকের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ তৈরি করা। চিকিৎসকদের মনে রাখা উচিত, আমাদের কাজ শুধু রোগের চিকিৎসা নয়; বরং রোগ, রোগী ও তার আত্মীয়স্বজন—সবাইকে নিয়েই চিকিৎসার মূল উপাদান। তাদের সন্তুষ্টিও চিকিৎসার একটি উপজীব্য। এমনও কথা শোনা যায়, চিকিৎসকেরা বিভিন্ন ল্যাবরেটরি বা ক্লিনিক থেকে পার্সেন্টেজ নেন, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি বা তাদের প্রতিনিধির কাছ থেকেও উপঢৌকনের বিনিময়ে তাদের ওষুধ লিখে থাকেন। বলা বাহুল্য, এই অভিযোগগুলো অসত্য নয়, যদিও সব চিকিৎসকের বেলায় তা সত্য নয়। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে চিকিৎসকদের চিন্তাচেতনায়, আচার-আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। চিকিৎসার প্রতিটি পর্যায়ে রোগীর সঙ্গে কথা বলা, রোগীকে সম্পৃক্ত করা, রোগীর প্রয়োজন ও ইচ্ছাকে মূল্য দিতে হবে। আমাদের প্রতিটি কাজের রেকর্ড রাখার অভ্যাস করা দরকার।
কোনো দায়িত্বহীন আচরণ, স্বেচ্ছাচারিতা, কোনো দল বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রতি বিবেকহীন অন্ধ আনুগত্য বা লেজুড়বৃত্তি চিকিৎসকদের কাম্য হতে পারে না। এগুলো অতিক্রম না করতে পারলে রোগী আর চিকিৎসকের মধ্যে দূরত্ব বাড়তেই থাকবে, আস্থার অভাব আরও প্রকট হবে। চিকিৎসকদের মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা পেশায় আস্থার সংকট দেখা দিলে তা শুধু তার নিজের জন্যই নয়, বরং পুরো জাতির জন্য এক ভয়াবহ অশনিসংকেত। শুধু চিকিৎসক নয়, কর্তৃপক্ষের আচরণও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।
রোগীদেরও উচিত, নিজের চিকিৎসকের প্রতি আস্থা রাখা এবং তা নিজের স্বার্থেই। চিকিৎসার পরিবেশ যদি চিকিৎসকের প্রতিকূলে হয়, তাহলে তাতে রোগীর কোনো লাভ হবে না, তা বলাই বাহুল্য। রোগী বা তাঁর আত্মীয়স্বজনের মনে রাখা উচিত, শুধু আবেগতাড়িত হয়ে হাসপাতালে ভাঙচুর, চিকিৎসক, নার্স ও অন্যদের ওপর হামলা করা দায়িত্বশীল আচরণের মধ্যে পড়ে না।
কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া ও অযথা হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এখনই। দেশের সব এলাকায় আধুনিক চিকিৎসা এখনো অপ্রতুল। শহরকেন্দ্রিক বড় বড় হাসপাতাল থাকলেও অনেক জেলায় সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। সরকারি বা বেসরকারি যেভাবেই হোক, আধুনিক সব সুবিধা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদসহ জেলা, উপজেলা পর্যায়ে আরও কিছু হাসপাতাল গড়ে তোলা উচিত। চিকিৎসা খাতের ব্যয়ও কমানো উচিত। কারণ, আধুনিক চিকিৎসা, যেমন—হূদেরাগের বাইপাস, স্ট্যান্ট লাগানো ইত্যাদি এবং ল্যাবরেটরির পরীক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ ছাড়া এ দেশে নানা রকম কুচিকিৎসা, অপচিকিৎসা, তাবিজ-কবজ, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদিতে ভরপুর, যা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও ক্ষতিকর। এর বিরুদ্ধেও যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা থাকা উচিত।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে বলা হয়, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আমাদের মতো দরিদ্র ও জনবহুল দেশে তা আরও সত্য। তাই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সবাইকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আলাদা বিভাগ থাকবে রোগ প্রতিরোধের জন্য। এখান থেকে প্রত্যেকটি শিশুর টিকা নেওয়া নিশ্চিত করা হবে, মা ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করা হবে, এলাকার প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষ সেবা দেওয়া হবে। এখান থেকেই নিয়মিত জনগণকে স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে, স্কুল-কলেজে প্রচারণার ব্যবস্থা করা হবে। প্রত্যেক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য সহকারীর জন্য এসব কর্মসূচিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক হবে। সেই সঙ্গে এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষও এতে ভূমিকা রাখবে।
শত অভিযোগ, সহস্র ভাঙচুর আর নানামুখী প্রচারণা নিয়ে ২০১১ বিগত। এখন সব দুঃখ, বেদনা, ক্রোধ, অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কর্মপদ্ধতি ও চিন্তাচেতনার পরিবর্তন করে ২০১১ সালের ব্যর্থতার আলোকে ২০১২ সালে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব। ২০১১ থেকে দুঃখ নয়, বরং নতুন সৃষ্টির প্রেরণাই আমরা নিয়ে যাব ২০১২ সালে। ২০১১ আর ২০১২ হোক আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার যুগসন্ধির বছর।
লেখক: ডিন, ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.