টিপাইমুখ নিয়ে বছরজুড়ে উত্তাল সিলেটের রাজপথ
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে: সিলেটে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু। বছরের শুরুতে এ নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলে শেষ মুহূর্তে এসে এই ইস্যুতে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে সিলেট। আর এই আন্দোলনে সিলেটের সবাই এক। সব পেশা ও সব ধর্মের মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে রূপ নিয়েছে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু। বছরের শেষ দিনও এ নিয়ে কর্মসূচি পালন করেছেন সিলেটের বহুল আলোচিত প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান। সিলেটে শেষ দিনে হয়েছে সেমিনারসহ নানা আয়োজন। তবে সিলেটের আপামর জনতার শেষ দাবি হচ্ছে, টিপাইমুখ বাঁধ হবে না নির্ভরযোগ্য ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলে থেমে যাবে সিলেটের মানুষের আন্দোলন। বছরের শুরুতে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সিলেটে তীব্র আলোচনা দেখা দেয়। ওই সময় খবর আসে ভারত মণিপুর এলাকার টিপাইমুখে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাঁধ নির্মাণ করছে। আর এনিয়ে টেনশন শুরু হয় সিলেটের সবখানে। আন্দোলনে নামে সিলেটের অর্ধশতাধিক সামাজিক সংগঠন। মাঝামাঝি সময়ে এসে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে নগর সহ গোটা সিলেট। এই অবস্থার মধ্য দিয়ে সিলেটের সীমান্ত এলাকা নিয়ে শুরু হয় উত্তেজনা। সিলেটের সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট এলাকার বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকা বিএসএফ দখলে নিতে শুরু করেছে। এ নিয়ে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয় সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার ডিবির হাওরে। তামাবিল, পাদুয়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রায় ৬ মাস উত্তেজনা থাকে। পরে সীমান্ত এলাকায় জরিপ নিয়ে হট্টগোল বেঁধে যায়। আর এতে জরিপ কাজ নিয়ে তুমুল বিতর্ক বাধে। এই বিতর্কের মধ্যে গেল আগস্টে সার্বিক ফলাফল না জানিয়েই শেষ করা হয় জরিপ কাজ। যদিও এখনও জরিপ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে সীমান্ত এলাকায়। এই অবস্থায় টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুটি আরও জোরালো হয় সিলেটবাসীর মধ্যে। এরই মধ্যে খবর আসে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মাইন্ডু এলাকায় সারি নদীর ওপারে বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। এ নিয়েও সীমান্ত এলাকায় চলছে আন্দোলন। সর্বশেষ ভারতের মনমোহন সিংহ বাংলাদেশ সফরকালে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোন কাজ করবে না ভারত। তার কথায় সিলেটবাসী কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন। এর আগেও অবশ্য টিপাইমুখ বাঁধের সর্বশেষ অবস্থা পরিদর্শন করেছেন সংসদের একটি প্রতিনিধিদল। ওই প্রতিনিধিদলের প্রধান ছিলেন প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাক। ওদিকে, মনমোহন সিংহ বাংলাদেশ সফরের পর ভারতের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী বাংলাদেশে এসে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে একই কথা বলেন। এ কারণে সিলেটের আন্দোলনরত মানুষ কিছুটা শান্ত হয়। কিন্তু সেই শান্তভাব বেশি দিন টিকেনি। এরই মধ্যে খবর আসে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের জন্য ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নির্মাণ সংক্রান্ত চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র সিলেটজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বর্তমান সরকারের বৈদেশিক কার্যক্রম নিয়ে সিলেটের জনগণের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেয়। সিলেটে শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। সিলেটের রাজনৈতিক দলের চেয়ে সামাজিক সংগঠনের নেতারা আন্দোলনে নামেন বেশি। গত ১লা ডিসেম্বর এ নিয়ে সিলেটে বিএনপি’র ডাকে হরতাল পালিত হয়। আর এই হরতালে সমর্থন জানিয়েছে সিলেটের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। নজিরবিহীন হরতালের মাধ্যমে সিলেটবাসী জানিয়ে দেয় এ এলাকার মানুষ টিপাইমুখ বাঁধ চায় না। হরতালের পাশাপাশি টিপাইমুখ বাঁধ আন্দোলন জোরদার করতে অন্তত ২০টি সংগঠন এ নিয়ে টানা আন্দোলন শুরু করেছে। এর মধ্যে টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলন সিলেট কেন্দ্রীয় কমিটি চার জেলায় আলাদা কমিটি গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন চালাচ্ছে। তারা কয়েক বছর যাবৎ আন্দোলনে রয়েছেন। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ যতদিন পর্যন্ত বন্ধের ঘোষণা না আসবে ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক লোকমান আহমদ। এর বাইরে ডান, বাম ও মধ্যমপন্থি নেতারা আলাদাভাবে কমিটি গঠন করে আন্দোলন চালাচ্ছেন। এ ইস্যুতে সিলেটে লং মার্চ করে গেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আলহাজ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি ১০ই ডিসেম্বর ঢাকা থেকে সিলেট এবং পরবর্তীতে ১১ই ডিসেম্বর সিলেট থেকে জকিগঞ্জ অভিমুখে লং মার্চ করেন। লং মার্চ শেষে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, জীবন থাকতে টিপাইমুখ বাঁধ হতে দেবেন না। এরশাদের আগে সিলেটে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম টিপাইমুখ অভিমুখে লং মার্চ করেছে। আর গতকাল পদযাত্রা শেষ করেছে প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস। বছরের শেষ মুহূর্তে এসে সিলেটবাসী জানিয়েছেন, নতুন বছরেও সিলেটে এ আন্দোলন থাকবে। যদি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হয় তবে সিলেটে দুর্বার আন্দোলন শুরু করা হবে মনে করা হচ্ছে। আর এই আন্দোলনে এসে যুক্ত হবে সাধারণ মানুষ।
No comments