পররাষ্ট্রনীতি-অনেক সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি by এম হুমায়ুন কবির
২০১১ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্ক কেমন ছিল, এমন প্রশ্নের জবাব এককথায় দেওয়া কঠিন। তবে কূটনীতির কয়েকটি প্রবণতা বিশ্লেষণ করে কূটনীতিতে আমাদের অর্জনকে মিশ্র বলা যেতে পারে। দু-তিনটি বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা যেতে পারে। প্রক্রিয়াগতভাবে ২০১০ সালের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই ২০১১ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে কর্মচাঞ্চল্য বজায় থেকেছে। উপাদান হিসেবে এ ক্ষেত্রে উঁচু মাত্রার সফর বিনিময় প্রতিবেশী দেশগুলোর
সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের অব্যাহত প্রয়াস, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা সুযোগ সৃষ্টির বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বপরিমণ্ডলে এ বছর সামাজিক ও নৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ বাংলাদেশের কূটনীতির জন্য এক অনুকূল বাতাবরণ তৈরি করে। বাংলাদেশ সে সুযোগ কাজে লাগাতে সচেষ্টও থেকেছে। তবে ফলাফলের দিক থেকে বিচার করলে বিষয়টি জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়। অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে, বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে, অভ্যন্তরীণ নীতি-প্রক্রিয়ায় অতিকেন্দ্রিকতা এবং কখনো কখনো বহিঃসম্পর্কের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নীতির প্রভাব সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে। এতে করে অনেক সম্ভাবনাকে যেমন কাজে লাগানো যায়নি, তেমনি অনেক পরীক্ষিত বন্ধুদেশের সঙ্গেও সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে।
২০১১ সালে প্রাপ্তি
২০১১ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সংহতকরণের উদ্যোগ নেওয়া। উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময় এ প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ১২ বছর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফরে বাংলাদেশে আসা নানা কারণেই গুরুত্ব বহন করে। বস্তুত, ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে গতি সঞ্চারের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, এরই ধারাবাহিকতায় ড. মনমোহন সিংয়ের এ সফর অনুষ্ঠিত হয়। নানা কারণে ‘ঐতিহাসিক’ সফরটি একটি সাধারণ সফরে রূপান্তরিত হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছু কিছু অগ্রগতি লক্ষণীয়। যেমন—দুই দেশের স্থলসীমানা নির্ধারণসহ সীমান্তসংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলো সমাধানের লক্ষ্যে একটি প্রটোকল স্বাক্ষর। অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষর, আটটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং ভারত কর্তৃক ৬১টি বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্তভাবে ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার দানের ঘোষণা বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিলতার কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং ট্রানজিট-সংক্রান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়নি। যা লক্ষণীয় তা হলো, গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলোয় অগ্রগতির অভাব পুরো সফরের ওপরই এক নেতিবাচক ছায়া ফেলে। এ কারণে দুই দেশের সরকারকেই বিরূপ জনমতের সম্মুখীন হতে হয়।
এ ধকল না কাটতেই অর্থনৈতিক সহযোগিতা কাঠামোয় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার কথা উল্লেখ থাকলেও তা অগ্রাহ্য করেই টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের জন্য ভারতের মণিপুর রাজ্য কর্তৃক ভারতীয় কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশে প্রতিবাদের তীব্র ঝড় ওঠে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে যথোপযুক্ত ট্রানজিট নীতিমালার অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে অস্বচ্ছভাবে ভারত কর্তৃক আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কপথে ভারতীয় পণ্য পরিবহন এবং এক বিলিয়ন ডলার ঋণের বিনিময়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। এ প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের শেষের দিকে এসে অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘স্থবির’ বলতেও দ্বিধা করেননি। ভারতের রাজনীতিতে যে বিবর্তন চলছে, তাতে করে এ সম্পর্কে কতটুকু প্রাণ সঞ্চার করা সম্ভব, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ককে দ্রুতগতিতে সামনে এগিয়ে না নেওয়া গেলে তা দুই দেশের স্বার্থকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের দিক থেকে আরও উদ্যোগ এবং বাংলাদেশের দিক থেকে চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অন্য প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ইতিবাচক বিবর্তন লক্ষণীয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি থেন সেইনের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সে দেশ সফরের সময় দুই দেশের নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ, বিশ্বাস স্থাপনসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়, যেমন—বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সহযোগিতা ও মাদক পাচার রোধ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দুটি বিষয় এ সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে। প্রথমত, আট বছর পর বাংলাদেশ থেকে সরকারপ্রধান পর্যায়ে এ সফর অনুষ্ঠিত হলো। এতে করে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের বর্তমান সরকারও আগের বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখার নীতি থেকে বেরিয়ে এসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়েছে। বাংলাদেশ যথোপযুক্ত কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে এ কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। বছরের প্রথম দিকে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার ওয়াংচুক ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লিগুনচেন জিগমে থিনলের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি, ভুটান কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সফরও দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সমষ্টিগতভাবে এ বছর প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের একটি সুচিন্তিত প্রয়াস লক্ষণীয় ছিল। এর পেছনে সন্ত্রাস দমন, বাণিজ্য ও জ্বালানি সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়গুলোই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিষয়বস্তুর দিক থেকে বাংলাদেশ একটি বাড়তি সুবিধা লাভ করেছে। এ বছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোয় প্রধানত নৈতিক, মানবিক ও সামাজিক বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, গণতন্ত্র সংহতকরণ ও সুশাসনের কাজে লাগানো, মানব পাচার রোধ, নারীর ক্ষমতায়ন, সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে এবং এর অনেক বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি, বাংলাদেশের কূটনীতিকে সজীব রাখতে সাহায্য করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের বাংলাদেশ সফর, জার্মানির প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান উল্ফের বাংলাদেশ সফর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ এবং সে সময়ে বিভিন্ন পার্শ্বসভায় অংশগ্রহণের বিষয়বস্তু হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল এ বিষয়গুলো। মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন এবং অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনেও এসব বিষয় প্রধান উপজীব্য হিসেবে উঠে আসে। বস্তুত এসব বিষয়ের প্রতি বিশ্বনেতাদের আগ্রহ একদিকে যেমন বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের সাফল্যকে সামনে তুলে আনতে সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে আমাদের মনে করে দিয়েছে যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক আমলাতান্ত্রিক বাংলাদেশের বাইরে বৃহত্তর সৃজনশীল ও সামাজিকভাবে ক্রিয়াশীল বাংলাদেশের গুরুত্ব, যার প্রতি রয়েছে পৃথিবীর মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ। এর পাশাপাশি খানিকটা শীতলতার ছোঁয়াও লেগেছে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কে। দৃশ্যতই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার একটি নেতিবাচক ছায়া পরিলক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী সহযোগিতা অব্যাহত থাকলেও রাজনৈতিক পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খানিকটা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গড়িয়েছে। অক্টোবর মাসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের আলোচনার মধ্য দিয়ে তেমন ইঙ্গিত মিলেছে। হিলারি ক্লিনটন স্পষ্টতই বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের গুরুত্ব এবং এর সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিবাচক ভূমিকা, গণতন্ত্র সংহতকরণে সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার ভূমিকার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে একটি বার্তা প্রেরণের জন্য সচেষ্ট থেকেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখা চিঠিতেও তিনি এ অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার সফর করলেও বাংলাদেশে তিনি আসতে পারেননি। কূটনীতির ভাষায় এর অর্থটি অবোধগম্য নয়। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হলেও স্বার্থগত দিক থেকে বাংলাদেশ মার্কিন কংগ্রেসে যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। ২০০৭ ও ২০০৯ সালে বাংলাদেশসহ অন্য এশীয় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে দুটি বিল উত্থাপিত হলেও ২০১১ সালে এসে এ-সংক্রান্ত কোনো বিলই প্রতিনিধি সভায় উত্থাপন করা যায়নি। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন ইউএসটিআরে বাংলাদেশের শ্রম সম্পর্ক নিয়ে শুনানির সময় নির্ধারিত হয়েছে। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসের পর অনুষ্ঠিত এ শুনানি বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে বলে অনেকেই মনে করেন। কিছু কিছু সংবেদনশীল বিষয়ে কানাডা সরকারের অবস্থান বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান।
জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের মধ্য দিয়ে বছর শুরু হলেও সামগ্রিক অর্থে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের শ্লথগতি লক্ষ করার মতো। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি প্রেরণ থেকে আমাদের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হলেও এ অঞ্চলের দেশগুলোয় আমাদের কূটনৈতিক অবস্থান নড়বড়ে। জনশক্তি রপ্তানি থেকে যথাযথ পরিমাণ আয় নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কূটনীতি বহুগুণ শক্তিশালী করা প্রয়োজন। শুধু জনশক্তি নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিনিয়োগের উৎস হিসেবেও বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণেও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব বাড়ছে।
২০১২ সালের প্রত্যাশা
অনুমান করা কঠিন নয় যে ২০১২ সালের বিশ্ব অনেক বেশি সমস্যাসংকুল হবে। উন্নত বিশ্বের মন্দা, মধ্যপ্রাচ্যের দ্রুত বিবর্তন ও ভারত, চীনসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি ভারতের পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন, মিয়ানমারে গণতন্ত্রের নেত্রী অং সান সু চির রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জের অবতারণা করতে পারে। সে প্রেক্ষাপটে আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্ককেও অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে তৈরি থাকতে হবে, যাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশাগুলো কী হতে পারে, এর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা উপস্থাপিত হলো:
ক. ২০১১ সালের মতো ২০১২ সালেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব অব্যাহত থাকবে। সে পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রত্যাশার মধ্যে থাকবে ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন করা; বিশেষ করে স্থলসীমান্ত চিহ্নিতকরণসহ সীমান্ত ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো, যাতে করে সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ করা যায়। তিস্তা নদের পানিবণ্টনসহ অন্য যৌথ নদীগুলোর পানিবণ্টন ও ব্যবহারের বিষয়ে অগ্রগতি দুই দেশের সম্পর্ককে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যেতে পারে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার কাঠামোগত চুক্তির আওতায় টিপাইমুখ বিষয় নিয়ে আলোচনা ও যৌথ সমীক্ষার মাধ্যমে দুই দেশের স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে বলে আমরা আশা করি। বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্তভাবে ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকারের সদ্ব্যবহারের লক্ষ্যে অশুল্ক বাধা দূরীভূত হবে, এমন আশাও রইল। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদেরও তাঁদের সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে আরও যত্নশীল হতে হবে। অনেকে মনে করেন, বাণিজ্য সম্প্রসারণের এ সুযোগ দুই দেশের সম্পর্ককে এক নতুন স্তরে উন্নীত করতে পারে। সেই সঙ্গে ভারত কর্তৃক এক বিলিয়ন ডলার ঋণের আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকীকরণ জরুরি। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে জ্বালানি সহযোগিতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
খ. মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবর্তন মাথায় রেখে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ২০১২ সালে সমুদ্রসীমা নির্ধারণসংক্রান্ত বিষয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে তা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এক নতুন বাতাবরণ তৈরি করতে পারে। সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারে তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে এবং সংগত কারণেই এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতামূলক মনোভাব যথেষ্ট মূল্যবান ভূমিকা পালন করবে।
গ. চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী। চীন আমাদের অন্যতম বড় আমদানি উৎস এবং নিকট প্রতিবেশী। ভবিষ্যতে বিনিয়োগেরও উৎস হবে এ দেশ। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে যৌথ নদীসম্পদ বণ্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও চীন বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তা ছাড়া জলবায়ুসংক্রান্ত যেকোনো উদ্যোগে চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই বিশেষ কারণেই চীনের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা জরুরি।
ঘ. একইভাবে বাংলাদেশে আইনের শাসন জোরদার করা, গণতন্ত্র সংহতকরণ, ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক যোগাযোগের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। চলমান অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারলে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও জোরদার কূটনীতি পরিচালনা করার প্রয়োজন হবে।
ঙ. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কূটনীতি ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। গণতন্ত্রে উত্তরণ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলাসহ অন্যান্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সহযোগী। বিদেশে জনশক্তির কাছ থেকে আয়ের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য স্থানে রয়েছে এ দেশ। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের একক বড় রপ্তানির বাজার। এসব দিক বিবেচনায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাইরে যে বিশাল সুশীল সমাজ ওই দেশের নীতি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের মনোভাব ও পছন্দকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করাও প্রয়োজন। আশা করা যায়, ২০১২ সালে এ সম্পর্কে গতি আসবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসবেন এবং সম্ভবত আমাদের প্রধানমন্ত্রীও যুক্তরাষ্ট্র সফর করতে পারবেন।
চ. মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আমাদের কূটনীতি অনেক গুণে জোরদার করা প্রয়োজন। এ কাজে প্রয়োজন পেশাদারি মনোভাব এবং দক্ষতা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। আশা করব, ২০১২ সালে বাংলাদেশ তার মনোফোকাস দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে পারবে।
ছ. পররাষ্ট্র কাঠামোর অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক চলেছে ২০১১ সালজুড়ে। প্রশ্ন উঠেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে। সমন্বয়হীনতার প্রসঙ্গও বারবার উঠে এসেছে আলোচনায়। বলা বাহুল্য, সফল কূটনীতির প্রধান বিষয় হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়। শোনা যাচ্ছে, অনেক প্রতিশ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের অভ্যন্তরীণ জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ দিক বিশেষভাবে প্রকাশমান হয়েছে। আশা করি, ২০১২ সালে আমরা আবার পেশাদারির গুরুত্ব উপলব্ধি করব এবং অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগী হব।
যা করা যেতে পারে
২০১১ সালে পররাষ্ট্র বিষয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তি যেমন ছিল, তেমনি ছিল প্রত্যাশার অপূর্ণতা। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশার অপূর্ণতা রেখে গেছে কিছু শিক্ষা। যেমন কূটনীতিতে অহেতুক প্রত্যাশা বৃদ্ধি আখেরে হতাশার জন্ম দিতে পারে; আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভাবাবেগ খানিকটা উপযোগী উপাদান হলেও শেষে স্বার্থ-সচেতনতা ও কৌশলই কূটনীতির প্রধান অবলম্বন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয়ের তফাত ধীরে ধীরে অপসারিত হয়ে যাচ্ছে এবং সে কারণেই অভ্যন্তরীণ নীতি ও কার্যক্রম পররাষ্ট্র সম্পর্ককে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুভাবেই প্রভাবিত করতে পারে। আরও একটি বিষয়, যা সামনে উঠে এসেছে তা হলো, পেশাদারির কোনো বিকল্প নেই। একইভাবে পররাষ্ট্র সম্পর্ক যত বিস্তৃত হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের গুরুত্ব ততই বাড়ছে। যত তাড়াতাড়ি এ উপলব্ধিকে কাজে রূপান্তর করা যাবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্ক তত শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াবে। ২০১২ সালে এ ব্যাপারে উদ্যোগ দেখলে খুশি হব।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও রাষ্ট্রদূত।
২০১১ সালে প্রাপ্তি
২০১১ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সংহতকরণের উদ্যোগ নেওয়া। উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময় এ প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ১২ বছর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফরে বাংলাদেশে আসা নানা কারণেই গুরুত্ব বহন করে। বস্তুত, ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে গতি সঞ্চারের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, এরই ধারাবাহিকতায় ড. মনমোহন সিংয়ের এ সফর অনুষ্ঠিত হয়। নানা কারণে ‘ঐতিহাসিক’ সফরটি একটি সাধারণ সফরে রূপান্তরিত হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছু কিছু অগ্রগতি লক্ষণীয়। যেমন—দুই দেশের স্থলসীমানা নির্ধারণসহ সীমান্তসংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলো সমাধানের লক্ষ্যে একটি প্রটোকল স্বাক্ষর। অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষর, আটটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং ভারত কর্তৃক ৬১টি বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্তভাবে ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার দানের ঘোষণা বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিলতার কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং ট্রানজিট-সংক্রান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়নি। যা লক্ষণীয় তা হলো, গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলোয় অগ্রগতির অভাব পুরো সফরের ওপরই এক নেতিবাচক ছায়া ফেলে। এ কারণে দুই দেশের সরকারকেই বিরূপ জনমতের সম্মুখীন হতে হয়।
এ ধকল না কাটতেই অর্থনৈতিক সহযোগিতা কাঠামোয় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার কথা উল্লেখ থাকলেও তা অগ্রাহ্য করেই টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের জন্য ভারতের মণিপুর রাজ্য কর্তৃক ভারতীয় কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশে প্রতিবাদের তীব্র ঝড় ওঠে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে যথোপযুক্ত ট্রানজিট নীতিমালার অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে অস্বচ্ছভাবে ভারত কর্তৃক আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কপথে ভারতীয় পণ্য পরিবহন এবং এক বিলিয়ন ডলার ঋণের বিনিময়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। এ প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের শেষের দিকে এসে অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘স্থবির’ বলতেও দ্বিধা করেননি। ভারতের রাজনীতিতে যে বিবর্তন চলছে, তাতে করে এ সম্পর্কে কতটুকু প্রাণ সঞ্চার করা সম্ভব, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ককে দ্রুতগতিতে সামনে এগিয়ে না নেওয়া গেলে তা দুই দেশের স্বার্থকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের দিক থেকে আরও উদ্যোগ এবং বাংলাদেশের দিক থেকে চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অন্য প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ইতিবাচক বিবর্তন লক্ষণীয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি থেন সেইনের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সে দেশ সফরের সময় দুই দেশের নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ, বিশ্বাস স্থাপনসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়, যেমন—বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সহযোগিতা ও মাদক পাচার রোধ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দুটি বিষয় এ সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে। প্রথমত, আট বছর পর বাংলাদেশ থেকে সরকারপ্রধান পর্যায়ে এ সফর অনুষ্ঠিত হলো। এতে করে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের বর্তমান সরকারও আগের বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখার নীতি থেকে বেরিয়ে এসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়েছে। বাংলাদেশ যথোপযুক্ত কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে এ কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। বছরের প্রথম দিকে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার ওয়াংচুক ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লিগুনচেন জিগমে থিনলের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি, ভুটান কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সফরও দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সমষ্টিগতভাবে এ বছর প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের একটি সুচিন্তিত প্রয়াস লক্ষণীয় ছিল। এর পেছনে সন্ত্রাস দমন, বাণিজ্য ও জ্বালানি সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়গুলোই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিষয়বস্তুর দিক থেকে বাংলাদেশ একটি বাড়তি সুবিধা লাভ করেছে। এ বছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোয় প্রধানত নৈতিক, মানবিক ও সামাজিক বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, গণতন্ত্র সংহতকরণ ও সুশাসনের কাজে লাগানো, মানব পাচার রোধ, নারীর ক্ষমতায়ন, সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে এবং এর অনেক বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি, বাংলাদেশের কূটনীতিকে সজীব রাখতে সাহায্য করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের বাংলাদেশ সফর, জার্মানির প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান উল্ফের বাংলাদেশ সফর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ এবং সে সময়ে বিভিন্ন পার্শ্বসভায় অংশগ্রহণের বিষয়বস্তু হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল এ বিষয়গুলো। মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন এবং অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনেও এসব বিষয় প্রধান উপজীব্য হিসেবে উঠে আসে। বস্তুত এসব বিষয়ের প্রতি বিশ্বনেতাদের আগ্রহ একদিকে যেমন বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের সাফল্যকে সামনে তুলে আনতে সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে আমাদের মনে করে দিয়েছে যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক আমলাতান্ত্রিক বাংলাদেশের বাইরে বৃহত্তর সৃজনশীল ও সামাজিকভাবে ক্রিয়াশীল বাংলাদেশের গুরুত্ব, যার প্রতি রয়েছে পৃথিবীর মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ। এর পাশাপাশি খানিকটা শীতলতার ছোঁয়াও লেগেছে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কে। দৃশ্যতই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার একটি নেতিবাচক ছায়া পরিলক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী সহযোগিতা অব্যাহত থাকলেও রাজনৈতিক পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খানিকটা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গড়িয়েছে। অক্টোবর মাসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের আলোচনার মধ্য দিয়ে তেমন ইঙ্গিত মিলেছে। হিলারি ক্লিনটন স্পষ্টতই বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের গুরুত্ব এবং এর সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিবাচক ভূমিকা, গণতন্ত্র সংহতকরণে সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার ভূমিকার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে একটি বার্তা প্রেরণের জন্য সচেষ্ট থেকেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখা চিঠিতেও তিনি এ অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার সফর করলেও বাংলাদেশে তিনি আসতে পারেননি। কূটনীতির ভাষায় এর অর্থটি অবোধগম্য নয়। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হলেও স্বার্থগত দিক থেকে বাংলাদেশ মার্কিন কংগ্রেসে যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। ২০০৭ ও ২০০৯ সালে বাংলাদেশসহ অন্য এশীয় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে দুটি বিল উত্থাপিত হলেও ২০১১ সালে এসে এ-সংক্রান্ত কোনো বিলই প্রতিনিধি সভায় উত্থাপন করা যায়নি। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন ইউএসটিআরে বাংলাদেশের শ্রম সম্পর্ক নিয়ে শুনানির সময় নির্ধারিত হয়েছে। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসের পর অনুষ্ঠিত এ শুনানি বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে বলে অনেকেই মনে করেন। কিছু কিছু সংবেদনশীল বিষয়ে কানাডা সরকারের অবস্থান বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান।
জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের মধ্য দিয়ে বছর শুরু হলেও সামগ্রিক অর্থে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের শ্লথগতি লক্ষ করার মতো। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি প্রেরণ থেকে আমাদের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হলেও এ অঞ্চলের দেশগুলোয় আমাদের কূটনৈতিক অবস্থান নড়বড়ে। জনশক্তি রপ্তানি থেকে যথাযথ পরিমাণ আয় নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কূটনীতি বহুগুণ শক্তিশালী করা প্রয়োজন। শুধু জনশক্তি নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিনিয়োগের উৎস হিসেবেও বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণেও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব বাড়ছে।
২০১২ সালের প্রত্যাশা
অনুমান করা কঠিন নয় যে ২০১২ সালের বিশ্ব অনেক বেশি সমস্যাসংকুল হবে। উন্নত বিশ্বের মন্দা, মধ্যপ্রাচ্যের দ্রুত বিবর্তন ও ভারত, চীনসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি ভারতের পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন, মিয়ানমারে গণতন্ত্রের নেত্রী অং সান সু চির রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জের অবতারণা করতে পারে। সে প্রেক্ষাপটে আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্ককেও অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে তৈরি থাকতে হবে, যাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশাগুলো কী হতে পারে, এর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা উপস্থাপিত হলো:
ক. ২০১১ সালের মতো ২০১২ সালেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব অব্যাহত থাকবে। সে পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রত্যাশার মধ্যে থাকবে ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন করা; বিশেষ করে স্থলসীমান্ত চিহ্নিতকরণসহ সীমান্ত ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো, যাতে করে সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ করা যায়। তিস্তা নদের পানিবণ্টনসহ অন্য যৌথ নদীগুলোর পানিবণ্টন ও ব্যবহারের বিষয়ে অগ্রগতি দুই দেশের সম্পর্ককে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যেতে পারে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার কাঠামোগত চুক্তির আওতায় টিপাইমুখ বিষয় নিয়ে আলোচনা ও যৌথ সমীক্ষার মাধ্যমে দুই দেশের স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে বলে আমরা আশা করি। বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্তভাবে ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকারের সদ্ব্যবহারের লক্ষ্যে অশুল্ক বাধা দূরীভূত হবে, এমন আশাও রইল। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদেরও তাঁদের সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে আরও যত্নশীল হতে হবে। অনেকে মনে করেন, বাণিজ্য সম্প্রসারণের এ সুযোগ দুই দেশের সম্পর্ককে এক নতুন স্তরে উন্নীত করতে পারে। সেই সঙ্গে ভারত কর্তৃক এক বিলিয়ন ডলার ঋণের আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকীকরণ জরুরি। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে জ্বালানি সহযোগিতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
খ. মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবর্তন মাথায় রেখে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ২০১২ সালে সমুদ্রসীমা নির্ধারণসংক্রান্ত বিষয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে তা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এক নতুন বাতাবরণ তৈরি করতে পারে। সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারে তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে এবং সংগত কারণেই এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতামূলক মনোভাব যথেষ্ট মূল্যবান ভূমিকা পালন করবে।
গ. চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী। চীন আমাদের অন্যতম বড় আমদানি উৎস এবং নিকট প্রতিবেশী। ভবিষ্যতে বিনিয়োগেরও উৎস হবে এ দেশ। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে যৌথ নদীসম্পদ বণ্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও চীন বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তা ছাড়া জলবায়ুসংক্রান্ত যেকোনো উদ্যোগে চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই বিশেষ কারণেই চীনের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা জরুরি।
ঘ. একইভাবে বাংলাদেশে আইনের শাসন জোরদার করা, গণতন্ত্র সংহতকরণ, ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক যোগাযোগের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। চলমান অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারলে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও জোরদার কূটনীতি পরিচালনা করার প্রয়োজন হবে।
ঙ. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কূটনীতি ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। গণতন্ত্রে উত্তরণ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলাসহ অন্যান্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সহযোগী। বিদেশে জনশক্তির কাছ থেকে আয়ের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য স্থানে রয়েছে এ দেশ। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের একক বড় রপ্তানির বাজার। এসব দিক বিবেচনায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাইরে যে বিশাল সুশীল সমাজ ওই দেশের নীতি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের মনোভাব ও পছন্দকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করাও প্রয়োজন। আশা করা যায়, ২০১২ সালে এ সম্পর্কে গতি আসবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসবেন এবং সম্ভবত আমাদের প্রধানমন্ত্রীও যুক্তরাষ্ট্র সফর করতে পারবেন।
চ. মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আমাদের কূটনীতি অনেক গুণে জোরদার করা প্রয়োজন। এ কাজে প্রয়োজন পেশাদারি মনোভাব এবং দক্ষতা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। আশা করব, ২০১২ সালে বাংলাদেশ তার মনোফোকাস দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে পারবে।
ছ. পররাষ্ট্র কাঠামোর অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক চলেছে ২০১১ সালজুড়ে। প্রশ্ন উঠেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে। সমন্বয়হীনতার প্রসঙ্গও বারবার উঠে এসেছে আলোচনায়। বলা বাহুল্য, সফল কূটনীতির প্রধান বিষয় হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়। শোনা যাচ্ছে, অনেক প্রতিশ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের অভ্যন্তরীণ জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ দিক বিশেষভাবে প্রকাশমান হয়েছে। আশা করি, ২০১২ সালে আমরা আবার পেশাদারির গুরুত্ব উপলব্ধি করব এবং অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগী হব।
যা করা যেতে পারে
২০১১ সালে পররাষ্ট্র বিষয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তি যেমন ছিল, তেমনি ছিল প্রত্যাশার অপূর্ণতা। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশার অপূর্ণতা রেখে গেছে কিছু শিক্ষা। যেমন কূটনীতিতে অহেতুক প্রত্যাশা বৃদ্ধি আখেরে হতাশার জন্ম দিতে পারে; আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভাবাবেগ খানিকটা উপযোগী উপাদান হলেও শেষে স্বার্থ-সচেতনতা ও কৌশলই কূটনীতির প্রধান অবলম্বন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয়ের তফাত ধীরে ধীরে অপসারিত হয়ে যাচ্ছে এবং সে কারণেই অভ্যন্তরীণ নীতি ও কার্যক্রম পররাষ্ট্র সম্পর্ককে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুভাবেই প্রভাবিত করতে পারে। আরও একটি বিষয়, যা সামনে উঠে এসেছে তা হলো, পেশাদারির কোনো বিকল্প নেই। একইভাবে পররাষ্ট্র সম্পর্ক যত বিস্তৃত হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের গুরুত্ব ততই বাড়ছে। যত তাড়াতাড়ি এ উপলব্ধিকে কাজে রূপান্তর করা যাবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্ক তত শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াবে। ২০১২ সালে এ ব্যাপারে উদ্যোগ দেখলে খুশি হব।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও রাষ্ট্রদূত।
No comments