নতুন আয়নায় দেখার সময় এসেছে-প্রবাসে বাংলাদেশি by আমেনা মহসিন
সৌদি আরবে ৮ বাংলাদেশির প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এ মর্মন্তুদ ঘটনা এমন সময়ে ঘটেছে যখন পবিত্র হজ সামনে রেখে বাংলাদেশ থেকে হজ ফ্লাইট সৌদি আরব যেতে শুরু করেছে। সৌদি সরকার দাবি করছে, তাদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রশ্ন উঠছে যে এ বিচার কতটা ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ইস্যুটি বিশেষভাবে সামনে এনেছে।
সোমবার সমকালে দণ্ড কার্যকর হওয়া একজনের স্বজনের আহাজারির যে ছবি ছাপা হয়েছে, তা যে কাউকে অশ্রুসিক্ত করে তুলবে। অন্য পরিবারগুলোতেও যে একই যন্ত্র্রণা ও কষ্টের অনুভূতি, তা সহজেই অনুভব করা যায়। সংবাদপত্রে দেখেছি, আরও অন্তত ৫ বাংলাদেশি নাগরিক ওই দেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছে। এসব পরিবারে উদ্বেগ-শঙ্কা এখন অনেক বেড়ে যাবে।
সৌদি আরব কী ধরনের রাষ্ট্র, সেটা আমাদের জানা আছে। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় আপত্তি প্রকাশ করা গুটিকয়েক রাষ্ট্রের একটি ছিল বাদশাহশাসিত এ দেশ। তারা মানবাধিকার ঘোষণা এখনও স্বীকার করে না। তবে তাদের যুক্তি হচ্ছে, ধর্মীয় আইন ও ঐতিহ্য অনুসরণ করেই কঠোর শাস্তির বিধান সেখানে বলবৎ রয়েছে। এর উদ্দেশ্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা। অপরাধের জন্য কঠোরতম দণ্ড দেওয়া হলে অন্যরা অপরাধ করতে ভয় পাবে, এটাই মনে করা হয়।
এ যুক্তি ঠিক কি-না অথবা পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান শুরু থেকেই একরূপ ছিল কি-না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। আমরা ইতিহাস থেকে জানি হজরত মুহম্মদ (সাঃ) তাঁর কোনো উত্তরাধিকার রেখে যাননি। ইসলামে রাজতন্ত্রেরও বিধান নেই। কিন্তু সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় উত্তরাধিকার প্রথা স্বীকৃত। সেখানে বিচার ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে তারা বিচার করেছে তাদের প্রচলিত আইন ও বিধান অনুসরণ করে এবং এই প্রথম নয়, বহু বছর ধরেই শরিয়া আইন সে দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তারা গোপনে কিছু করছে, সেটাও বলা যাবে না। তবে যে কোনো দেশ আলাদা বিচার ব্যবস্থা রাখার অধিকার সংরক্ষণ করে, সেটা যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলেও বলতে চাই_ ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে কি?
যেসব বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে তারা বিচারের সময় নিজেদের যথাযথভাবে ডিফেন্ড করতে পেরেছে কি-না, সেটাও বড় প্রশ্ন। যে ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে তাতে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে এবং তা কার্যকর হয়ে থাকে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করে_ এটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই অবগত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি, যাদের বেশিরভাগ অদক্ষ এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আদৌ নেই। তাদের সাধারণ অভিযোগ_ আপদ-বিপদে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা মেলে না। আলোচিত ক্ষেত্রে মিলেছিল কি?
বাংলাদেশের ওই হতভাগ্য ৮ শ্রমিকের বিরুদ্ধে একটি বৈদ্যুতিক ওয়ারহাউসে ডাকাতি এবং একজন মিসরীয় প্রহরীকে খুনের অভিযোগ রয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, এরা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সমকালে ওই ৮ জনের পরিবার ও স্বজনদের যে পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে তাতেও এর স্বীকৃতি মেলে। তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার কি সাধ্যমতো সব কিছু করেছিল? সচ্ছল পরিবারের কেউ অন্য দেশে দণ্ডিত হলে তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য যেমন চেষ্টা করা হয়, গত চার বছরে বাংলাদেশ সরকার তেমনভাবে উদ্যোগী হয়েছিল কি-না? সংবাদপত্রে দেখেছি রাষ্ট্রপতি সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের ক্ষমা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি ডাকাতির সময় নিহত মিসরীয় প্রহরীর পরিবারের কাছে 'ব্লাড-মানির' প্রস্তাবও দেওয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তারপরও প্রশ্ন উঠতেই থাকবে_ আমরা সব কিছু করেছি তো?
বিশ্বের অনেক দেশে এখন মাইগ্র্যান্ট শ্রমিকরা কাজ করছে। যে দেশ থেকে তারা যাচ্ছে এবং যে দেশে যাচ্ছে, উভয়ের জন্য অবশ্য করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক আইনে। নিজ দেশের শ্রমিকদের জন্য যেমন শ্রম আইন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভিনদেশিদের জন্যও। তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই নিশ্চিত করা চাই। বিদেশিরা যে দেশে কাজ করছে সেখানকার আইন লঙ্ঘন করলে কিংবা অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তাদের বিচার কাজ কীভাবে সম্পন্ন করা হবে, সেসবও আন্তর্জাতিক আইনে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রবাসে বাংলাদেশের শ্রমিকরা এসব সুবিধা পাচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকতে হয় সরকারকে। দেখা যায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন-ভাতা দেওয়া হয় না কিংবা অনিয়ম ও হয়রানির ঘটনা ঘটে। কিন্তু শ্রমিকরা তার প্রতিবাদ করতে গেলে স্থানীয় আইন লঙ্ঘনের ঝামেলায় পড়ে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আলোচ্য ক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা যথেষ্ট কঠোর হয়েছে বলেই মনে হয়। মাইগ্র্যান্ট শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী অভিযুক্তদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করার জন্য প্রস্তাব রাখা হয়েছিল কি? হতে পারে এ ধরনের প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা ফল দেয়নি। এ ঘটনাটি সে ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় হয়ে উঠবে, এটাই কাম্য। বাংলাদেশ সরকার অভিযুক্তদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যথেষ্ট লবি করেছিল কি-না, সেটাও প্রশ্ন। কেউ অপরাধ করলে_ সেটা দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই হোক, তাকে বাঁচানোর প্রশ্ন আসে না। কিন্তু যে কোনো স্থানেই বিচার হোক, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকেই বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। প্রবাসে যারা কাজ করছে তাদের শ্রম ও অন্যান্য অধিকার সংরক্ষণে যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অবস্থান গ্রহণ করে সেজন্যও চেষ্টা চালানো দরকার। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকরা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। আমাদের সরকারকে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা মানবাধিকার ইস্যুতে সোচ্চার অন্যান্য দেশ সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশি শ্রমিকদের জীবন রক্ষায় আদৌ কোনো ভূমিকা রাখেনি। এমনকি দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার পরও জোরালো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। এমন ঘটনা সৌদি আরব না হয়ে আফগানিস্তান কিংবা ইরাকে ঘটলে তাদের প্রতিক্রিয়া ভিন্নতর হতো বলেই ধারণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে জার্মানির জন্য অন্য দেশে সামরিক প্রয়োজনে সৈন্য প্রেরণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সে দেশের জনমতও এ প্রশ্নে যথেষ্ট রক্ষণশীল। তারপরও তারা আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করে মানবাধিকার সংরক্ষণের ইস্যুটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু সৌদি আরবের তেল আমদানি এবং সে দেশে বিপুল মারণাস্ত্র বিক্রির স্বার্থে 'মানবাধিকার' ইস্যুতে সোচ্চার সব দেশ বাংলাদেশিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনায় একরূপ নীরব থাকে। এটা স্পষ্টতই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। বিশ্ব সমাজে এ বিষয়টি নিয়ে কি আলোচনা হতে পারে না? সৌদি আরব জাতিসংঘের সদস্য দেশ। এ বিশ্ব সংস্থাও কিন্তু কার্যত প্রতিক্রিয়াহীন।
প্রবাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি কর্মী কাজ করে সৌদি আরবে। মালয়েশিয়াতেও কয়েক লাখ বাংলাদেশি রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেই আমাদের নাগরিকদের বেশি উপস্থিতি। অন্তত ৭৫ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কাজ করছে বলে ধারণা করা হয়। দেশ ভেদে আইন-কানুন ও সুযোগ-সুবিধায় পার্থক্য রয়েছে। যে দেশে যিনি কাজ করেন তাকে অবশ্যই সে দেশের আইন মেনে চলতে হবে। তবে কর্মীরা বঞ্চিত হতে থাকলে কিংবা তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ ক্রমে প্রবল হতে থাকলে সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় লেখাপড়া না জানা অদক্ষ কর্মীরা তাদের অধিকারের সীমা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না, আবার বঞ্চনাজনিত ক্ষোভের প্রকাশও অস্বাভাবিক উপায়ে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এবং যারা প্রবাসে কর্মী প্রেরণ করে সেসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অপরিহার্য করণীয় হচ্ছে তাদের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা। এটা দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে যেমন করতে হবে, তেমনি কাজের সময়েও করা চাই। অনেক দেশে আইন-কানুনে পরিবর্তন ঘটে। সেটাও জানাতে হবে। আমাদের নাগরিকরা অন্য দেশে কাজের জন্য গেলে সেখানকার আইন মেনে চলতে হবে। কিন্তু সমস্যায় পড়লে আইনি সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতেও হবে।
বিশ্ব্বায়নের যুগে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদের মতো আইন থাকতে পারে কি-না, সে প্রশ্ন অনেকে করেন। সৌদি আরব কিন্তু অনেক অমুসলিম দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। অন্য ধর্মাবলম্বী নাগরিকরাও সে দেশে কাজের জন্য যাচ্ছে। ইরাকে সামরিক অভিযানের জন্য নানা দেশের, নানা ধর্মের সৈন্যরা বহুজাতিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল এ দেশটিতে। এ দেশটির শাসকরা নাগরিক অধিকার সম্পর্কেও ভিন্নতর অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। নারীর অধিকার সীমিত হলেও স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে। এ প্রেক্ষাপটে তাদের অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত আইন আরেকটু কি মানবিক হতে পারে না? ইসলাম শান্তির ধর্ম। জ্ঞানের চর্চা সেখানে স্বীকৃত। সেখানকার প্রাচীন মাদ্রাসাগুলোতে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান পড়ানো হতো। নারীদের অধিকারও স্বীকৃত ছিল। অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন ইসলাম অনুমোদন দেয় না। এখন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। গণতন্ত্র সবার দাবি। সৌদি শাসকরাও তা বুঝতে পারছেন এবং নানা ইস্যুতে কট্টর অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেছেন। বলা যায়, তারা ধাপে ধাপে খোলা হাওয়ার যুগে প্রবেশ করছেন। বিচার ব্যবস্থাতেও এর প্রভাব পড়বে, এটাই প্রত্যাশিত। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, প্রবাসে কাজ করছে যে লাখ লাখ মানুষ, যাদের বেশিরভাগ গরিব_ তাদের প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়া চাই। তারা দেশে বেকারত্বের অসহনীয় চাপ কমাচ্ছে, বিদেশি মুদ্রা পাঠিয়ে রিজার্ভ সমৃদ্ধ করছে এবং অর্থনীতির চাকা সচল করে তোলায় অবদান রাখছে। 'গরিবের পাশে কেউ নেই'_ এমন ধারণা তাদের মধ্যে কোনোভাবেই যেন সৃষ্টি হতে না পারে। আর এটা প্রমাণের প্রধান দায় সরকারেরই। সমাজের অন্যদেরও দায় কম নেই।
আমেনা মহসিন :অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌদি আরব কী ধরনের রাষ্ট্র, সেটা আমাদের জানা আছে। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় আপত্তি প্রকাশ করা গুটিকয়েক রাষ্ট্রের একটি ছিল বাদশাহশাসিত এ দেশ। তারা মানবাধিকার ঘোষণা এখনও স্বীকার করে না। তবে তাদের যুক্তি হচ্ছে, ধর্মীয় আইন ও ঐতিহ্য অনুসরণ করেই কঠোর শাস্তির বিধান সেখানে বলবৎ রয়েছে। এর উদ্দেশ্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা। অপরাধের জন্য কঠোরতম দণ্ড দেওয়া হলে অন্যরা অপরাধ করতে ভয় পাবে, এটাই মনে করা হয়।
এ যুক্তি ঠিক কি-না অথবা পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান শুরু থেকেই একরূপ ছিল কি-না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। আমরা ইতিহাস থেকে জানি হজরত মুহম্মদ (সাঃ) তাঁর কোনো উত্তরাধিকার রেখে যাননি। ইসলামে রাজতন্ত্রেরও বিধান নেই। কিন্তু সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় উত্তরাধিকার প্রথা স্বীকৃত। সেখানে বিচার ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে তারা বিচার করেছে তাদের প্রচলিত আইন ও বিধান অনুসরণ করে এবং এই প্রথম নয়, বহু বছর ধরেই শরিয়া আইন সে দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তারা গোপনে কিছু করছে, সেটাও বলা যাবে না। তবে যে কোনো দেশ আলাদা বিচার ব্যবস্থা রাখার অধিকার সংরক্ষণ করে, সেটা যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলেও বলতে চাই_ ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে কি?
যেসব বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে তারা বিচারের সময় নিজেদের যথাযথভাবে ডিফেন্ড করতে পেরেছে কি-না, সেটাও বড় প্রশ্ন। যে ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে তাতে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে এবং তা কার্যকর হয়ে থাকে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করে_ এটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই অবগত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি, যাদের বেশিরভাগ অদক্ষ এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আদৌ নেই। তাদের সাধারণ অভিযোগ_ আপদ-বিপদে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা মেলে না। আলোচিত ক্ষেত্রে মিলেছিল কি?
বাংলাদেশের ওই হতভাগ্য ৮ শ্রমিকের বিরুদ্ধে একটি বৈদ্যুতিক ওয়ারহাউসে ডাকাতি এবং একজন মিসরীয় প্রহরীকে খুনের অভিযোগ রয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, এরা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সমকালে ওই ৮ জনের পরিবার ও স্বজনদের যে পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে তাতেও এর স্বীকৃতি মেলে। তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার কি সাধ্যমতো সব কিছু করেছিল? সচ্ছল পরিবারের কেউ অন্য দেশে দণ্ডিত হলে তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য যেমন চেষ্টা করা হয়, গত চার বছরে বাংলাদেশ সরকার তেমনভাবে উদ্যোগী হয়েছিল কি-না? সংবাদপত্রে দেখেছি রাষ্ট্রপতি সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের ক্ষমা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি ডাকাতির সময় নিহত মিসরীয় প্রহরীর পরিবারের কাছে 'ব্লাড-মানির' প্রস্তাবও দেওয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তারপরও প্রশ্ন উঠতেই থাকবে_ আমরা সব কিছু করেছি তো?
বিশ্বের অনেক দেশে এখন মাইগ্র্যান্ট শ্রমিকরা কাজ করছে। যে দেশ থেকে তারা যাচ্ছে এবং যে দেশে যাচ্ছে, উভয়ের জন্য অবশ্য করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক আইনে। নিজ দেশের শ্রমিকদের জন্য যেমন শ্রম আইন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভিনদেশিদের জন্যও। তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই নিশ্চিত করা চাই। বিদেশিরা যে দেশে কাজ করছে সেখানকার আইন লঙ্ঘন করলে কিংবা অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তাদের বিচার কাজ কীভাবে সম্পন্ন করা হবে, সেসবও আন্তর্জাতিক আইনে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রবাসে বাংলাদেশের শ্রমিকরা এসব সুবিধা পাচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকতে হয় সরকারকে। দেখা যায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন-ভাতা দেওয়া হয় না কিংবা অনিয়ম ও হয়রানির ঘটনা ঘটে। কিন্তু শ্রমিকরা তার প্রতিবাদ করতে গেলে স্থানীয় আইন লঙ্ঘনের ঝামেলায় পড়ে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আলোচ্য ক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা যথেষ্ট কঠোর হয়েছে বলেই মনে হয়। মাইগ্র্যান্ট শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী অভিযুক্তদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করার জন্য প্রস্তাব রাখা হয়েছিল কি? হতে পারে এ ধরনের প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা ফল দেয়নি। এ ঘটনাটি সে ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় হয়ে উঠবে, এটাই কাম্য। বাংলাদেশ সরকার অভিযুক্তদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যথেষ্ট লবি করেছিল কি-না, সেটাও প্রশ্ন। কেউ অপরাধ করলে_ সেটা দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই হোক, তাকে বাঁচানোর প্রশ্ন আসে না। কিন্তু যে কোনো স্থানেই বিচার হোক, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকেই বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। প্রবাসে যারা কাজ করছে তাদের শ্রম ও অন্যান্য অধিকার সংরক্ষণে যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অবস্থান গ্রহণ করে সেজন্যও চেষ্টা চালানো দরকার। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকরা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। আমাদের সরকারকে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা মানবাধিকার ইস্যুতে সোচ্চার অন্যান্য দেশ সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশি শ্রমিকদের জীবন রক্ষায় আদৌ কোনো ভূমিকা রাখেনি। এমনকি দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার পরও জোরালো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। এমন ঘটনা সৌদি আরব না হয়ে আফগানিস্তান কিংবা ইরাকে ঘটলে তাদের প্রতিক্রিয়া ভিন্নতর হতো বলেই ধারণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে জার্মানির জন্য অন্য দেশে সামরিক প্রয়োজনে সৈন্য প্রেরণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সে দেশের জনমতও এ প্রশ্নে যথেষ্ট রক্ষণশীল। তারপরও তারা আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করে মানবাধিকার সংরক্ষণের ইস্যুটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু সৌদি আরবের তেল আমদানি এবং সে দেশে বিপুল মারণাস্ত্র বিক্রির স্বার্থে 'মানবাধিকার' ইস্যুতে সোচ্চার সব দেশ বাংলাদেশিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনায় একরূপ নীরব থাকে। এটা স্পষ্টতই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। বিশ্ব সমাজে এ বিষয়টি নিয়ে কি আলোচনা হতে পারে না? সৌদি আরব জাতিসংঘের সদস্য দেশ। এ বিশ্ব সংস্থাও কিন্তু কার্যত প্রতিক্রিয়াহীন।
প্রবাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি কর্মী কাজ করে সৌদি আরবে। মালয়েশিয়াতেও কয়েক লাখ বাংলাদেশি রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেই আমাদের নাগরিকদের বেশি উপস্থিতি। অন্তত ৭৫ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কাজ করছে বলে ধারণা করা হয়। দেশ ভেদে আইন-কানুন ও সুযোগ-সুবিধায় পার্থক্য রয়েছে। যে দেশে যিনি কাজ করেন তাকে অবশ্যই সে দেশের আইন মেনে চলতে হবে। তবে কর্মীরা বঞ্চিত হতে থাকলে কিংবা তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ ক্রমে প্রবল হতে থাকলে সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় লেখাপড়া না জানা অদক্ষ কর্মীরা তাদের অধিকারের সীমা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না, আবার বঞ্চনাজনিত ক্ষোভের প্রকাশও অস্বাভাবিক উপায়ে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এবং যারা প্রবাসে কর্মী প্রেরণ করে সেসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অপরিহার্য করণীয় হচ্ছে তাদের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা। এটা দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে যেমন করতে হবে, তেমনি কাজের সময়েও করা চাই। অনেক দেশে আইন-কানুনে পরিবর্তন ঘটে। সেটাও জানাতে হবে। আমাদের নাগরিকরা অন্য দেশে কাজের জন্য গেলে সেখানকার আইন মেনে চলতে হবে। কিন্তু সমস্যায় পড়লে আইনি সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতেও হবে।
বিশ্ব্বায়নের যুগে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদের মতো আইন থাকতে পারে কি-না, সে প্রশ্ন অনেকে করেন। সৌদি আরব কিন্তু অনেক অমুসলিম দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। অন্য ধর্মাবলম্বী নাগরিকরাও সে দেশে কাজের জন্য যাচ্ছে। ইরাকে সামরিক অভিযানের জন্য নানা দেশের, নানা ধর্মের সৈন্যরা বহুজাতিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল এ দেশটিতে। এ দেশটির শাসকরা নাগরিক অধিকার সম্পর্কেও ভিন্নতর অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। নারীর অধিকার সীমিত হলেও স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে। এ প্রেক্ষাপটে তাদের অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত আইন আরেকটু কি মানবিক হতে পারে না? ইসলাম শান্তির ধর্ম। জ্ঞানের চর্চা সেখানে স্বীকৃত। সেখানকার প্রাচীন মাদ্রাসাগুলোতে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান পড়ানো হতো। নারীদের অধিকারও স্বীকৃত ছিল। অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন ইসলাম অনুমোদন দেয় না। এখন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। গণতন্ত্র সবার দাবি। সৌদি শাসকরাও তা বুঝতে পারছেন এবং নানা ইস্যুতে কট্টর অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেছেন। বলা যায়, তারা ধাপে ধাপে খোলা হাওয়ার যুগে প্রবেশ করছেন। বিচার ব্যবস্থাতেও এর প্রভাব পড়বে, এটাই প্রত্যাশিত। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, প্রবাসে কাজ করছে যে লাখ লাখ মানুষ, যাদের বেশিরভাগ গরিব_ তাদের প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়া চাই। তারা দেশে বেকারত্বের অসহনীয় চাপ কমাচ্ছে, বিদেশি মুদ্রা পাঠিয়ে রিজার্ভ সমৃদ্ধ করছে এবং অর্থনীতির চাকা সচল করে তোলায় অবদান রাখছে। 'গরিবের পাশে কেউ নেই'_ এমন ধারণা তাদের মধ্যে কোনোভাবেই যেন সৃষ্টি হতে না পারে। আর এটা প্রমাণের প্রধান দায় সরকারেরই। সমাজের অন্যদেরও দায় কম নেই।
আমেনা মহসিন :অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments