সন্তানের কাছে মায়ের লাশের জবাব দিতে না পেরে আত্মহত্যা করেন সেনা কর্মকর্তা
নূরুজ্জামান: স্ত্রীকে খুন করে ছেলের কাছে ধরা পড়েই আত্মহত্যার জন্য পাঁচ তলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন সেনা কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন। শেষ পর্যন্ত বাঁচার চেষ্টা করেও বাঁচতে পারেননি। শুক্রবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। একইদিন দুপুরের পর রাজধানীর দক্ষিণ কাফরুলের ২৩০ নম্বর বাসার ৫ম তলার ফ্ল্যাটে স্ত্রী দেলোয়ারা বেগমকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ খাটের নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এ ঘটনায় রাজধানীর কাফরুল থানায় দু’টি মামলা হয়েছে। পুলিশ ও নিহতদের স্বজনরা জানান, পরকীয়ার সন্দেহ ও বেকারত্বকে কেন্দ্র করে স্ত্রী দেলোয়ারা বেগমকে হত্যা করে তার স্বামী ইসমাইল হোসেন পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে লফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। কাফরুল থানার এসআই অনিমেষ চন্দ্র সরকার বলেন, স্ত্রীর পরকীয়া সন্দেহ করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো। এসব বিষয় নিয়ে হত্যাকাণ্ডের দিন দুপুরের আগে থেকেই তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়ার কারণে তারা দু’জনেই বোনের দাওয়াতে যাননি। শুধু ছোট ছেলে ও ৮ম শ্রেণীর ছাত্র দোয়েলকে পাঠিয়ে দেন। বাসায় ছিল তাদের বড় ছেলে আনন্দ (১৮)। এ ছেলে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী। তাই তাদের ঝগড়া থামানোর আর কোন লোকজন ছিল না। কাফরুল থানার ওসি মো. আবদুল লতিফ বলেন, ছোট ছেলে দোয়েলকে তার খালার বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে স্বামী-স্ত্রী ফের ঝগড়ায় লিপ্ত হন। ধারণা করা হচ্ছে, এরই একপর্যায়ে ইসমাইল তার স্ত্রীকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে লাশ খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন। পরে বিকালের দিকে ছোট ছেলে দোয়েল বাসায় ফিরে আসে। মা কোথায় জানতে চেয়ে বাবার কাছে জিজ্ঞেস করে। ছেলের প্রশ্নের জবাবে ইসমাইল বলেন, তোর মা তোর খালার বাসায় গেছে। এ কথা শুনে দোয়েল তখন বাইরে খেলতে যায়। খেলা শেষে সন্ধ্যার দিকে দোয়েল বাসায় এসে মাকে দেখতে না পেয়ে ফের মা’র কথা বাবার কাছে জানতে চায়। ইসমাইল তখনও বলেন, তোর খালার বাসা থেকে আসেনি। সঙ্গে সঙ্গে দোয়েল তার খালার বাসায় ফোন দিয়ে মাকে ডেকে দিতে বলে। তখন ওপাশ থেকে দোয়েলের খালা বলেন, কই তোর মা সারা দিনে একবারও আসেনি। এরপরই দোয়েলসহ অন্যান্য স্বজনরা দেলোয়ারা বেগমের অবস্থান জানার জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এরই এক ফাঁকে ইসমাইল হোসেন বাসা থেকে বেরিয়ে ছাদে ওঠেন। দোয়েল বাসার বিভিন্ন কক্ষ ও বাথরুমে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে কৌতূহলবশত খাটের নিচে উঁকি মারে। সেখানে মায়ের পা দেখতে পেয়েই চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকার শুনে স্বজনরা ছুটে যান। মায়ের এমন পরিণতির কৈফিয়ত জানার জন্য দোয়েল দৌড়ে ছাদে ওঠে। বাবাকে বলতে থাকে, মাকে মেরে কেন খাটের নিচে রেখেছো? কেন মিথ্যা কথা বলেছো? ছেলের এমন প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ইসমাইল ওই ভবনের ছাদ থেকে হঠাৎ লাফ দেন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে পাশের দুই তলা ভবনের ওপর আছড়ে পড়েন। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী ফরিদ উদ্দিন মিয়া বলেন, পাঁচতলার হৈচৈ ও দ্বিতীয় তলার বিকট শব্দ শুনে এলাকার লোকজন চোর সন্দেহে ওই বাসায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় ইসমাইল হোসেনকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাইটেক ক্লিনিকে ভর্তি করেন। ওদিকে বাসার খাটের নিচ থেকে তার স্ত্রীর লাশ উদ্ধার করে একই ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। কাফরুল থানার ওসি আবদুল লতিফ বলেন, আমরা খবর পেয়ে হাইটেক হাসপাতালে যাই। সেখানকার চিকিৎসক দেলোয়ারা বেগমকে আগেই মৃত ঘোষণা করেন। পরে ইসমাইল হোসেনের অবস্থার অবনতি হলে তাকে হার্ট ফাউন্ডেশন এ নেয়া হয়। সেখানেও অবস্থার উন্নতি না হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যায় কাফরুল থানায় একটি হত্যা ও অন্যটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। দেলোয়ারা বেগমের হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে তার স্বামী ইসমাইল হোসেনকে। একই সঙ্গে ইসমাইলের পরিবার ইসমাইলের আত্মহত্যার ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছে। দু’টি লাশের ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল তাদের লাশ জামালপুরের দাউদকান্দি এলাকায় গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। দেলোয়ারা বেগমের বড় ভাই মোশাররফ হোসেন বলেন, আমার বোনকে বিনা কারণে সন্দেহ করতো ইসমাইল। সমপ্রতি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর ইসমাইল কোন কাজ জুটাতে না পেরে হীনমন্যতায় ভুগছিল। এছাড়া গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়াকে কেন্দ্র করেও দু’জনের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না। ইসমাইল গ্রামে যেতে চাইলেও দেলোয়ারা যেতে চাননি। দোয়েলের পড়াশোনার কারণে ঢাকাতেই থাকতে চেয়েছিল। তদন্ত সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার ইসমাইল সর্বশেষ র্যাবে কর্মরত ছিলেন। পরে মিশনে চলে যান। দীর্ঘদিন বাইরে থাকার পর ২০১০ সালে দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসেই স্ত্রীকে নিয়ে সন্দেহ করতে থাকেন। এরই মধ্যে তিনি অবসরে যান। বেকার হয়ে চাকরি খুঁজতে থাকেন। একদিকে বড় ছেলের মানসিক ভারসাম্যহীনতা, অন্যদিকে চাকরি খুঁজে না পেয়ে তিনি নানা হতাশায় ভুগছিলেন।
No comments