রম্য রচনা-খোশ আমদেদ নিউ বর্ষ by আনিসুল হক
বাংলাদেশে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের একটা সুবিধা হলো, ঠান্ডার দিন, ঠান্ডার রাত; পয়লা বৈশাখের অগ্নিস্নানে শুচি হতে হয় না ধরাকে, বরং অন্ধকার নিকষকালো রাতে যে থার্টি ফার্স্ট আসে, তাতে অনেকেই থার্স্টি ফাস্ট ভঙ্গকরতেপারেন।বাংলাদেশে আমরা যারা শহরে-টহরে থাকি, তাদের জন্য গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারই একমাত্র দিনপঞ্জি। আমাদের তো আর বীজধান বপন করতে হয় না, কাটামারিও করতে হয় না, আমরা বরং খ্রিষ্টীয় মাসের পয়লা তারিখে মাহিনা পাই আর মাহিনা যদি না-ও
পাই, বাসাওয়ালা বাসাভাড়ার জন্য দরজায় কড়া নাড়েন, পত্রিকার হকার দরজার নিচ দিয়ে বিলটি দিয়ে যান আর মোবাইল ফোনে এসএমএস আসে, আপনার পোস্টপেইড বিল হয়েছে... আমরাও চমকে উঠি। বলি, ওমা, মাত্র সেদিনই না বিল দিলাম, এরই মধ্যে মাস কাবার!
আর এই গ্রেগরিয়ান নববর্ষ, এটা যে আসছে, তা কী করে বোঝা যায়? বাংলা নববর্ষ বোঝা যায় শাখায় শাখায় নবপত্র দেখে আর গ্রেগরিয়ান নববর্ষ বোঝা যায় পত্রপত্রিকার নতুন নতুন শাখা দেখে। সারা বছর কেমন গেল? ও শাকিব খান, ও রিয়াজ, ও ফেরদৌস, ও মৌসুমী, ও পূর্ণিমা, ও হাবিব, ও ন্যান্সি, ও সাকিব আল হাসান, ও মুশকিফুর রহিম...আপনারা বলুন, আপনাদের সারাটা বছর কেমন গেছে। প্রশ্ন কমন, উত্তরও জানা। সারাটা বছর গেছে ভালোমন্দ মিলিয়ে, দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছি, একটা কাজ করেছি, খুবই যত্ন করে, ওই কাজটার জন্য অনেক এসএমএস পেয়েছি, অনেক ফোন পেয়েছি, নাহ্, এ বছরও বিয়ে করি নাই, সামনের বছরও করছি না, এত কাজ, বিয়ের কথা ভাবার সময়ও নেই, (বলতে বলতে দুটো বিয়ে আর দুটো বিচ্ছেদ সুসম্পন্ন) অবশ্য আব্বা-আম্মা যদি দেন, তো আলাদা কথা। আর জানেনই তো হায়াত-মউত, রিজিক-দৌলত এবং বিয়ে আল্লাহর হাতে। আর আছে রাশিচক্র সংখ্যা, আগামী বছর কেমন যাবে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার আগামী বছর কেমন যাবে, খালেদা জিয়ার আগামী বছর কেমন যাবে থেকে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীনেরটা কেমন যাবে, তার বর্ণনা থাকে। শেখ হাসিনার জন্য ভবিষ্যদ্বাণী হলো, বছরটা ভালো যাবে, তবে বছরজুড়েই রাজনৈতিক বিরোধ মোকাবিলা করতে হবে, বিরোধী দল সংসদে আসবে না এবং দুটো গভীর ষড়যন্ত্র তাঁকে মোকাবিলা করতে হবে। খালেদা জিয়ার জন্য ভবিষ্যদ্বাণী হলো, বছরটা খুব ব্যস্ত যাবে, তবে বছরের শেষভাগটা সৌভাগ্যময়, কিন্তু কায়িক ক্লেশ কিংবা স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ আপনি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারেন। ভবিষ্যৎ বক্তারা তো তা পারবেনই। তবে সবচেয়ে নিশ্চিত হলো জনগণের ভাগ্য। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে, জনগণের প্রাণ যাই যাই করবে। হরতাল হবে, ঘেরাও হবে, লংমার্চ হবে, বাসে আগুন দেওয়া হবে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হবে, জিনিসপাতির দাম বাড়বে, দখল-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বাড়বে, সবকিছুর দাম বাড়বে, শুধু নাগরিকের জীবনের দাম কমবে, নিরাপত্তা কমবে। বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচে হারতেই থাকবে, মাঝেমধ্যে দু-একটা ওয়ানডে জিতে যাবে। মন্ত্রীরা বাজে বকবেন এবং সমালোচিত হবেন। সড়ক দুর্ঘটনা চলবে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পাবে। খবরের কাগজে তাদের নৃত্যদৃশ্য দেখে আমাদের বুক ভরে উঠবে গর্বে। আমেরিকাসহ দাতা দেশগুলোর খবরদারি বাড়বে। এসব কথা বলার জন্য জ্যোতিষসম্রাট হতে হয় না, মধ্যরাতের টক শোর রাজনৈতিক ভাষ্যকার হওয়ারও দরকার পড়ে না। তবে এসব কথাবার্তা যখন টেলিভিশনে, খবরের কাগজে খুব বলাবলি হয়, তখন আমরা বুঝি, পুরোনো বছর চলে গেল, নতুন বছর এসেই গেছে, দেয়ালের ক্যালেন্ডারটা এবার বদলাতেই হয়। হাতে যেমন আর ঘড়ি লাগে না, মোবাইল ফোনেই দেখে নেওয়া যায় সময়, তেমনি হয়তো আর ক্যালেন্ডারও লাগে না, ক্যালেন্ডারও তো মোবাইল ফোনেই আছে। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে আবার আজকাল থার্টি ফার্স্ব নাইটে অতিরিক্ত সতর্ক হতে হয়, বিশেষ করে উত্তর ঢাকার দিকে পাহারা বাড়াতে হয়, যেন কোনো কেলেঙ্কারি না ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে আমরা সত্যি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। ভীষণ অস্থির একটা সময়। একদিকে পশ্চিম তার সর্বশেষ আবিষ্কারটা নিয়ে ঢুকে গেছে আমাদের ঘরে ঘরে, অন্যদিকে আমাদের সেই শিক্ষাও নেই, সেই প্রস্তুতিও নেই, সেই অর্থনৈতিক সংগতিও নেই, মোবাইল ফোন পেয়ে আমরা যা করি, তা হলো ভালোবাসার মুহূর্তের ছবি তুলে তা ছেড়ে দিই ইন্টারনেটে। আমরা কলকারখানা করি, সেখানে শ্রমিকদের বেতন দিতে চাই না, আর বর্জ্য সরাসরি ফেলে দিই নদীর জলে, নদীর জলকে করে তুলি কালো থিকথিকে। আমরা একই সঙ্গে রক্ষণশীল ও পরিবর্তনকামী, আমরা একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ ও রাষ্ট্রধর্মের রক্ষক। এ দেশে এই একত্রিশে আসে এক ভয়াবহ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হয়ে। আমরা বলি বটে, এ আমাদের কালচার নয়, তবে সেই ভালচার এসে আমাদের আকাশেও পাখা বিস্তার করে।
সামনের বছরটা কেমন যাবে? এই প্রশ্নের একটা উত্তর দিতে চাই। ভালো যাবে। কারণ, আমরা এত খারাপ দেখে ফেলেছি যে এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে, কী আসতে পারে আমাদের জীবনে? অসম্ভব। সেই পুরোনো কৌতুকটা মনে করি। জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে একজন হাত দেখিয়ে বলল, আমার বিবাহিত জীবন কেমন যাবে? জ্যোতিষী বললেন, প্রথম ২৪ বছর খুব ঝড়ঝঞ্ঝা যাবে, তারপর আর সমস্যা নাই, সেটা অভ্যাস হয়ে যাবে। গত ৪০ বছরে আমরা এত এত দুঃসময় পার হয়ে এসেছি যে এরপর কোনো খারাপই আর আমাদের খারাপ রাখতে পারবে না। ভালো আমরা থাকবই।
প্রিয় পাঠক, শুভ নববর্ষ। হ্যাপি নিউ ইয়ার।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক।
আর এই গ্রেগরিয়ান নববর্ষ, এটা যে আসছে, তা কী করে বোঝা যায়? বাংলা নববর্ষ বোঝা যায় শাখায় শাখায় নবপত্র দেখে আর গ্রেগরিয়ান নববর্ষ বোঝা যায় পত্রপত্রিকার নতুন নতুন শাখা দেখে। সারা বছর কেমন গেল? ও শাকিব খান, ও রিয়াজ, ও ফেরদৌস, ও মৌসুমী, ও পূর্ণিমা, ও হাবিব, ও ন্যান্সি, ও সাকিব আল হাসান, ও মুশকিফুর রহিম...আপনারা বলুন, আপনাদের সারাটা বছর কেমন গেছে। প্রশ্ন কমন, উত্তরও জানা। সারাটা বছর গেছে ভালোমন্দ মিলিয়ে, দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছি, একটা কাজ করেছি, খুবই যত্ন করে, ওই কাজটার জন্য অনেক এসএমএস পেয়েছি, অনেক ফোন পেয়েছি, নাহ্, এ বছরও বিয়ে করি নাই, সামনের বছরও করছি না, এত কাজ, বিয়ের কথা ভাবার সময়ও নেই, (বলতে বলতে দুটো বিয়ে আর দুটো বিচ্ছেদ সুসম্পন্ন) অবশ্য আব্বা-আম্মা যদি দেন, তো আলাদা কথা। আর জানেনই তো হায়াত-মউত, রিজিক-দৌলত এবং বিয়ে আল্লাহর হাতে। আর আছে রাশিচক্র সংখ্যা, আগামী বছর কেমন যাবে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার আগামী বছর কেমন যাবে, খালেদা জিয়ার আগামী বছর কেমন যাবে থেকে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীনেরটা কেমন যাবে, তার বর্ণনা থাকে। শেখ হাসিনার জন্য ভবিষ্যদ্বাণী হলো, বছরটা ভালো যাবে, তবে বছরজুড়েই রাজনৈতিক বিরোধ মোকাবিলা করতে হবে, বিরোধী দল সংসদে আসবে না এবং দুটো গভীর ষড়যন্ত্র তাঁকে মোকাবিলা করতে হবে। খালেদা জিয়ার জন্য ভবিষ্যদ্বাণী হলো, বছরটা খুব ব্যস্ত যাবে, তবে বছরের শেষভাগটা সৌভাগ্যময়, কিন্তু কায়িক ক্লেশ কিংবা স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ আপনি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারেন। ভবিষ্যৎ বক্তারা তো তা পারবেনই। তবে সবচেয়ে নিশ্চিত হলো জনগণের ভাগ্য। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে, জনগণের প্রাণ যাই যাই করবে। হরতাল হবে, ঘেরাও হবে, লংমার্চ হবে, বাসে আগুন দেওয়া হবে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হবে, জিনিসপাতির দাম বাড়বে, দখল-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বাড়বে, সবকিছুর দাম বাড়বে, শুধু নাগরিকের জীবনের দাম কমবে, নিরাপত্তা কমবে। বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচে হারতেই থাকবে, মাঝেমধ্যে দু-একটা ওয়ানডে জিতে যাবে। মন্ত্রীরা বাজে বকবেন এবং সমালোচিত হবেন। সড়ক দুর্ঘটনা চলবে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পাবে। খবরের কাগজে তাদের নৃত্যদৃশ্য দেখে আমাদের বুক ভরে উঠবে গর্বে। আমেরিকাসহ দাতা দেশগুলোর খবরদারি বাড়বে। এসব কথা বলার জন্য জ্যোতিষসম্রাট হতে হয় না, মধ্যরাতের টক শোর রাজনৈতিক ভাষ্যকার হওয়ারও দরকার পড়ে না। তবে এসব কথাবার্তা যখন টেলিভিশনে, খবরের কাগজে খুব বলাবলি হয়, তখন আমরা বুঝি, পুরোনো বছর চলে গেল, নতুন বছর এসেই গেছে, দেয়ালের ক্যালেন্ডারটা এবার বদলাতেই হয়। হাতে যেমন আর ঘড়ি লাগে না, মোবাইল ফোনেই দেখে নেওয়া যায় সময়, তেমনি হয়তো আর ক্যালেন্ডারও লাগে না, ক্যালেন্ডারও তো মোবাইল ফোনেই আছে। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে আবার আজকাল থার্টি ফার্স্ব নাইটে অতিরিক্ত সতর্ক হতে হয়, বিশেষ করে উত্তর ঢাকার দিকে পাহারা বাড়াতে হয়, যেন কোনো কেলেঙ্কারি না ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে আমরা সত্যি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। ভীষণ অস্থির একটা সময়। একদিকে পশ্চিম তার সর্বশেষ আবিষ্কারটা নিয়ে ঢুকে গেছে আমাদের ঘরে ঘরে, অন্যদিকে আমাদের সেই শিক্ষাও নেই, সেই প্রস্তুতিও নেই, সেই অর্থনৈতিক সংগতিও নেই, মোবাইল ফোন পেয়ে আমরা যা করি, তা হলো ভালোবাসার মুহূর্তের ছবি তুলে তা ছেড়ে দিই ইন্টারনেটে। আমরা কলকারখানা করি, সেখানে শ্রমিকদের বেতন দিতে চাই না, আর বর্জ্য সরাসরি ফেলে দিই নদীর জলে, নদীর জলকে করে তুলি কালো থিকথিকে। আমরা একই সঙ্গে রক্ষণশীল ও পরিবর্তনকামী, আমরা একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ ও রাষ্ট্রধর্মের রক্ষক। এ দেশে এই একত্রিশে আসে এক ভয়াবহ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হয়ে। আমরা বলি বটে, এ আমাদের কালচার নয়, তবে সেই ভালচার এসে আমাদের আকাশেও পাখা বিস্তার করে।
সামনের বছরটা কেমন যাবে? এই প্রশ্নের একটা উত্তর দিতে চাই। ভালো যাবে। কারণ, আমরা এত খারাপ দেখে ফেলেছি যে এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে, কী আসতে পারে আমাদের জীবনে? অসম্ভব। সেই পুরোনো কৌতুকটা মনে করি। জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে একজন হাত দেখিয়ে বলল, আমার বিবাহিত জীবন কেমন যাবে? জ্যোতিষী বললেন, প্রথম ২৪ বছর খুব ঝড়ঝঞ্ঝা যাবে, তারপর আর সমস্যা নাই, সেটা অভ্যাস হয়ে যাবে। গত ৪০ বছরে আমরা এত এত দুঃসময় পার হয়ে এসেছি যে এরপর কোনো খারাপই আর আমাদের খারাপ রাখতে পারবে না। ভালো আমরা থাকবই।
প্রিয় পাঠক, শুভ নববর্ষ। হ্যাপি নিউ ইয়ার।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক।
No comments