শিক্ষা-পথচলা এখনো অনেক বাকি by রাশেদা কে চৌধূরী
কালের যাত্রায় অতিক্রান্ত হতে চলেছে আরেকটি বছর—ঘটনাবহুল ২০১১। জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকারেরও তিন বছর প্রায় সমাপ্তির পথে। প্রত্যাশা ছিল অনেক, স্বপ্ন ছিল অফুরন্ত, কিন্তু অপ্রাপ্তির বেদনাও তো কম নয়। সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির স্বপ্ন এখনো অপূর্ণ, অনেক মানবসন্তান বৈষম্য আর বঞ্চনার বেড়াজালে এখনো দিনযাপন করছে, বিশাল জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত জীবন-জীবিকার তাগিদে সংগ্রাম করে চলেছে।
তবে এ চিত্র নতুন নয়। বিগত দিনগুলোতেও এ দেশের মানুষ কতবার কতভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, তা শুধু ইতিহাসের নথি নয়, পরিসংখ্যানেরও বিষয়বস্তু হয়ে আছে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাস, ভয়ানক বন্যা-খরা-মঙ্গা একদিকে অগণিত মানুষকে করেছে সর্বস্বান্ত, অন্যদিকে সামরিক শাসন আর শোষণের জাঁতাকলে তারা বারবার হয়েছে পিষ্ট। সাম্প্রতিক কালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদ ধর্মভীরু, সরলপ্রাণ মানুষের কোমল অনুভূতি নিয়ে একশ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ীর ছিনিমিনি খেলা। কিন্তু এত বিপর্যয়, এত ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও কখনো থেমে যায়নি এ দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম, জ্ঞানের আলোর সন্ধানে অবিরাম পথচলা। এর নিদর্শন আজ সর্বত্র দৃশ্যমান: ঢাকা নগরের সুরম্য অট্টালিকার পেছনে গড়ে ওঠা বস্তির উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রে শিশু-কিশোরদের কলকাকলিতে মুখর শিক্ষায়তন, গ্রামের মেঠোপথে বইপুস্তক বুকে জড়িয়ে একঝাঁক কিশোরীর দ্রুতপদে স্কুলমুখে যাত্রা অথবা উপকূলের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে সাঁকো পেরিয়ে দূরের হাইস্কুলে সকাল-সন্ধ্যা কিশোর-কিশোরীদের যাতায়াতের দৃশ্য কিংবা মহানগরের ভয়াবহ যানজটে আটকে পড়া কোনো এক স্কুলের তিন চাকার খাঁচাসদৃশ ভ্যানে গরমে-ক্লান্তিতে হাঁসফাঁস করা শিশুর দল। এ সবই তো আজ আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক চিত্র। পরিসংখ্যানও বলছে, আমাদের জনমানুষের মনে শিক্ষার চাহিদা নিয়ে কোনো গলদ নেই, গলদ আছে অন্যত্র—শিক্ষার নিরবচ্ছিন্ন ও যথাযথ সরবরাহে, গুণগত মানে।
বছরান্তে আজ তাই আত্মজিজ্ঞাসার স্থান থেকে মনে হচ্ছে ‘সবার জন্য শিক্ষা’র লক্ষ্য অর্জনে হয়তো বেশ কিছু সাফল্য আছে, কিন্তু পথচলা এখনো অনেক বাকি। শিক্ষার গুণগত মানই শুধু নয়, ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণ আর ক্রমবর্ধমান বৈষম্য শিক্ষাকে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটি জায়গায়, যেখানে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী হয়ে উঠছে অসহায়। সীমাহীন কোচিং-বাণিজ্য, মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো দুর্বলতা, শিক্ষকদের বহুবিধ সমস্যা, শ্রেণীকক্ষে শিখন-শিক্ষণের প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, শিক্ষা প্রশাসনের বহুমুখী অন্তরায়, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষার্থীবান্ধব কিংবা যুগোপযোগী চিন্তাচেতনার অভাব ইত্যাদি অসংখ্য সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এ দেশের অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যকে প্রতিনিয়ত আলিঙ্গন করলেও শিক্ষার চাহিদা অন্তরে ধারণ করে নিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার প্রথম স্তর প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি করছে সন্তানদের। মা-বাবা-অভিভাবককের অদম্য স্পৃহার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নীতিনির্ধারকদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সরকারের সহায়ক নীতিমালা। ৯০ শতাংশের বেশি শিশু আসছে প্রাথমিক বা সমমানের বিদ্যালয়গুলোতে (উন্নয়নশীল একটি দেশে এ এক অভাবিত অর্জন)। আর সে কারণেই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কণ্ঠে ব্যক্ত হয় বিস্মিত অভিব্যক্তি, ‘সামাজিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ভালো করছে!’ অবিরাম জীবনসংগ্রামী এই বাংলার গণমানুষ এভাবে কত অসম্ভবকেই না সম্ভব করেছে। তথাকথিত ‘দরিদ্র, নিরক্ষর’ মানুষের এই দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অর্জিত হয়েছে ছেলেমেয়ের সমতা; মূলধারার প্রাথমিক শিক্ষায়তনে শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও এসে গেছে নারী-পুরুষের সমান হার।
নারীর সম-অধিকার অর্জনের অগ্রযাত্রায় এই একটি সোপান অতিক্রম সহজতর হলেও মসৃণ হয়নি এরপরের পথচলা। ‘এডুকেশন ওয়াচ’ গবেষণার মাঠজরিপ থেকে জানা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণীতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ শতাংশ হারে যতখানি বেশি, দশম শ্রেণী সমাপ্ত করার আগে তারা ঝরে যায় ঠিক তত হারে। অংশগ্রহণের এই হার কমতে কমতে বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে গিয়ে এক-চতুর্থাংশ হয়ে যায়। অবশ্য চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশল, স্থাপত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রধানত সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর মেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক বেশি।
তবে শিক্ষার সব ধারায়, সর্বস্তরে ঝরে পড়ার প্রবণতা ক্রমাগত একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। সরকারি-বেসরকারি তথ্য-উপাত্ত থেকে মোটা দাগে এটা আজ প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে যে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ জনও উচ্চশিক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে না। যারা কোনোক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতে পারে, তাদের জন্য অপেক্ষা করে এক অবিশ্বাস্য জগৎ। তথাকথিত ছাত্রনেতাদের নিজ নিজ দল অথবা দলের ভেতরে উপদলের ওপর আধিপত্য বিস্তারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সিট-বাণিজ্য, মাদক আর অস্ত্রের দাপটে জিম্মি হয়ে থাকে অনেক শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার সার্বিক পরিবেশ হয়ে ওঠে নেতিবাচক। নীতিনির্ধারণী মহলও আজ এসব রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাই শুরু হয়েছে বহুমুখী চিন্তাভাবনা, শিক্ষানীতি ২০১০-এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে, ‘দিনবদলের সনদের’ সঙ্গে সমন্বিত করে তৈরি হয়েছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রাথমিক শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে প্রণীত হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৩। সব শিশুকে স্কুলে আনার লক্ষ্যে বহুমুখী কর্মসূচি এসেছে, ঝরে পড়া রোধে নেওয়া হয়েছে অনেক কার্যক্রম। অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে উপবৃত্তি কর্মসূচি সম্প্রসারণ, যথাযথ শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শ্রেণীকক্ষে উন্নততর শিখন-শেখানোর প্রক্রিয়া চালু, শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা, পাঠ্যপুস্তকের পরিমার্জন, শিক্ষা প্রশাসনকে সুবিন্যস্তকরণ, শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অধিকতর বিনিয়োগ—সবই আছে সরকারি পরিকল্পনায়, মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর নথিপত্রে, মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমে।
কিন্তু এত কিছুর পরও কেন এখনো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না সব মানবসন্তানের শিক্ষার অধিকার? রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ঘাটতি তো নেই, তাহলে শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কেন বাড়েনি, কেন বছরের পর বছর ঘুরপাক খাচ্ছে দুই থেকে আড়াই শতাংশ জিডিপির কোঠায়?
বিশেষ করে, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে একধরনের ‘চ্যারিটি মানসিকতা’ এখনো লক্ষণীয়। এদের শিক্ষার মূল দায়িত্ব এখনো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়! কেন আমরা প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাকে ‘চ্যারিটি’ হিসেবে বিবেচনা করছি, তা বোধগম্য নয়। আমরা কী করে ভুলে যাই যে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সব অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে, যদি আমরা সব মানবসন্তানের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারি।
আলোর প্রত্যাশায় যেসব শিশু প্রাথমিক স্তরে প্রবেশ করছে এবং নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্ত করছে, তাদের এক-তৃতীয়াংশই জাতীয়ভাবে নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন করছে না। এ তথ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ইউনেসকো, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় পাওয়া। শিক্ষার মান অর্জনের এই চ্যালেঞ্জ সর্বস্তরের সব ধরনের শিক্ষায় দৃশ্যমান—প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষি, প্রযুক্তি-সর্বত্র।
সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘সবার জন্য শিক্ষা’র দাবিকে আমরা এখনো সর্বদলীয় মতৈক্যের স্থানে নিয়ে যেতে পারিনি। এ দায় কার? আমাদের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত সমাজ-ই বা এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন, কতখানি দায়িত্বশীল?
কিন্তু এসব হতাশা, অপ্রাপ্তির মধ্যেও যখন দেখি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী অথবা অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হারই শুধু বাড়ছে না, ঝরে পড়ার হারও কমছে, তখন আশান্বিত হই বৈকি। তার সঙ্গে যখন গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পাই অদম্য মেধাবী সেই সব শিশু-কিশোরের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে শিক্ষার অর্জনের কথা, অসংখ্য বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও জিপিএ-৫ পাওয়ার কাহিনি, তখন মনের মধ্যে আশা জাগে, কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কল্পনা আক্তার অথবা পিরোজপুরের কাউখালীর ‘গোল্ডেন বয়’ আল-আমীনের মতো শিশু-কিশোরেরাই আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।
তাই তো স্বপ্ন দেখে যাই, গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে, হাওরে-বাঁওড়ে সর্বত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুখরিত হবে শিশু-কিশোরদের পদচারণে, নতুন প্রজন্মের আলোকিত মানুষগুলো মুছে দেবে পুরোনো প্রজন্মের সব গ্লানি, সব অপ্রাপ্তির বেদনা।
লেখক নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
বছরান্তে আজ তাই আত্মজিজ্ঞাসার স্থান থেকে মনে হচ্ছে ‘সবার জন্য শিক্ষা’র লক্ষ্য অর্জনে হয়তো বেশ কিছু সাফল্য আছে, কিন্তু পথচলা এখনো অনেক বাকি। শিক্ষার গুণগত মানই শুধু নয়, ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণ আর ক্রমবর্ধমান বৈষম্য শিক্ষাকে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটি জায়গায়, যেখানে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী হয়ে উঠছে অসহায়। সীমাহীন কোচিং-বাণিজ্য, মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো দুর্বলতা, শিক্ষকদের বহুবিধ সমস্যা, শ্রেণীকক্ষে শিখন-শিক্ষণের প্রক্রিয়ার দুর্বলতা, শিক্ষা প্রশাসনের বহুমুখী অন্তরায়, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষার্থীবান্ধব কিংবা যুগোপযোগী চিন্তাচেতনার অভাব ইত্যাদি অসংখ্য সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এ দেশের অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যকে প্রতিনিয়ত আলিঙ্গন করলেও শিক্ষার চাহিদা অন্তরে ধারণ করে নিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার প্রথম স্তর প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি করছে সন্তানদের। মা-বাবা-অভিভাবককের অদম্য স্পৃহার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নীতিনির্ধারকদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সরকারের সহায়ক নীতিমালা। ৯০ শতাংশের বেশি শিশু আসছে প্রাথমিক বা সমমানের বিদ্যালয়গুলোতে (উন্নয়নশীল একটি দেশে এ এক অভাবিত অর্জন)। আর সে কারণেই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কণ্ঠে ব্যক্ত হয় বিস্মিত অভিব্যক্তি, ‘সামাজিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ভালো করছে!’ অবিরাম জীবনসংগ্রামী এই বাংলার গণমানুষ এভাবে কত অসম্ভবকেই না সম্ভব করেছে। তথাকথিত ‘দরিদ্র, নিরক্ষর’ মানুষের এই দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অর্জিত হয়েছে ছেলেমেয়ের সমতা; মূলধারার প্রাথমিক শিক্ষায়তনে শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও এসে গেছে নারী-পুরুষের সমান হার।
নারীর সম-অধিকার অর্জনের অগ্রযাত্রায় এই একটি সোপান অতিক্রম সহজতর হলেও মসৃণ হয়নি এরপরের পথচলা। ‘এডুকেশন ওয়াচ’ গবেষণার মাঠজরিপ থেকে জানা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণীতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ শতাংশ হারে যতখানি বেশি, দশম শ্রেণী সমাপ্ত করার আগে তারা ঝরে যায় ঠিক তত হারে। অংশগ্রহণের এই হার কমতে কমতে বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে গিয়ে এক-চতুর্থাংশ হয়ে যায়। অবশ্য চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশল, স্থাপত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রধানত সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর মেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক বেশি।
তবে শিক্ষার সব ধারায়, সর্বস্তরে ঝরে পড়ার প্রবণতা ক্রমাগত একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। সরকারি-বেসরকারি তথ্য-উপাত্ত থেকে মোটা দাগে এটা আজ প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে যে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ জনও উচ্চশিক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে না। যারা কোনোক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতে পারে, তাদের জন্য অপেক্ষা করে এক অবিশ্বাস্য জগৎ। তথাকথিত ছাত্রনেতাদের নিজ নিজ দল অথবা দলের ভেতরে উপদলের ওপর আধিপত্য বিস্তারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সিট-বাণিজ্য, মাদক আর অস্ত্রের দাপটে জিম্মি হয়ে থাকে অনেক শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার সার্বিক পরিবেশ হয়ে ওঠে নেতিবাচক। নীতিনির্ধারণী মহলও আজ এসব রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাই শুরু হয়েছে বহুমুখী চিন্তাভাবনা, শিক্ষানীতি ২০১০-এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে, ‘দিনবদলের সনদের’ সঙ্গে সমন্বিত করে তৈরি হয়েছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রাথমিক শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে প্রণীত হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৩। সব শিশুকে স্কুলে আনার লক্ষ্যে বহুমুখী কর্মসূচি এসেছে, ঝরে পড়া রোধে নেওয়া হয়েছে অনেক কার্যক্রম। অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে উপবৃত্তি কর্মসূচি সম্প্রসারণ, যথাযথ শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শ্রেণীকক্ষে উন্নততর শিখন-শেখানোর প্রক্রিয়া চালু, শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা, পাঠ্যপুস্তকের পরিমার্জন, শিক্ষা প্রশাসনকে সুবিন্যস্তকরণ, শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অধিকতর বিনিয়োগ—সবই আছে সরকারি পরিকল্পনায়, মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর নথিপত্রে, মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমে।
কিন্তু এত কিছুর পরও কেন এখনো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না সব মানবসন্তানের শিক্ষার অধিকার? রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ঘাটতি তো নেই, তাহলে শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কেন বাড়েনি, কেন বছরের পর বছর ঘুরপাক খাচ্ছে দুই থেকে আড়াই শতাংশ জিডিপির কোঠায়?
বিশেষ করে, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে একধরনের ‘চ্যারিটি মানসিকতা’ এখনো লক্ষণীয়। এদের শিক্ষার মূল দায়িত্ব এখনো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়! কেন আমরা প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাকে ‘চ্যারিটি’ হিসেবে বিবেচনা করছি, তা বোধগম্য নয়। আমরা কী করে ভুলে যাই যে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সব অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে, যদি আমরা সব মানবসন্তানের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারি।
আলোর প্রত্যাশায় যেসব শিশু প্রাথমিক স্তরে প্রবেশ করছে এবং নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্ত করছে, তাদের এক-তৃতীয়াংশই জাতীয়ভাবে নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন করছে না। এ তথ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ইউনেসকো, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় পাওয়া। শিক্ষার মান অর্জনের এই চ্যালেঞ্জ সর্বস্তরের সব ধরনের শিক্ষায় দৃশ্যমান—প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষি, প্রযুক্তি-সর্বত্র।
সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘সবার জন্য শিক্ষা’র দাবিকে আমরা এখনো সর্বদলীয় মতৈক্যের স্থানে নিয়ে যেতে পারিনি। এ দায় কার? আমাদের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত সমাজ-ই বা এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন, কতখানি দায়িত্বশীল?
কিন্তু এসব হতাশা, অপ্রাপ্তির মধ্যেও যখন দেখি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী অথবা অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হারই শুধু বাড়ছে না, ঝরে পড়ার হারও কমছে, তখন আশান্বিত হই বৈকি। তার সঙ্গে যখন গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পাই অদম্য মেধাবী সেই সব শিশু-কিশোরের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে শিক্ষার অর্জনের কথা, অসংখ্য বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও জিপিএ-৫ পাওয়ার কাহিনি, তখন মনের মধ্যে আশা জাগে, কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কল্পনা আক্তার অথবা পিরোজপুরের কাউখালীর ‘গোল্ডেন বয়’ আল-আমীনের মতো শিশু-কিশোরেরাই আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।
তাই তো স্বপ্ন দেখে যাই, গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে, হাওরে-বাঁওড়ে সর্বত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুখরিত হবে শিশু-কিশোরদের পদচারণে, নতুন প্রজন্মের আলোকিত মানুষগুলো মুছে দেবে পুরোনো প্রজন্মের সব গ্লানি, সব অপ্রাপ্তির বেদনা।
লেখক নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments