নারী-স্বপ্ন দেখি মেয়েরা থেমে যাবে না by সুমনা শারমীন
স্বপ্ন কি আর তালগাছ? এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? স্বপ্নের ডালপালা আছে। তাই স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে।
স্কুলজীবনে টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিলাম, অলিম্পিক গেমসে (১৯৭৬) রোমানিয়ার জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমিনিচির দুর্দান্ত ক্রীড়ানৈপুণ্য। দশে দশ, দশে দশ...একের পর এক সোনা জিতছে এক কিশোরী। তখন এমন কথাও শুনেছিলাম, ‘নাদিয়া কোমিনিচি, রোমানিয়া’ লিখে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে চিঠি ছেড়ে দিলে তা গিয়ে নাকি ঠিক পৌঁছে যেত
স্কুলজীবনে টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিলাম, অলিম্পিক গেমসে (১৯৭৬) রোমানিয়ার জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমিনিচির দুর্দান্ত ক্রীড়ানৈপুণ্য। দশে দশ, দশে দশ...একের পর এক সোনা জিতছে এক কিশোরী। তখন এমন কথাও শুনেছিলাম, ‘নাদিয়া কোমিনিচি, রোমানিয়া’ লিখে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে চিঠি ছেড়ে দিলে তা গিয়ে নাকি ঠিক পৌঁছে যেত
নাদিয়ার হাতে! ভাবুন একবার, সে বয়সে এ কথা শুনে গায়ে কেমন কাঁটা দিয়েছিল! স্বপ্ন দেখি, এ দেশের একটি মেয়ে একদিন নাদিয়ার মতো পৃথিবীর ঘাড় ঘুরিয়ে দেবে বাংলাদেশের দিকে।
জানি, বাস্তব বিবেচনা বলে, ২০১২ সালের অলিম্পিক গেমসে এমন ঘটনা ঘটবে না। ঘটার কোনো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিতই হয়নি। কিন্তু এ কথা ঠিক, ২০১০ সালে কি আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমাদের মেয়েরা ২০১১-তে ক্রিকেটে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়ে যাবে? ক্রিকেট নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেন, খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা ছাড়া আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এর আগে কি সালমা খাতুন কিংবা সালমা বাহিনীর খবর জানত?
খুলনার একটি মেয়ে। বাবা নেই। অভাব নিত্যসঙ্গী। বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনা হলো না। সেই মেয়েটির নেতৃত্বে যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মেয়েরা শার্টের ওপর টাই পরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আলোকচিত্রীদের পোজ দেন এবং প্রথম আলোর খেলার পাতায় তা ছাপা হয় এ-মাথা থেকে ও-মাথা, তখন আশা জাগে নতুন করে। তবে প্রশ্নও জাগে, সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই মেয়েগুলোর জন্য আমরা সঠিক পরিচর্যা করছি তো? যে দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়েটিও বিকেলবেলা মাঠে গিয়ে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, সে দেশে সালমাদের এই অর্জন আমরা ভুলে যাব না তো? জীবনের বাস্তবতা ওদের খেলা থেকে দূরে নিয়ে যাবে না তো? এই দলের এক খেলোয়াড়ের মাকে প্রথম আলোর সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি ওর বিয়ে হয়ে যায়, বিয়ের পরও ও খেলবে তো? মা বলেছিলেন, ‘স্বামী দিলে খেলবে, না হলে খেলবে না।’
স্বপ্ন দেখি, এ দেশের মেয়েরা যে যে কাজই করুক না কেন, মাঝপথে তা থেমে যাবে না।
পৃথিবীর প্রতাপশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সেই দেশে গিয়ে এক মার্কিন কন্যার সঙ্গে পরিচয়। পেশায় সাংবাদিক। অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) মতো নামকরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যোগ দিয়েছেন আঞ্চলিক পত্রিকায়। কারণ কী? বলছিলেন, ‘ছোট্ট বাচ্চাটার জন্য। এপিতে শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র নেই। এই আঞ্চলিক পত্রিকাটিতে এ ব্যবস্থা দারুণ। সকালবেলা বাচ্চাকে ওদের কাছে রেখে নিশ্চিন্তে ছুটে বেড়াই সংবাদের পেছনে। তারপর ওকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরি। ওর জন্যই চাকরি বদল।’
বুঝুন এবার। বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীকে এখনো নির্ভর করতে হয় মা-শাশুড়ি কিংবা গৃহকর্মীর ওপর। যৌথ পরিবার ভেঙে এখন একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে শহরে। সব কর্মজীবী নারী মা-শাশুড়ির কাছাকাছি থাকতে পারেন না। খুব সৌভাগ্যবান নারীটি নির্ভরযোগ্য গৃহকর্মীর কাছে সন্তান রেখে নিশ্চিন্ত মনে কাজে যেতে পারেন।
স্বপ্ন দেখি, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নির্ভরযোগ্য শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র থাকবে। ঢাকার মহাখালীতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) কর্মীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের শিশু দিবাযত্নকেন্দ্রই ইঙ্গিত দেয়, এই প্রতিষ্ঠানে নারীকর্মীর সংখ্যা কত বেশি এবং তাঁরা যতক্ষণ কর্মক্ষেত্রে থাকেন, ততক্ষণ তাঁদের মেধা-শ্রম দিয়ে কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন। সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা তাঁদের নিত্যসঙ্গী নয়। ২০১২-তেই এই স্বপ্ন পূরণ হবে, তা নয়। অন্তত এই উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিষ্ঠানে। একদিকে বলা হতো, শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ান, অন্যদিকে মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস। পরস্পরবিরোধী। সে জায়গা থেকে আমাদের পরিবর্তন এসেছে। সরকার মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করেছে। পরিবর্তন তো হয়। তাহলে স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়?
স্বপ্ন দেখি, প্রতিটি বিদ্যালয়ে—শহরে-গ্রামে, বাংলা মাধ্যমে, ইংরেজি মাধ্যমে শিশু শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ‘নৈতিকতার’ ক্লাস থাকবে। এই ক্লাস সব ছাত্রের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। যেমন—অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি...। এই ক্লাসে সততার পাঠ দেওয়া হবে। যে পাঠ ভালোমন্দ চেনাবে। দেশপ্রেমের বীজ বপন করে দেবে। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধের দৃষ্টি খুলে দেবে। নিজের কাজে ফাঁকি না মারতে শেখাবে। এই ক্লাসের শিক্ষায় আধুনিক ফ্ল্যাটে অসুস্থ বৃদ্ধ মা-বাবাকে বেমানান মনে হবে না। মা-বাবার দায়িত্ব নিয়ে ভাইবোনের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হবে না। মা-বাবার চোখে ভাইবোন আলাদা হবে না। যে শিক্ষা শুধু নম্বর পেতে শেখায় আর আত্মকেন্দ্রিক হতে শেখায়, সেই শিক্ষাকে এই নৈতিকতার ক্লাস দেবে ধিক্কার।
স্বপ্ন দেখি, ১০ বছর গুরুত্বের সঙ্গে এই পাঠ কোনো শিশু যদি নেওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে আলাদা করে হয়তো আর বলতে হবে না—মাদক নিয়ো না, রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত কোরো না, বন্ধুত্বের নামে প্রতারণা কোরো না, নির্যাতন কোরো না, ভিন্নমত থাকতেই পারে কিন্তু নৃশংস হয়ো না। ওর শিক্ষাই ওকে পথ দেখাবে।
হ্যাঁ, স্বপ্নেরা ভালোই ডালপালা মেলেছে। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা নয়। কিন্তু কিছু পরিবর্তন তো হবে।
প্রতিবার বছর শেষে আমরা সংবাদপত্রের পাতায় হিসাব কষি—কী পেলাম, কী পেলাম না। আনন্দ-বেদনায় বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো তুলে আনি। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রুমানা মঞ্জুর, ভিকারুননিসার ছাত্রী নির্যাতন, নরসিংদীর হাওয়া আক্তারের আঙুল কেটে ফেলা ইত্যাদি ঘটনার পাশাপাশি এসেছে নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন এবং সেলিনা হায়াৎ আইভী, মেয়েদের ক্রিকেটে সাফল্য, ওয়াসফিয়া নাজরীনের কিলিমানজারো ও অ্যাকোনকাগুয়া বিজয়, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু কিছু বিষয়ে অপ্রাপ্তি ঘুরপাকখায় একই বিন্দুতে। যেমন—নারীনীতি এবং সিডও সনদের বাস্তবায়ন।
স্বপ্নের যেমন ডালপালা থাকে তেমনি স্বপ্নের আবার লিঙ্গবৈষম্য থাকে না। তাই একটা কথা বলি। স্বপ্ন দেখি, নতুন বছরে আধা ঘণ্টায় একজন কর্মজীবী মানুষ ঢাকা উত্তর থেকে ঢাকা দক্ষিণে আসবেন। ১৮-১৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ঈদের ছুটিতে লাগে ১৫ মিনিট। ব্যস্ত দিনে তা দ্বিগুণ হোক, তাই বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা? কর্মজীবী মানুষটি যেন দ্রুত কোনো না কোনো গণপরিবহন ব্যবহার করে কর্মস্থলে চলে আসতে পারেন। তাতে বাঁচবে সময়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সে সময় ভাগ হয়ে যাবে পেশায়, পরিবারে, আত্ম-উন্নয়নে, সমাজে...। আর এখন যেটার সবচেয়ে বড় অভাব—পাওয়া যাবে নিজের জন্য একটু আলাদা সময়। যানজটে অস্থির ঢাকার কর্মজীবী মানুষটির এখন তো সেই ছোটবেলায় পড়া কবিতার মৌমাছি, পিপীলিকা আর ছোটপাখির জীবন। ‘...দাঁড়াবার সময় তো নাই।’ হয়তো ছাত্রজীবনে পড়া বইটা আরেকবার পড়তে চাই, ভালো লাগা সিনেমাটা আরেকবার দেখতে চাই, অসুখ-বিসুখ ছাড়াও গুরুজনকে সঙ্গ দিতে চাই, কোনো কারণ ছাড়াই দুদণ্ড জিরিয়ে ভাবতে চাই—স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের কথা। সেই স্বপ্নও কি ভঙ্গ হবে?
লেখক: সাংবাদিক।
জানি, বাস্তব বিবেচনা বলে, ২০১২ সালের অলিম্পিক গেমসে এমন ঘটনা ঘটবে না। ঘটার কোনো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিতই হয়নি। কিন্তু এ কথা ঠিক, ২০১০ সালে কি আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমাদের মেয়েরা ২০১১-তে ক্রিকেটে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়ে যাবে? ক্রিকেট নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেন, খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা ছাড়া আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এর আগে কি সালমা খাতুন কিংবা সালমা বাহিনীর খবর জানত?
খুলনার একটি মেয়ে। বাবা নেই। অভাব নিত্যসঙ্গী। বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনা হলো না। সেই মেয়েটির নেতৃত্বে যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মেয়েরা শার্টের ওপর টাই পরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আলোকচিত্রীদের পোজ দেন এবং প্রথম আলোর খেলার পাতায় তা ছাপা হয় এ-মাথা থেকে ও-মাথা, তখন আশা জাগে নতুন করে। তবে প্রশ্নও জাগে, সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই মেয়েগুলোর জন্য আমরা সঠিক পরিচর্যা করছি তো? যে দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়েটিও বিকেলবেলা মাঠে গিয়ে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, সে দেশে সালমাদের এই অর্জন আমরা ভুলে যাব না তো? জীবনের বাস্তবতা ওদের খেলা থেকে দূরে নিয়ে যাবে না তো? এই দলের এক খেলোয়াড়ের মাকে প্রথম আলোর সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি ওর বিয়ে হয়ে যায়, বিয়ের পরও ও খেলবে তো? মা বলেছিলেন, ‘স্বামী দিলে খেলবে, না হলে খেলবে না।’
স্বপ্ন দেখি, এ দেশের মেয়েরা যে যে কাজই করুক না কেন, মাঝপথে তা থেমে যাবে না।
পৃথিবীর প্রতাপশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সেই দেশে গিয়ে এক মার্কিন কন্যার সঙ্গে পরিচয়। পেশায় সাংবাদিক। অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) মতো নামকরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যোগ দিয়েছেন আঞ্চলিক পত্রিকায়। কারণ কী? বলছিলেন, ‘ছোট্ট বাচ্চাটার জন্য। এপিতে শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র নেই। এই আঞ্চলিক পত্রিকাটিতে এ ব্যবস্থা দারুণ। সকালবেলা বাচ্চাকে ওদের কাছে রেখে নিশ্চিন্তে ছুটে বেড়াই সংবাদের পেছনে। তারপর ওকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরি। ওর জন্যই চাকরি বদল।’
বুঝুন এবার। বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীকে এখনো নির্ভর করতে হয় মা-শাশুড়ি কিংবা গৃহকর্মীর ওপর। যৌথ পরিবার ভেঙে এখন একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে শহরে। সব কর্মজীবী নারী মা-শাশুড়ির কাছাকাছি থাকতে পারেন না। খুব সৌভাগ্যবান নারীটি নির্ভরযোগ্য গৃহকর্মীর কাছে সন্তান রেখে নিশ্চিন্ত মনে কাজে যেতে পারেন।
স্বপ্ন দেখি, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নির্ভরযোগ্য শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র থাকবে। ঢাকার মহাখালীতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) কর্মীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের শিশু দিবাযত্নকেন্দ্রই ইঙ্গিত দেয়, এই প্রতিষ্ঠানে নারীকর্মীর সংখ্যা কত বেশি এবং তাঁরা যতক্ষণ কর্মক্ষেত্রে থাকেন, ততক্ষণ তাঁদের মেধা-শ্রম দিয়ে কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন। সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা তাঁদের নিত্যসঙ্গী নয়। ২০১২-তেই এই স্বপ্ন পূরণ হবে, তা নয়। অন্তত এই উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিষ্ঠানে। একদিকে বলা হতো, শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ান, অন্যদিকে মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস। পরস্পরবিরোধী। সে জায়গা থেকে আমাদের পরিবর্তন এসেছে। সরকার মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করেছে। পরিবর্তন তো হয়। তাহলে স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়?
স্বপ্ন দেখি, প্রতিটি বিদ্যালয়ে—শহরে-গ্রামে, বাংলা মাধ্যমে, ইংরেজি মাধ্যমে শিশু শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ‘নৈতিকতার’ ক্লাস থাকবে। এই ক্লাস সব ছাত্রের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। যেমন—অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি...। এই ক্লাসে সততার পাঠ দেওয়া হবে। যে পাঠ ভালোমন্দ চেনাবে। দেশপ্রেমের বীজ বপন করে দেবে। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধের দৃষ্টি খুলে দেবে। নিজের কাজে ফাঁকি না মারতে শেখাবে। এই ক্লাসের শিক্ষায় আধুনিক ফ্ল্যাটে অসুস্থ বৃদ্ধ মা-বাবাকে বেমানান মনে হবে না। মা-বাবার দায়িত্ব নিয়ে ভাইবোনের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হবে না। মা-বাবার চোখে ভাইবোন আলাদা হবে না। যে শিক্ষা শুধু নম্বর পেতে শেখায় আর আত্মকেন্দ্রিক হতে শেখায়, সেই শিক্ষাকে এই নৈতিকতার ক্লাস দেবে ধিক্কার।
স্বপ্ন দেখি, ১০ বছর গুরুত্বের সঙ্গে এই পাঠ কোনো শিশু যদি নেওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে আলাদা করে হয়তো আর বলতে হবে না—মাদক নিয়ো না, রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত কোরো না, বন্ধুত্বের নামে প্রতারণা কোরো না, নির্যাতন কোরো না, ভিন্নমত থাকতেই পারে কিন্তু নৃশংস হয়ো না। ওর শিক্ষাই ওকে পথ দেখাবে।
হ্যাঁ, স্বপ্নেরা ভালোই ডালপালা মেলেছে। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা নয়। কিন্তু কিছু পরিবর্তন তো হবে।
প্রতিবার বছর শেষে আমরা সংবাদপত্রের পাতায় হিসাব কষি—কী পেলাম, কী পেলাম না। আনন্দ-বেদনায় বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো তুলে আনি। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রুমানা মঞ্জুর, ভিকারুননিসার ছাত্রী নির্যাতন, নরসিংদীর হাওয়া আক্তারের আঙুল কেটে ফেলা ইত্যাদি ঘটনার পাশাপাশি এসেছে নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন এবং সেলিনা হায়াৎ আইভী, মেয়েদের ক্রিকেটে সাফল্য, ওয়াসফিয়া নাজরীনের কিলিমানজারো ও অ্যাকোনকাগুয়া বিজয়, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু কিছু বিষয়ে অপ্রাপ্তি ঘুরপাকখায় একই বিন্দুতে। যেমন—নারীনীতি এবং সিডও সনদের বাস্তবায়ন।
স্বপ্নের যেমন ডালপালা থাকে তেমনি স্বপ্নের আবার লিঙ্গবৈষম্য থাকে না। তাই একটা কথা বলি। স্বপ্ন দেখি, নতুন বছরে আধা ঘণ্টায় একজন কর্মজীবী মানুষ ঢাকা উত্তর থেকে ঢাকা দক্ষিণে আসবেন। ১৮-১৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ঈদের ছুটিতে লাগে ১৫ মিনিট। ব্যস্ত দিনে তা দ্বিগুণ হোক, তাই বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা? কর্মজীবী মানুষটি যেন দ্রুত কোনো না কোনো গণপরিবহন ব্যবহার করে কর্মস্থলে চলে আসতে পারেন। তাতে বাঁচবে সময়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সে সময় ভাগ হয়ে যাবে পেশায়, পরিবারে, আত্ম-উন্নয়নে, সমাজে...। আর এখন যেটার সবচেয়ে বড় অভাব—পাওয়া যাবে নিজের জন্য একটু আলাদা সময়। যানজটে অস্থির ঢাকার কর্মজীবী মানুষটির এখন তো সেই ছোটবেলায় পড়া কবিতার মৌমাছি, পিপীলিকা আর ছোটপাখির জীবন। ‘...দাঁড়াবার সময় তো নাই।’ হয়তো ছাত্রজীবনে পড়া বইটা আরেকবার পড়তে চাই, ভালো লাগা সিনেমাটা আরেকবার দেখতে চাই, অসুখ-বিসুখ ছাড়াও গুরুজনকে সঙ্গ দিতে চাই, কোনো কারণ ছাড়াই দুদণ্ড জিরিয়ে ভাবতে চাই—স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের কথা। সেই স্বপ্নও কি ভঙ্গ হবে?
লেখক: সাংবাদিক।
No comments