লঞ্চ বাস ট্রেনের ছাদ মানুষে ঠাসা, পথে পথে ভোগান্তি- ঈদে ঘরে ফেরা by রাজন ভট্টাচার্য

নগরীর টার্মিনালগুলো মানুষে মানুষে ঠাসা। বাস-ট্রেন-লঞ্চে মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ। ট্রেনের ছাদে যাত্রী যাবে না, যোগাযোগমন্ত্রীর এমন নির্দেশ উপেক্ষা করে বুধবার ট্রেনের ছাদ থেকে শুরু করে ইঞ্জিনসহ বাম্পারে ঝুলে দূর-দূরান্তে ছুটে চলেছে মানুষ। লঞ্চের চিত্রও একই।


কোথাও ঠাঁই নেই। একদিকে যেমন বাড়ি ফেরার সংগ্রাম তেমনি পথে-পথে যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। আধাঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন বিলম্বে ছাড়ছে। বাসের সিডিউলও ঠিক নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট। বাসে নেয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। বিআরটিএ’র অভিযোগ কেন্দ্রে লোক নেই। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশের পরও মেরামত হয়নি সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী সড়ক। নানা অভিযোগে রেলওয়ের চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
রেলের চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ॥ অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে রেলের আসন বিক্রির অভিযোগে এ্যাটেনন্ডেন্ট নিজাম উদ্দীনকে রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বুধবার সকালে কমলাপুর রেলস্টেশন পরিদর্শনের সময় অভিযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিজামকে বরখাস্তের এই নির্দেশ দেন মন্ত্রী। এছাড়া পরিদর্শনের সময় একটি ট্রেনের লাইট ও ফ্যান নষ্ট থাকায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী সাবা উদ্দীনকে কারণ দর্শানোর এবং বদলির নির্দেশ দেন ওবায়দুল কাদের। পরে এ ঘটনায় রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বৈঠকে সিনিয়র সাব এ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (ফোন/লাইট) আমিনুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত এবং রেলওয়ের ঢাকা অঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলী অজয় কুমার পোদ্দারকে কারণ দর্শাতে বলা হয়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, মন্ত্রীর নির্দেশে রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহেরের সভাপতিত্বে এক সভায় এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
কষ্ট হবেইÑ রেলমন্ত্রী
মঙ্গলবারের মতো বুধবার সকালে ঝটিকা সফরে কমলাপুর রেলস্টেশনে যান মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তখন প্ল্যাটফর্মজুড়ে হাজারো ঘরমুখো মানুষের ভিড়। এ সময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ঈদের আগেই বন্ধের দিন পড়ে গেছে বেশি। সবাই একসঙ্গে বাড়ি যেতে চায়। এজন্য একটু তো কষ্ট হবেই। এ সময় তিনি স্টেশনের বিভিন্ন টিকেট কাউন্টার ঘুরে টিকেট বিক্রয় ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। পরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা এগারসিন্দুর ও মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেসের বিভিন্ন বগি ঘুরে দেখেন ও যাত্রীদের খোঁজখবর নেন। একই সঙ্গে তিনি টিকেট ছাড়া যাত্রীদের চিহ্নিত করেন। তবে রেলের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। পরিদর্শনকালে তাঁর সঙ্গে ছিলেন রেলওয়ের উর্ধতন কর্মকর্তা, পুলিশ, আনসারসহ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
মন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকর হয়নি
ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের ছাদে কিংবা ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরা নিষিদ্ধ করেছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী। এবার ঈদের আগে দীর্ঘ ছুটি হওয়ায় এতদিন ট্রেনের ছাদে যাত্রী পরিবহনের দৃশ্য চোখে পড়েনি। কিন্তু বুধবারের চিত্র দেখা গেছে ভিন্ন। ট্রেনের ছাদ থেকে শুরু করে, ইঞ্জিন, ক্যান্টিন, কামরার জোড়া, বাম্পারসহ সবখানেই মানুষ আর মানুষ। অনেকে টিকেট কেটেও বসার সুযোগ পাননি। কেউ কেউ ভিড়ে ট্রেনে উঠতে না পেরে বাড়ি ফিরে গেছেন। তাঁরা জানান, ভেতরে প্রবেশের সুযোগ মেলেনি। বাধ্য হয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছেন। নারী, পুরুষ, শিশুসহ সব বয়সের মানুষকে ছাদে উঠতে দেখা গেছে। রেলওয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কেউ ঝুঁকি নিয়ে চলা মানুষদের বাধা দেয়নি। কমলাপুর, গাজীপুর, বনানী, টঙ্গী রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। নাড়ির টানের কাছে মৃত্যুঝুঁকি যেন কোন বাধাই নয়।

ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় কাটেনি
ট্রেনে সিডিউল বিপর্যয় কাটেনি। যদিও ঈদ যাত্রা শুরুর আগেভাগেই রেলমন্ত্রী সিডিউল ঠিক রাখতে পারবেন না একথা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন। বাস্তবে হলোও তাই। মঙ্গলবার ট্রেনের অগ্রিম টিকেট দিয়ে একটি ট্রেন ছাড়েনি। এ কারণে হাজারো যাত্রীর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বুধবার বেশিরভাগ ট্রেন আধাঘণ্টা থেকে ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে ছাড়ে। এজন্য স্টেশন ম্যানেজার খায়রুল বাশার সাংবাদিকদের বলেন, ট্রেন আসতে বিলম্ব হওয়ার কারণে ছাড়তেও বিলম্ব হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে আসার পর যাত্রী ওঠানামা ও ইঞ্জিন যুক্ত করতে যতটুকু সময় লাগে। এরপর ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে। বুধবার সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে একটি ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ট্রেনটি সকাল নয়টার পরে প্ল্যাটফর্মে আসে। চট্টলা এক্সপ্রেস টেনটি সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও দুপুর ২টা পর্যন্ত ট্রেনটি কমলাপুরে এসে পৌঁছেনি। তুরাগ এক্সপ্রেস, রাজশাহীর সিল্কসিটি, চট্টগ্রামের সুবর্ণ এক্সপ্রেস, যমুনা, মহানগর প্রভাতিসহ আরও বেশ কয়েকটি ট্রেন সময়মতো ছাড়তে পারেনি। ট্রেন বিলম্বিত হওয়ার কারণে যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে।
সময়মতো ছাড়েনি বাস
প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটাতে মানুষ এখন ঘরমুখো। এজন্য বুধবার ভোর থেকেই গাবতলী বাস টার্মিনালে মানুষের ঢল নামে। কিন্তু এখানেও নানা বিড়ম্বনা। সময়মতো বাস আসেনি। তাই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে যাত্রীদের। কাউন্টার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ফেরিঘাটে যানজটের কারণে সময়মতো বাস আসেনি। আসামাত্রই গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে বলে জানান তাঁরা।
এছাড়া ভোর থেকে যাত্রী ভিড় হওয়ার কারণে গাবতলীতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সব রুটের বাস নির্দিষ্ট সময়ের আধাঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা পরে ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। অনেকে টিকেট না পেয়ে সকাল থেকেই কাউন্টারে কাউন্টারে ঘুরছিলেন।
বিআরটিএতে অভিযোগ কেন্দ্রে কেউ নেই। এবারের ঈদের বিভিন্ন রুটে বাসের বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। যাত্রীদের এই অভিযোগ স্বীকারও করেছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অনেকে। তাদের যুক্তি, যাত্রী নিয়ে বেশিরভাগ বাস খালি ফিরছে। এজন্য নামমাত্র বাড়তি ভাড়া যুক্ত করা হয়েছে। বুধবার রাজধানীর মহাখালী, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘুরে বাড়তি ভাড়া আদায়ের চিত্র দেখা গেছে।
গাবতলী থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত হানিফ পরিবহনের টিকেটের দাম সাড়ে ৪০০ টাকা হলেও ঈদ উপলক্ষে ৬৪০ টাকা নেয়া হচ্ছে। বরিশালগামী যাত্রী বিপ্লব অভিযোগ করলেন, সারা রাত অপেক্ষার পর বুধবার সকাল ৭টা ১০ মিনিটে সুবর্ণ পরিবহনের একটি টিকেট পেয়েছেন সাড়ে ৩শ’ টাকা দিয়ে। কিন্তু বাসে উঠতে গেলে তার কাছে অতিরিক্ত আরও ৩শ’ টাকা দাবি করা হয়। গাবতলী পুলিশ কন্ট্রোল রুমের নায়েক মুজিবুর রহমান বলেন, তাঁদের কাছে এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ আসেনি। কোন ধরনের বিশৃঙ্খল ঘটনাও ঘটেনি। মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, শেরপুরগামী ড্রিমল্যান্ড স্পেশাল, সাধারণ ড্রিমল্যান্ড, নেত্রকোনাগামী শাহজালাল পরিবহন, জামালপুর, পাবনাগামী বিভিন্ন পরিবহনের বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে চট্টগ্রাম, বরগুনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন রুটের বাস থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। এদিকে মহাখালী এলাকায় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) পক্ষ থেকে অভিযোগ কেন্দ্র খোলা হলেও এতে কোন লোক দেখা যায়নি। পরিবহন মালিকরা বলছেন, ঈদ ব্যবস্থাপনার জন্য বিআরটিএ, মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের সমন্বয়ে অভিযোগ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যেখানে যাত্রীরা যে কোন অভিযোগ ও সমস্যার কথা জানাতে পারবেন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইল মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ইলিয়টগজ্ঞ এলাকায় একটি কাভার্ড ভ্যান উল্টে যানজটের সৃষ্টি হয়। দুপুরের পর লরিটি সরানো হয়। যানজটের কারণে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় রাস্তায় আটকে থাকতে হয়। দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এদিকে যমুনা সেতু এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনার পর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট দেখা দেয়।

No comments

Powered by Blogger.