প্রতিবেশী-ভারতের রাজনীতিতে কয়লা ও ময়লা by শেখর গুপ্ত
কয়লা দুর্নীতি সম্পর্কে সিএজি রিপোর্ট গোটা পরিস্থিতিকেই পাল্টে দিয়েছে বলে বিজেপি বিশ্বাস করে। কয়লা মন্ত্রণালয়টি সবসময়ই কংগ্রেসের দখলে ছিল। লম্বা সময়ের জন্য এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত ছিল। যে দু'জন প্রতিমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয় সামলেছেন সেই সন্তোষ বাগরোদিয়া ও দশারি নারায়ণ
রাও কংগ্রেসেরই না, দুর্নীতির ইস্যুটি বিজেপির হাতছাড়া হয়ে যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন বলেই তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন_ তারা এমনটা ভাবার মতো অতটা বোকা ও নির্বোধ নয়।
কে কী ভাবল এর চেয়ে বড় কথা বিষয়টি নিয়ে বিজেপি এভাবেই চিন্তা করছে। তারা মনে করে এই কয়লা কেলেঙ্কারির ইস্যুটি তাদের জন্য বোফোর্স কেলেঙ্কারির মতো বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ২০০৪ সালের পর এই প্রথম একটি দুর্নীতির ইস্যু বিজেপি পেল, যেটির সঙ্গে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত জড়িয়ে ফেলা যায়। তাদের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সবক'টি দুর্নীতির অভিযোগের তীর কংগ্রেস তাদের দিক থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং এসব ব্যর্থতার দায় বিড়ম্বনাকর জোট মিত্রদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। টুজি দুর্নীতির দায় চেপেছে ডিএমকের ওপর। এ রাজা ও কানিমোঝিকে জেলে পাঠিয়ে কংগ্রেস জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দায় আরেক জোটসঙ্গী শারদ পাওয়ারের ওপর চাপানো হয়েছে। এমনকি কংগ্রেসের মন্ত্রী পি চিদাম্বরমের নেতৃত্বাধীন ইজিওএম এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সত্ত্বেও এ ঘটনার দায় পড়ে শেষ পর্যন্ত প্রফুল প্যাটেলের ওপর। অর্থনৈতিক সংস্কারের দায় স্বাভাবিক সন্দেহভাজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাড়ে চাপে। বিজেপির এক শীর্ষ নেতা কংগ্রেসের সব উত্থাপিত অভিযোগ থেকে দায়মুক্তির বিষয় সংক্ষেপে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তারা এ জন্য তিন পয়েন্ট ফর্মুলা প্রয়োগ করে। এগুলো হলো_ প্রধানমন্ত্রী ইমানদার, জোট সঙ্গীরা বেইমান, আর জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতা। এই কৌশল প্রয়োগ করে কংগ্রেস অভিযোগগুলো থেকে আরামসে নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলতে সক্ষম হয় বলে বিজেপির শীর্ষ নেতা উল্লেখ করেন।
তবে কয়লা দুর্নীতি সম্পর্কে সিএজি রিপোর্ট গোটা পরিস্থিতিকেই পাল্টে দিয়েছে বলে বিজেপি বিশ্বাস করে। কয়লা মন্ত্রণালয়টি সবসময়ই কংগ্রেসের দখলে ছিল। লম্বা সময়ের জন্য এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত ছিল। যে দু'জন প্রতিমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয় সামলেছেন সেই সন্তোষ বাগরোদিয়া ও দশারি নারায়ণ রাও কংগ্রেসেরই। সুতরাং, এই মন্ত্রণালয়ের দায় অন্য কারও ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ধোয়া তুলসী পাতা প্রমাণের সুযোগ নেই কংগ্রেসের। কয়লা নিয়ে নগদ অর্থের লেনদেন হয়েছে বলে বিজেপি মনে করে। অ্যালটমেন্ট পেপার বেচা-কেনা ও স্লিপ বাণিজ্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অফিস সরাসরি জড়িত বলেও তাদের বিশ্বাস।
এবার তোপ দাগা হতে পারে প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী সমালোচনায় সহজে আহত হন বলে তাকে সমালোচনার যথার্থ টার্গেট হিসেবে দেখা হয়। তাহলে কেন তাকে সংসদে এসব অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না, যেখানে বিজেপির প্রতিষ্ঠিত নেতারা তাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করার সুযোগ পেতেন?
আসলে বিজেপি মনে করে, সংসদে আলোচনা হলে বিষয়টি ওখানেই হালকা হয়ে যেত। সংসদে এ বিষয়ের ওপর সাধারণ আলোচনা বা মুলতবি প্রস্তাবের ওপর আলোচনা_ যেটাই হোক না কেন সরকার আবার তাদের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মহড়া দেওয়া ও স্থিতিশীলতার প্রশ্ন এনে বিজেপিকে ঘায়েল করার সুযোগ পেয়ে যেত। সেখানে সরকারি বা যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্ত পর্যন্ত গিয়ে বিষয়টি শেষ হয়ে যেত। এতে বিষয়টি নিয়ে বিজেপির কংগ্রেসবিরোধী প্রচার চালানোর সুযোগ থাকত না। বিজেপি এই দুর্নীতি নিয়ে প্রচারে নামবে। তারা এ জন্যই এবারের সংসদ অধিবেশন কয়লা দুর্নীতির ঘটনা সামনে নিয়ে শেষ হোক তা চায়। এমনকি, বিজেপির অপেক্ষাকৃত কম যুদ্ধংদেহী নেতারাও এ বিষয়ে সংসদে আলোচনায় ইতিবাচক ফলের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কয়লা দুর্নীতির ইস্যুটি বিজেপির কাছে এখন মহামূল্যবান। তারা ইস্যুটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে এমন কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। তারা এ ব্যাপারে টুজি কাণ্ড নিয়ে ২০১০ সালে তাদের যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতাটি সামনে রেখেছেন।
এ নিয়ে বারবার সংসদের কার্যক্রম ব্যাহত করার ঘটনাটিতে জনমত বিজেপির বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। তার পরিণতিতে অ্যাকশন হয়েছিল। তখন সিএজি প্রাক্কলন করেছিল যে, টুজি দুর্নীতির কারণে এক লাখ ৭৬ হাজার কোটি রুপি লোকসান হয়েছিল। এতে রাজা ও অন্যদের জেল হয়েছিল। কংগ্রেসের পি চিদাম্বরম শেষ পর্যন্ত চরম দুর্দশাগ্রস্ত না হলেও তাকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে হয়েছিল। আর একটি পার্লামেন্ট সেশনের মাধ্যমে কয়লা দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে একই ফল মিললে ক্ষতি কি? আসলে এখানে সময়টা গুরুত্বপূর্ণ কি-না। এই দুর্নীতির ঘটনার ফলাফল পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। নির্বাচন ২০১৪ সালে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও মমতা ও মুলায়ম সিং তাদের ক্ষতি কমিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিলে ২০১৩ সালের মার্চেই জাতীয় নির্বাচন হয়ে যেতে পারে বলে বিজেপি নেতারা মনে করেন। তারাও আগাম নির্বাচন চান। তারা মনে করেন, ইউপিএ এখন নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তারা এখনি ইউপিএ নেতৃত্বের ওপর আক্রমণ শানাতে পারলে সরকার ভেঙে পড়বে। তারা সমসাময়িক কয়েকটি জনমত জরিপের ফলাফলেও উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এসব জরিপে দেখানো হয়েছে, কংগ্রেসের অবস্থান নেমে যাচ্ছে আর বিজেপি কমসংখ্যক দলের জোট নিয়েই এগিয়ে রয়েছে।
তাহলে নির্বাচন নিয়ে বিজেপির এত তাড়াহুড়া কেন? ২০১৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা নয় কেন? বিজেপি যদি মনে করে থাকে যে, ইউপিএ একটি মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সরকার পরিচালনা করছে তাহলে ইউপিএকে নিজেকে ধ্বংসকারী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত সময় দেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে না কেন? এখানেই বিজেপির কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় এসে পড়ে। যেমন, ২০১৪ সালে নির্বাচন হলে তাদের (বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ) প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তার নাম আগেভাগে ঘোষণা করতে হবে। তখন বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির বয়স ৮৭তে গিয়ে পড়বে। স্বভাবত তাকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রার্থী করার ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন। সামনের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হলে অপেক্ষাকৃত কম বয়সের দুই মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শিবরাজ সিং চৌহান প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হতে পারেন। তখন বিজেপির শীর্ষ নেতাদের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার বিজেপির হাত থেকে তাদের আদর্শিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) হাতে চলে যেতে পারে। আর বোফোর্স কেলেঙ্কারির মতো পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে এসব জটিলতা অনায়াসে এড়ানো যাবে। তখন দুর্নীতিবাজ ইউপিএ সরকার হঠাও_ এ স্লোগান তুলেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সহজ হবে। প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় কর্মসূচি এবং একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়োজন পড়বে না।
বিজেপির এ ধরনের অনুমান, হাইপোথিসিস ও প্রত্যাশার সঙ্গে যে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। তারা যে সবকিছু হাওয়া থেকে বলছেন তা কিন্তু নয়। তারা মনে করেন কয়লা দুর্নীতি নিয়ে সিএজি রিপোর্ট ক্ষমতাকে প্রায় তাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে এবং এ নিয়ে তাদের যা করণীয় তা তারা শুরুও করে দিয়েছেন। এখন কংগ্রেস এর বিপরীতে কী চাল দেয় সেটাই দেখার বিষয়।
শেখর গুপ্ত : সম্পাদক, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাটি থেকে ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা
কে কী ভাবল এর চেয়ে বড় কথা বিষয়টি নিয়ে বিজেপি এভাবেই চিন্তা করছে। তারা মনে করে এই কয়লা কেলেঙ্কারির ইস্যুটি তাদের জন্য বোফোর্স কেলেঙ্কারির মতো বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ২০০৪ সালের পর এই প্রথম একটি দুর্নীতির ইস্যু বিজেপি পেল, যেটির সঙ্গে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত জড়িয়ে ফেলা যায়। তাদের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সবক'টি দুর্নীতির অভিযোগের তীর কংগ্রেস তাদের দিক থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং এসব ব্যর্থতার দায় বিড়ম্বনাকর জোট মিত্রদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। টুজি দুর্নীতির দায় চেপেছে ডিএমকের ওপর। এ রাজা ও কানিমোঝিকে জেলে পাঠিয়ে কংগ্রেস জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দায় আরেক জোটসঙ্গী শারদ পাওয়ারের ওপর চাপানো হয়েছে। এমনকি কংগ্রেসের মন্ত্রী পি চিদাম্বরমের নেতৃত্বাধীন ইজিওএম এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সত্ত্বেও এ ঘটনার দায় পড়ে শেষ পর্যন্ত প্রফুল প্যাটেলের ওপর। অর্থনৈতিক সংস্কারের দায় স্বাভাবিক সন্দেহভাজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাড়ে চাপে। বিজেপির এক শীর্ষ নেতা কংগ্রেসের সব উত্থাপিত অভিযোগ থেকে দায়মুক্তির বিষয় সংক্ষেপে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তারা এ জন্য তিন পয়েন্ট ফর্মুলা প্রয়োগ করে। এগুলো হলো_ প্রধানমন্ত্রী ইমানদার, জোট সঙ্গীরা বেইমান, আর জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতা। এই কৌশল প্রয়োগ করে কংগ্রেস অভিযোগগুলো থেকে আরামসে নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলতে সক্ষম হয় বলে বিজেপির শীর্ষ নেতা উল্লেখ করেন।
তবে কয়লা দুর্নীতি সম্পর্কে সিএজি রিপোর্ট গোটা পরিস্থিতিকেই পাল্টে দিয়েছে বলে বিজেপি বিশ্বাস করে। কয়লা মন্ত্রণালয়টি সবসময়ই কংগ্রেসের দখলে ছিল। লম্বা সময়ের জন্য এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত ছিল। যে দু'জন প্রতিমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয় সামলেছেন সেই সন্তোষ বাগরোদিয়া ও দশারি নারায়ণ রাও কংগ্রেসেরই। সুতরাং, এই মন্ত্রণালয়ের দায় অন্য কারও ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ধোয়া তুলসী পাতা প্রমাণের সুযোগ নেই কংগ্রেসের। কয়লা নিয়ে নগদ অর্থের লেনদেন হয়েছে বলে বিজেপি মনে করে। অ্যালটমেন্ট পেপার বেচা-কেনা ও স্লিপ বাণিজ্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অফিস সরাসরি জড়িত বলেও তাদের বিশ্বাস।
এবার তোপ দাগা হতে পারে প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী সমালোচনায় সহজে আহত হন বলে তাকে সমালোচনার যথার্থ টার্গেট হিসেবে দেখা হয়। তাহলে কেন তাকে সংসদে এসব অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না, যেখানে বিজেপির প্রতিষ্ঠিত নেতারা তাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করার সুযোগ পেতেন?
আসলে বিজেপি মনে করে, সংসদে আলোচনা হলে বিষয়টি ওখানেই হালকা হয়ে যেত। সংসদে এ বিষয়ের ওপর সাধারণ আলোচনা বা মুলতবি প্রস্তাবের ওপর আলোচনা_ যেটাই হোক না কেন সরকার আবার তাদের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মহড়া দেওয়া ও স্থিতিশীলতার প্রশ্ন এনে বিজেপিকে ঘায়েল করার সুযোগ পেয়ে যেত। সেখানে সরকারি বা যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্ত পর্যন্ত গিয়ে বিষয়টি শেষ হয়ে যেত। এতে বিষয়টি নিয়ে বিজেপির কংগ্রেসবিরোধী প্রচার চালানোর সুযোগ থাকত না। বিজেপি এই দুর্নীতি নিয়ে প্রচারে নামবে। তারা এ জন্যই এবারের সংসদ অধিবেশন কয়লা দুর্নীতির ঘটনা সামনে নিয়ে শেষ হোক তা চায়। এমনকি, বিজেপির অপেক্ষাকৃত কম যুদ্ধংদেহী নেতারাও এ বিষয়ে সংসদে আলোচনায় ইতিবাচক ফলের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কয়লা দুর্নীতির ইস্যুটি বিজেপির কাছে এখন মহামূল্যবান। তারা ইস্যুটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে এমন কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। তারা এ ব্যাপারে টুজি কাণ্ড নিয়ে ২০১০ সালে তাদের যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতাটি সামনে রেখেছেন।
এ নিয়ে বারবার সংসদের কার্যক্রম ব্যাহত করার ঘটনাটিতে জনমত বিজেপির বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। তার পরিণতিতে অ্যাকশন হয়েছিল। তখন সিএজি প্রাক্কলন করেছিল যে, টুজি দুর্নীতির কারণে এক লাখ ৭৬ হাজার কোটি রুপি লোকসান হয়েছিল। এতে রাজা ও অন্যদের জেল হয়েছিল। কংগ্রেসের পি চিদাম্বরম শেষ পর্যন্ত চরম দুর্দশাগ্রস্ত না হলেও তাকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে হয়েছিল। আর একটি পার্লামেন্ট সেশনের মাধ্যমে কয়লা দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে একই ফল মিললে ক্ষতি কি? আসলে এখানে সময়টা গুরুত্বপূর্ণ কি-না। এই দুর্নীতির ঘটনার ফলাফল পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। নির্বাচন ২০১৪ সালে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও মমতা ও মুলায়ম সিং তাদের ক্ষতি কমিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিলে ২০১৩ সালের মার্চেই জাতীয় নির্বাচন হয়ে যেতে পারে বলে বিজেপি নেতারা মনে করেন। তারাও আগাম নির্বাচন চান। তারা মনে করেন, ইউপিএ এখন নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তারা এখনি ইউপিএ নেতৃত্বের ওপর আক্রমণ শানাতে পারলে সরকার ভেঙে পড়বে। তারা সমসাময়িক কয়েকটি জনমত জরিপের ফলাফলেও উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এসব জরিপে দেখানো হয়েছে, কংগ্রেসের অবস্থান নেমে যাচ্ছে আর বিজেপি কমসংখ্যক দলের জোট নিয়েই এগিয়ে রয়েছে।
তাহলে নির্বাচন নিয়ে বিজেপির এত তাড়াহুড়া কেন? ২০১৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা নয় কেন? বিজেপি যদি মনে করে থাকে যে, ইউপিএ একটি মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সরকার পরিচালনা করছে তাহলে ইউপিএকে নিজেকে ধ্বংসকারী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত সময় দেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে না কেন? এখানেই বিজেপির কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় এসে পড়ে। যেমন, ২০১৪ সালে নির্বাচন হলে তাদের (বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ) প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তার নাম আগেভাগে ঘোষণা করতে হবে। তখন বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির বয়স ৮৭তে গিয়ে পড়বে। স্বভাবত তাকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রার্থী করার ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন। সামনের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হলে অপেক্ষাকৃত কম বয়সের দুই মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শিবরাজ সিং চৌহান প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হতে পারেন। তখন বিজেপির শীর্ষ নেতাদের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার বিজেপির হাত থেকে তাদের আদর্শিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) হাতে চলে যেতে পারে। আর বোফোর্স কেলেঙ্কারির মতো পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে এসব জটিলতা অনায়াসে এড়ানো যাবে। তখন দুর্নীতিবাজ ইউপিএ সরকার হঠাও_ এ স্লোগান তুলেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সহজ হবে। প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় কর্মসূচি এবং একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়োজন পড়বে না।
বিজেপির এ ধরনের অনুমান, হাইপোথিসিস ও প্রত্যাশার সঙ্গে যে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। তারা যে সবকিছু হাওয়া থেকে বলছেন তা কিন্তু নয়। তারা মনে করেন কয়লা দুর্নীতি নিয়ে সিএজি রিপোর্ট ক্ষমতাকে প্রায় তাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে এবং এ নিয়ে তাদের যা করণীয় তা তারা শুরুও করে দিয়েছেন। এখন কংগ্রেস এর বিপরীতে কী চাল দেয় সেটাই দেখার বিষয়।
শেখর গুপ্ত : সম্পাদক, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাটি থেকে ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা
No comments