গোধূলির ছায়াপথে- আশি অতিক্রান্তদের নিয়ে স্বপ্ন-কথা by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

আশি অতিক্রান্ত হলে শরীরের ভাষা বলে দেয়: অনেক হলো, এবার আসি। সবাই নয়। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ড. খান সারওয়ার মুরশিদ , ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন—এ রকম যাঁরা আশি পেরিয়েছেন, তারুণ্যের আভা যেন সব সময়ই তাঁদের মুখাবয়বকে করছে বিভাসিত।


বৃদ্ধ না হলে মানুষ সুন্দর হয় না, কথাটি বোঝার জন্য উপস্থিত হই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, এবিএম মূসা, আতিকুল হক চৌধুরীর কাছে। মাঝেমধ্যে যেতাম সদ্য প্রয়াত ফয়েজ আহ্মদের কাছেও।
রাষ্ট্রপতি একদিন চা খেতে ডাকলেন। বললেন, ডেকেছি বিশেষ কাজে। আমি অবাক। কারণ, অভাজনের কাছে তাঁর কোনো কাজ থাকতেই পারে না। চা, ভালো বিস্কুট, কেক, ফল ও আমার স্ত্রীর জন্য মালয়েশিয়া থেকে নিয়ে আসা একটি উপহার, যাতে দুটি টাওয়ার বানিয়ে ওই দেশটি জগতের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। চা পান শেষে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাঁর দিকে তাকালাম।
বললেন, আপনার পিতা আব্বাসউদ্দীন সাহেবকে ভৈরববাজারে নিয়ে এসেছিলাম একজন তরুণ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, বহু বছর আগে। অল্প অনুরোধে গান গাইতে রাজি হন তিনি। ফুটবল খেলার মাঠে গানের অনুষ্ঠান, কয়েক হাজার লোক তাঁর গান শোনার জন্য উপস্থিত। সেই উদ্দীপনা এখনো আমার অনুভবে। অনেক রাত পর্যন্ত গান শোনার পর আমার বাসাতেই খাওয়া-দাওয়া ও রাতে শোবার ব্যবস্থা। সেদিন আমার মতো একজন তরুণ ব্যক্তির প্রতি তাঁর এই সহূদয়তা এখনো আমাকে অভিভূত করে। তাঁর এই স্মৃতিচারণা তাঁর মহত্ত্বের পরিচায়ক। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ছিলেন আমার গানের সমঝদার। কী মনে করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।
অনেক স্বপ্নের মধ্যে একটি: বঙ্গভবনের দরবার হলে পিতার একটি অয়েল পেইন্টিং। বাংলা সংগীতের প্রথম যুগের মানুষ ছিলেন তিনি। পেইন্টিংটি হতে হবে মুস্তাফা মনোয়ারের আঁকা, আমার পছন্দসই। কারণ, বেশির ভাগ পেইন্টিং দায়সারা। একদা ঢাকা রোটারি ক্লাবের সভাপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন, এরপর আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও পরে রমনা মাঠে একসঙ্গে যাঁর সঙ্গে হাঁটতাম, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আরেক রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। স্বপ্নের কথাটা কাউকেই বলা হয়নি। এরপর রব উঠল জাস্টিস মোস্তাফা কামাল ওই বাসায় উঠে আসবেন। ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ভাতিজা নাশিদ কামালকে খবরটি জানিয়েছিলেন। ভাবলাম, তাঁর একমাত্র ভাই হিসেবে বাইরের কোনো একটি ঘরে তানপুরা নিয়ে গলা সাধার জন্য হয়তো একটি ঘর বরাদ্দ পেয়ে যাব। না, তিনি রাষ্ট্রপতি হননি। সব স্বপ্ন কি সফল হয়? আমরা গত হলে কবি জসীমউদ্দীনের ছবির পাশে হয়তো পিতার ছবিটি স্থান পাবে। ছবির জসীমউদ্দীন বলে উঠবেন, আব্বাস, এত দিনে এলে হে বন্ধু?
বাংলাদেশের আশি অতিক্রান্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত কি না জানা নেই। গুলশান ক্লাবে শাহনাজ রহমতউল্লার গান হচ্ছে। একটু পরে গাইবেন সৈয়দ আব্দুল হাদী, পরে সাবিনা ইয়াসমীন। পাশেই জেনারেল এরশাদ, আরেকজন আশির ওধারের স্মার্ট ব্যক্তি, সাবিনার ভক্ত। তুলনামূলক আলোচনায় বললাম, শাহনাজের কণ্ঠে এমন কিছু আছে, যা কারও মধ্যে নেই। যেন একটু আগে তার কণ্ঠে বসন্ত এসেছে এবং সেই বসন্তে একটি কোকিল পাখি এসে আশ্রয় নিয়েছে। যত ওপরে যাবে তত মিষ্টি হবে তার পরিবেশনা, আর যখন শেষ হয়ে যাবে তখন মনে হবে সমগ্র পৃথিবী থেকে বসন্ত বিদায় নিয়েছে। শাহনাজ ছোট বোনের মতোই। সে ঘোষণা দিয়েছে যে আর কোনো অনুষ্ঠানে সে গান গাইবে না। অর্থাৎ বসন্ত বিদায় নেবে চিরদিনের জন্য। এরশাদ বললেন, আপনি হয়তো গান ভালো বোঝেন, কিন্তু আমার ভালো লাগে সৈয়দ আব্দুল হাদীকে। তাঁর কণ্ঠে বাংলাদেশের সমস্ত রোমান্টিকতা এসে আশ্রয় নেয়।
ঈদের দিনে আজাদ মসজিদের সামনে দেখা তোয়াব খানের সঙ্গে। বললাম, আশির কত দেরি? বললেন, তোমার ভাই আর আমার একই সময়ে। বললেন, তোমার লেখা অন্য কাগজে পড়ি। জনকণ্ঠ অপছন্দ? বললাম, যারা আমার লেখা ভালোবাসে, ঘুরে ঘুরে খুঁজে বের করে। তাঁর দাদা মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মওলানা আকরম খাঁর স্মৃতিচারণা করি এই সুযোগে। আকরম খাঁ সাহেব বসে আছেন আজাদ অফিসের সামনের লনে। তখনই বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। বললাম, আপনার কাগজে কাজ খুঁজছি।
: কী কাজ?
: বাংলাদেশের অপরিচিত লোককবিদের নিয়ে ১০টি রচনা।
: সেটি বহুদিন ধরেই করছেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন। এ ছাড়া, আবদুর রশিদ ওয়াসেকপুরি ও অদ্বৈত মল্লবর্মণ করেছে। কাজটি কি এনেছ?
১০টি রচনা তাঁর হাতে দিতেই চমকে উঠলেন তিনি। খুশি হলেন। বললেন, এদের নামই তো শুনিনি।
ঈদের দিনে তোয়াব খানের হাতের স্পর্শে মওলানা আকরম খাঁর ভালোবাসার খানিকটা স্পর্শ পেলাম।
তেমনি কবি আবুল হোসেন, আমার ভালোবাসার কবি। ৩০ বছর একই রকম দেখছি। ২৯ আগস্ট তিনি ৯০। তাঁর জন্য যারা মালা নিয়ে যাব, অস্ফুট কণ্ঠে তিনি হয়তো পড়বেন তাঁর বিস্মৃত কবিতা:
‘চাওনি ফিরে
পিছন দিকে একটি বারও,
উড়িয়ে দিয়ে সব ভীরুতা
ধরিয়ে দিলে রক্তে নেশা
তোমার পথই পথ আমারও।’
 মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.