সমকালীন প্রসঙ্গ-নারীনীতি নিয়ে কেন অহেতুক বিতর্ক? by বদিউল আলম মজুমদার
নারী উন্নয়ন নীতি কি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? বাংলাদেশে সামাজিক মূল্যবোধ হলো ধর্মনিরপেক্ষতার, যা সংবিধান স্বীকৃত। আমাদের সংস্কৃতি হলো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার প্রতি সহমর্মিতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের।
তাই নারীনীতির বিরোধিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়
সম্প্রতি সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করেছে। ঘোষিত নারীনীতিকে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আখ্যায়িত করে ইসলামী ঐক্যজোট ও ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি এর বিরুদ্ধে হরতাল পালন করেছে। পক্ষান্তরে সরকারের পক্ষে দাবি করা হচ্ছে, নারীনীতিতে ইসলামবিরোধী কিছুই নেই। অনেক আলেম-ওলামাও সরকারের সঙ্গে একমত। আমরাও মনে করি, বিষয়টি নিয়ে একটি অহেতুক বিতর্ক ও অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, গত আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করে। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৪ সালে মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়াই গোপনে এতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। বস্তুত এসব পরিবর্তনের মাধ্যমে নারী উন্নয়ন নীতির মৌলিক কাঠামোকেই বদলিয়ে দেওয়া হয়, যা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নারী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর ২০০৮ সালে নারী উন্নয়ন নীতি নতুন করে প্রণয়ন করা হয়। নতুন নারীনীতিতে ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতির অনেক বিধানই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময়েও উগ্রপন্থিরা এর বিরুদ্ধে ধর্মের দোহাই দিয়ে ব্যাপক অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান, তখন নারীনীতির পক্ষে কেনোরূপ সমর্থন প্রদান করা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের অভাবে সরকার বাধ্য হয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবের নেতৃত্বে একটি 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০০৮ পর্যালোচনা কমিটি' গঠন করে।
কমিটি এর রিপোর্টে নারী উন্নয়ন নীতির ছয়টি ধারা বাতিলসহ ২১টি ধারায় পরিবর্তনের সুপারিশ করে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা বিলোপ ছিল কমিটির সুপারিশের অন্যতম। কমিটির মতে, এ ব্যবস্থা পুরুষদের জন্য চরম বৈষম্যমূলক এবং নারীদের ক্ষেত্রে চরম পক্ষপাতদুষ্ট। একইসঙ্গে কমিটি দাবি করে, শরিয়তের বিধান অনুসারে মেয়ে সাবালিকা হলেই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যায়, তাই কম বয়সী মেয়েদের বিয়েকে বাল্যবিবাহ বলা ঠিক নয়। অযৌক্তিক হলেও এসব বিরোধিতার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেনি।
আমরা মনে করি, ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন : ১. এটি কি আসলেই ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ? ২. এটি কি আমাদের সংবিধান ও বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সংঘর্ষিক? ৩. এটি কি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? ৪. এটি কি মুসলিম উম্মাহ বা মুসলমান সমাজের স্বার্থ সমুন্নত করবে?
রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাখ্যা দেওয়ার এখতিয়ার যেমন পোপের, তেমনিভাবে ইসলাম ধর্মের ব্যাখ্যা দেওয়ার একক অধিকার কারোরই নেই। বস্তুত ইসলাম ধর্মের বহু ব্যাখ্যা রয়েছে এবং কোরআনের অসংখ্য তাফসির বিদ্যমান। ইসলামের চারটি মাজহাব_ হানাফি, শাফি, হাম্বলি, মালেকি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভিন্ন ব্যাখ্যারই প্রতিফলন। এ ছাড়াও মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুনি্নসহ আরও অনেক বিভাজন রয়েছে। তাই ইসলাম ধর্মের অনেক স্রোত রয়েছে, যার কোনোটি অত্যন্ত রক্ষণশীল, আবার অন্যগুলো অনেক উদারপন্থি ও প্রগতিশীল। নারীনীতির বিরোধিতাকারীরা অত্যন্ত রক্ষণশীল ঘরানার অন্তর্ভুক্ত। এ ঘরানার ব্যক্তিরা নারীর অধিকারের প্রতি অনুদার। এদের ধারণা এমনকি 'অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজে'র (ওআইসি) ঘোষণারও পরিপন্থী।
১৯৯০ সালে ওআইসি ঘোষিত ঈধরৎড় উবপষধৎধঃরড়হ ড়হ ঐঁসধহ জরমযঃং রহ ওংষধস. ঙওঈ ঋরয়য অপধফবসু-র বিশ্ব স্বীকৃত আলেমদের সম্মতির ভিত্তিতে রচিত এ ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : '(ক) আদম থেকে উদ্ভূত এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ সমগ্র মানবজাতি এক পরিবারের সদস্য। জাতি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক আনুগত্য, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে মূল মানবিক মর্যাদা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিক থেকে সব মানুষ সমান... (খ) প্রতিটি মানুষ আল্লাহর অধীন। সেসব ব্যক্তিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, যারা তাঁর সব সৃষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত এবং শুধু ধর্মপরায়ণতা ও সৎকর্মের ভিত্তিতে ছাড়া একজন মানুষ অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না।'
এ ছাড়াও ওআইসি ঘোষণার অনুচ্ছেদ ৬(ক)-তে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : 'মর্যাদা এবং তা ভোগ করার অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের দিক থেকেও নারী-পুরুষ সমান। নারীর রয়েছে স্বতন্ত্র সামাজিক সত্তা বা পরিচয় ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং তার নিজের নাম ও বংশ পরিচয় বজায় রাখার অধিকার।' তাই নারীনীতির বিরোধিতাকারীদের অবস্থান মূলধারার ইসলামিক চিন্তার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, কারণ ইসলাম নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্যের স্বীকৃতি দেয়।
বস্তুত ইসলামে মূল মানুষ হচ্ছে 'রুহু' বা আত্মা_ শরীর নয়। প্রয়োজনে, সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষার কারণে, শারীরিকভাবে নারী-পুরুষ ভিন্ন, কিন্তু নারী-পুরুষের রুহুর মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। তাই আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের দিক থেকে নারী-পুরুষ এক এবং মানুষ হিসেবেও এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ শারীরিকভাবে ভিন্ন হলেও অধিকারের দিক থেকে নারী-পুরুষ অভিন্ন। এ ছাড়া পবিত্র কোরআনে নারী-পুরুষকে পরস্পরের পোশাক হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা পরিপূরকতা ও সমতারই ইঙ্গিত বহন করে। তাই নারীনীতি নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ অহেতুক।
এ ছাড়াও নারীনীতিতে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি, যা নিয়ে অনেক অপপ্রচার চলছে। বরং এতে জীবন-জীবিকা, আয়-উপার্জন ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকারের সুযোগের কথা বলা হয়েছে। তাই নারীনীতির বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য পড়ে আমি নিশ্চিত নই, তাদের অনেকে দলিলটি ভালোভাবে পড়েছেন কি-না। চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্পের মতোই মনে হয় যেন তারা এর বিরোধিতা করছেন।
তবে বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য থেকে মনে হয়, তাদের বিরোধিতার পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন, যদিও ইসলাম নারী-পুরুষের সমতার স্বীকৃতি প্রদান করে। স্মরণ করা যেতে পারে, মহানবী (সা.) বিদায় হজের বাণীতে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন : 'সাবধান! তাদের ওপর তোমাদের যতটুকু অধিকার রয়েছে, তাদেরও তোমাদের ওপর ততটুকুই অধিকার রয়েছে।'
দ্বিতীয়ত, বিরোধিতাকারীদের মতে নারীনীতি সিডও সনদ বাস্তবায়নের কৌশল হিসেবে প্রণয়ন করা হয়েছে (মানবজমিন, ৪ এপ্রিল ২০১১)। আর বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) নেতাদের মতে : 'সিডও সনদে নারীদের উত্থাপন করা হয়েছে ইউরোপীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতির আলোকে। ফলে এই নীতিমালায় মুসলিম নারীর জীবনধারা ও ইসলামী সংস্কৃতির মোটেই প্রতিফলন ঘটেনি। যে কারণে এ নীতিমালা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশের জীবনাচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের বিশ্বাস, এ নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি বর্জন করে ইউরোপীয় সংস্কৃতি অবলম্বনে বাধ্য করার নীরব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে... নারী উন্নয়ন নীতিমালা যেহেতু ইউরোপীয় নারীর কল্পচিত্রকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে, অতএব নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টির প্রতি মোটেও লক্ষ্য করা হয়নি... ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত বিষয়গুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোরআনের বিরুদ্ধাচরণ প্রকাশ পেয়েছে এবং পর্দার বিধান লঙ্ঘন হওয়ার কারণে কোরআনবিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। ইসলাম মূলত নারী-পুরুষের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছে, নারীনীতি বাস্তবায়ন হলে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। অধিকারের টানাটানিতে পারিবারিক জীবন এক সংঘাতময় কুরুক্ষেত্রে পরিণত হবে। পারিবারিক সৌহার্দ্য শেষ হয়ে যাবে; যা এখন ইউরোপের সমাজব্যবস্থায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে এ নীতিমালা ইসলামের পারিবারিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলাম পৈতৃক উত্তরাধিকার নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রদান করেছে... সুতরাং উত্তরাধিকারে যদি নারীকে পুরুষের সমান অংশ প্রদানের সুযোগ রাখা হয়, তাহলে এটি হবে সুস্পষ্ট কোরআনবিরোধী। তা ছাড়া নারীনীতির ভূমিকা ২য় লাইন ৪, ৪.১, ১৬.১, ১৬.৮, ১৬.১২, ১৭.১, ১৭.৪ ও ২৩.৫ ধারা যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে যে কোনো ব্যক্তির দ্বারা উত্তরাধিকারে নারী পুরুষের সমান পাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবে... সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে আবদ্ধ সরকার পরে সেই ধারাগুলোকে পুঁজি করে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও সমতার ব্যাখ্যা করবে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে?' (সংগ্রাম, ৩ এপ্রিল ২০১১)
এগুলো অনুমাননির্ভর কাল্পনিক অভিযোগ। নারীনীতিতে তো কাউকে পর্দা করতে নিষেধ করা হয়নি। এতে উত্তরাধিকার সম্পর্কেও কিছু বলা নেই। বস্তুত এসব অভিযোগ গায়ে পড়ে অযথা ঝগড়া লাগানোর একটি অপচেষ্টামাত্র বলেই মনে হয়। এ ছাড়াও প্রশ্ন : সম্মানিত ওলেমারা কি আমাদের মধ্যযুগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন? উপরন্তু নারীকে অধস্তন রেখে ও বঞ্চিত করে কীভাবে দীর্ঘমেয়াদিভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখা যাবে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এবার দেখা যাক। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। আমাদের সংবিধানের ১০, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে নারীর সমঅধিকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অংশ হিসেবে ১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।' ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।' এ ছাড়া সংবিধানের ২৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।' উপরিউক্ত অনুচ্ছেদগুলোর আলোকে এটি সুস্পষ্ট, আমাদের সংবিধানে সমাজে নারী-পুরুষের সমতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কে আদালতের রায়ও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ গত ২০০৪ সালে একটি মামলার (রিট পিটিশন নং ৩৩০৪/২০০৩) রায়ে বলেন : '... নারী ও পুরুষ উভয়ই জন্মগতভাবে স্বাধীন ও সমান, কিন্তু ঐতিহাসিক কারণে তাদের প্রতি অসম ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও প্রকৃতপক্ষে তারা অসম নন। তাদের উভয়ের জন্মগতভাবে সমানাধিকার রয়েছে, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হোক বা না হোক। কিন্তু সে স্বীকৃতি যত দ্রুত দেওয়া হয়, ততই মঙ্গল। আমাদের সংবিধান এই অসমতার ব্যাপারে সচেতন এবং তা দূর করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে এটি সংবিধানের কাম্য।' উচ্চ আদালতের রায় আইনের সমতুল্য। তাই ধর্মান্ধদের পক্ষ থেকে নারীকে অধস্তন রাখার প্রচেষ্টা আমাদের সংবিধানের এবং প্রচলিত আইনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
নারী উন্নয়ন নীতি কি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? বাংলাদেশে সামাজিক মূল্যবোধ হলো ধর্মনিরপেক্ষতার, যা সংবিধান স্বীকৃত। আমাদের সংস্কৃতি হলো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার প্রতি সহমর্মিতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের। অর্থাৎ ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। তাই নারীনীতির বিরোধিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার এবং নারীদের ওপর পর্দাপ্রথা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আমাদের বিদ্যমান সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এ ছাড়াও আমাদের কাছে বোধগম্য নয়, ধর্মের অত্যন্ত রক্ষণশীল ব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীদের অধস্তন করে রেখে আমাদের সম্মানিত আলেমদের একটি অংশ কী অর্জন করতে চাচ্ছেন! এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সীমিতসংখ্যক ব্যক্তির উগ্রবাদের কারণে সারা পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা আজ চরম আক্রমণের মুখে। হান্টিংটনের মতো পশ্চিমাদের অনেকেই মুসলমান এবং অমুসলমানদের মধ্যে 'সভ্যতার সংঘাতে'র ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে অকারণে বিভক্তি ও সংঘাত সব মুসলমানের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এমনিতেই মানুষের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক অধিকার হরণের কারণে প্রায় পুরো মুসলিম বিশ্ব আজ এক ভয়াবহ প্রলয়ের মধ্যে নিপতিত। তাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ইসলামকে উদারতা, আধুনিকতা ও অন্তর্ভুক্তিকরণমূলক দৃষ্টিতে দেখা। তাই আমরা আশা করব, জঙ্গি ইসলামের প্রবক্তারা উগ্রবাদ পরিহার করবেন এবং নারীকে অধস্তন করে রাখার লক্ষ্যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকবেন; কারণ স্বয়ং আল্লাহও পবিত্র কোরআনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নারী সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বদলাবেন। এ ছাড়া আশা করব, ইসলামকে তারা শান্তি, প্রগতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবেন না। কারণ মুসলমানরা অতীতে যতদিন আধুনিকতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক ও বাহক ছিলেন, ততদিন পৃথিবীতে তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিলেন।
প্রসঙ্গত, নারীর প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনার পরিণতিও অত্যন্ত অমঙ্গলকর। উদাহরণস্বরূপ, ইউনিসেফের ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার পুষ্টিহীনতার নজিরবিহীন উচ্চহারের শিকড় এসব দেশের সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের বৈষম্যে গভীরভাবে প্রোথিত। আর বহু রোগ-ব্যাধির উৎস পুষ্টিহীনতা। এ ছাড়া পুষ্টিহীনতার কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তি লোপ পায় এবং তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। তাই নারীর প্রতি বৈষম্যের মাশুল পুরো জাতিকেই দিতে হয়।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট, নারী উন্নয়ন নীতি সম্পর্কে ইসলামী ঐক্যজোট ও ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির অবস্থান আমাদের সংবিধান, বিদ্যমান আইন, আদালতের নির্দেশ, সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়াও নারীনীতি নিয়ে তাদের সংশয় কল্পনাপ্রসূত এবং তারা বিষয়টি নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত। উপরন্তু ইসলাম সম্পর্কে তাদের মতামত একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যে দৃষ্টিভঙ্গি নারীদের মৌলিক সমতার স্বীকৃতি প্রদান করে না। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কবি নজরুল অনেক দিন আগে আমাদের সাবধান করে দিয়ে গেছেন : 'বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে/আমরা তখনও বসে/বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি/হাদিস কোরআন চষে।' এ ছাড়াও জঙ্গিবাদী ইসলামের আবির্ভাবের ফলে এবং মানুষের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের কারণে বিশ্বে পুরো মুসলিম সমাজ আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ অবস্থায় ধর্ম সম্পর্কে কট্টরতার পরিবর্তে উদারতা ও নিজেদের মধ্যে বিভাজনের পরিবর্তে একতাই হবে আমাদের জন্য উৎকৃষ্টতম পন্থা। তাই নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে বিতর্ক অহেতুক, এমনকি আত্মঘাতী। আশা করি, আমাদের আলেম-ওলামাদের যে অংশ এর বিরোধিতা করছেন, তারা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন এবং তাদের মতামত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। একই সঙ্গে সরকারও নারীনীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
৪ এপ্রি্রল ২০১১
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক সুজন_সুশাসনের জন্য নাগরিক
সম্প্রতি সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করেছে। ঘোষিত নারীনীতিকে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আখ্যায়িত করে ইসলামী ঐক্যজোট ও ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি এর বিরুদ্ধে হরতাল পালন করেছে। পক্ষান্তরে সরকারের পক্ষে দাবি করা হচ্ছে, নারীনীতিতে ইসলামবিরোধী কিছুই নেই। অনেক আলেম-ওলামাও সরকারের সঙ্গে একমত। আমরাও মনে করি, বিষয়টি নিয়ে একটি অহেতুক বিতর্ক ও অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, গত আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করে। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৪ সালে মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়াই গোপনে এতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। বস্তুত এসব পরিবর্তনের মাধ্যমে নারী উন্নয়ন নীতির মৌলিক কাঠামোকেই বদলিয়ে দেওয়া হয়, যা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নারী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর ২০০৮ সালে নারী উন্নয়ন নীতি নতুন করে প্রণয়ন করা হয়। নতুন নারীনীতিতে ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতির অনেক বিধানই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময়েও উগ্রপন্থিরা এর বিরুদ্ধে ধর্মের দোহাই দিয়ে ব্যাপক অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান, তখন নারীনীতির পক্ষে কেনোরূপ সমর্থন প্রদান করা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের অভাবে সরকার বাধ্য হয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবের নেতৃত্বে একটি 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০০৮ পর্যালোচনা কমিটি' গঠন করে।
কমিটি এর রিপোর্টে নারী উন্নয়ন নীতির ছয়টি ধারা বাতিলসহ ২১টি ধারায় পরিবর্তনের সুপারিশ করে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা বিলোপ ছিল কমিটির সুপারিশের অন্যতম। কমিটির মতে, এ ব্যবস্থা পুরুষদের জন্য চরম বৈষম্যমূলক এবং নারীদের ক্ষেত্রে চরম পক্ষপাতদুষ্ট। একইসঙ্গে কমিটি দাবি করে, শরিয়তের বিধান অনুসারে মেয়ে সাবালিকা হলেই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যায়, তাই কম বয়সী মেয়েদের বিয়েকে বাল্যবিবাহ বলা ঠিক নয়। অযৌক্তিক হলেও এসব বিরোধিতার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেনি।
আমরা মনে করি, ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন : ১. এটি কি আসলেই ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ? ২. এটি কি আমাদের সংবিধান ও বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সংঘর্ষিক? ৩. এটি কি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? ৪. এটি কি মুসলিম উম্মাহ বা মুসলমান সমাজের স্বার্থ সমুন্নত করবে?
রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাখ্যা দেওয়ার এখতিয়ার যেমন পোপের, তেমনিভাবে ইসলাম ধর্মের ব্যাখ্যা দেওয়ার একক অধিকার কারোরই নেই। বস্তুত ইসলাম ধর্মের বহু ব্যাখ্যা রয়েছে এবং কোরআনের অসংখ্য তাফসির বিদ্যমান। ইসলামের চারটি মাজহাব_ হানাফি, শাফি, হাম্বলি, মালেকি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভিন্ন ব্যাখ্যারই প্রতিফলন। এ ছাড়াও মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুনি্নসহ আরও অনেক বিভাজন রয়েছে। তাই ইসলাম ধর্মের অনেক স্রোত রয়েছে, যার কোনোটি অত্যন্ত রক্ষণশীল, আবার অন্যগুলো অনেক উদারপন্থি ও প্রগতিশীল। নারীনীতির বিরোধিতাকারীরা অত্যন্ত রক্ষণশীল ঘরানার অন্তর্ভুক্ত। এ ঘরানার ব্যক্তিরা নারীর অধিকারের প্রতি অনুদার। এদের ধারণা এমনকি 'অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজে'র (ওআইসি) ঘোষণারও পরিপন্থী।
১৯৯০ সালে ওআইসি ঘোষিত ঈধরৎড় উবপষধৎধঃরড়হ ড়হ ঐঁসধহ জরমযঃং রহ ওংষধস. ঙওঈ ঋরয়য অপধফবসু-র বিশ্ব স্বীকৃত আলেমদের সম্মতির ভিত্তিতে রচিত এ ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : '(ক) আদম থেকে উদ্ভূত এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ সমগ্র মানবজাতি এক পরিবারের সদস্য। জাতি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক আনুগত্য, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে মূল মানবিক মর্যাদা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিক থেকে সব মানুষ সমান... (খ) প্রতিটি মানুষ আল্লাহর অধীন। সেসব ব্যক্তিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, যারা তাঁর সব সৃষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত এবং শুধু ধর্মপরায়ণতা ও সৎকর্মের ভিত্তিতে ছাড়া একজন মানুষ অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না।'
এ ছাড়াও ওআইসি ঘোষণার অনুচ্ছেদ ৬(ক)-তে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : 'মর্যাদা এবং তা ভোগ করার অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের দিক থেকেও নারী-পুরুষ সমান। নারীর রয়েছে স্বতন্ত্র সামাজিক সত্তা বা পরিচয় ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং তার নিজের নাম ও বংশ পরিচয় বজায় রাখার অধিকার।' তাই নারীনীতির বিরোধিতাকারীদের অবস্থান মূলধারার ইসলামিক চিন্তার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, কারণ ইসলাম নারী-পুরুষের মৌলিক সাম্যের স্বীকৃতি দেয়।
বস্তুত ইসলামে মূল মানুষ হচ্ছে 'রুহু' বা আত্মা_ শরীর নয়। প্রয়োজনে, সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষার কারণে, শারীরিকভাবে নারী-পুরুষ ভিন্ন, কিন্তু নারী-পুরুষের রুহুর মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। তাই আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের দিক থেকে নারী-পুরুষ এক এবং মানুষ হিসেবেও এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ শারীরিকভাবে ভিন্ন হলেও অধিকারের দিক থেকে নারী-পুরুষ অভিন্ন। এ ছাড়া পবিত্র কোরআনে নারী-পুরুষকে পরস্পরের পোশাক হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা পরিপূরকতা ও সমতারই ইঙ্গিত বহন করে। তাই নারীনীতি নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ অহেতুক।
এ ছাড়াও নারীনীতিতে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি, যা নিয়ে অনেক অপপ্রচার চলছে। বরং এতে জীবন-জীবিকা, আয়-উপার্জন ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকারের সুযোগের কথা বলা হয়েছে। তাই নারীনীতির বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য পড়ে আমি নিশ্চিত নই, তাদের অনেকে দলিলটি ভালোভাবে পড়েছেন কি-না। চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্পের মতোই মনে হয় যেন তারা এর বিরোধিতা করছেন।
তবে বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য থেকে মনে হয়, তাদের বিরোধিতার পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন, যদিও ইসলাম নারী-পুরুষের সমতার স্বীকৃতি প্রদান করে। স্মরণ করা যেতে পারে, মহানবী (সা.) বিদায় হজের বাণীতে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন : 'সাবধান! তাদের ওপর তোমাদের যতটুকু অধিকার রয়েছে, তাদেরও তোমাদের ওপর ততটুকুই অধিকার রয়েছে।'
দ্বিতীয়ত, বিরোধিতাকারীদের মতে নারীনীতি সিডও সনদ বাস্তবায়নের কৌশল হিসেবে প্রণয়ন করা হয়েছে (মানবজমিন, ৪ এপ্রিল ২০১১)। আর বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) নেতাদের মতে : 'সিডও সনদে নারীদের উত্থাপন করা হয়েছে ইউরোপীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতির আলোকে। ফলে এই নীতিমালায় মুসলিম নারীর জীবনধারা ও ইসলামী সংস্কৃতির মোটেই প্রতিফলন ঘটেনি। যে কারণে এ নীতিমালা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশের জীবনাচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের বিশ্বাস, এ নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি বর্জন করে ইউরোপীয় সংস্কৃতি অবলম্বনে বাধ্য করার নীরব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে... নারী উন্নয়ন নীতিমালা যেহেতু ইউরোপীয় নারীর কল্পচিত্রকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে, অতএব নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টির প্রতি মোটেও লক্ষ্য করা হয়নি... ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত বিষয়গুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোরআনের বিরুদ্ধাচরণ প্রকাশ পেয়েছে এবং পর্দার বিধান লঙ্ঘন হওয়ার কারণে কোরআনবিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। ইসলাম মূলত নারী-পুরুষের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছে, নারীনীতি বাস্তবায়ন হলে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। অধিকারের টানাটানিতে পারিবারিক জীবন এক সংঘাতময় কুরুক্ষেত্রে পরিণত হবে। পারিবারিক সৌহার্দ্য শেষ হয়ে যাবে; যা এখন ইউরোপের সমাজব্যবস্থায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে এ নীতিমালা ইসলামের পারিবারিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলাম পৈতৃক উত্তরাধিকার নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রদান করেছে... সুতরাং উত্তরাধিকারে যদি নারীকে পুরুষের সমান অংশ প্রদানের সুযোগ রাখা হয়, তাহলে এটি হবে সুস্পষ্ট কোরআনবিরোধী। তা ছাড়া নারীনীতির ভূমিকা ২য় লাইন ৪, ৪.১, ১৬.১, ১৬.৮, ১৬.১২, ১৭.১, ১৭.৪ ও ২৩.৫ ধারা যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে যে কোনো ব্যক্তির দ্বারা উত্তরাধিকারে নারী পুরুষের সমান পাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবে... সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে আবদ্ধ সরকার পরে সেই ধারাগুলোকে পুঁজি করে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও সমতার ব্যাখ্যা করবে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে?' (সংগ্রাম, ৩ এপ্রিল ২০১১)
এগুলো অনুমাননির্ভর কাল্পনিক অভিযোগ। নারীনীতিতে তো কাউকে পর্দা করতে নিষেধ করা হয়নি। এতে উত্তরাধিকার সম্পর্কেও কিছু বলা নেই। বস্তুত এসব অভিযোগ গায়ে পড়ে অযথা ঝগড়া লাগানোর একটি অপচেষ্টামাত্র বলেই মনে হয়। এ ছাড়াও প্রশ্ন : সম্মানিত ওলেমারা কি আমাদের মধ্যযুগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন? উপরন্তু নারীকে অধস্তন রেখে ও বঞ্চিত করে কীভাবে দীর্ঘমেয়াদিভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখা যাবে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এবার দেখা যাক। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। আমাদের সংবিধানের ১০, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে নারীর সমঅধিকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অংশ হিসেবে ১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।' ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।' এ ছাড়া সংবিধানের ২৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।' উপরিউক্ত অনুচ্ছেদগুলোর আলোকে এটি সুস্পষ্ট, আমাদের সংবিধানে সমাজে নারী-পুরুষের সমতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কে আদালতের রায়ও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ গত ২০০৪ সালে একটি মামলার (রিট পিটিশন নং ৩৩০৪/২০০৩) রায়ে বলেন : '... নারী ও পুরুষ উভয়ই জন্মগতভাবে স্বাধীন ও সমান, কিন্তু ঐতিহাসিক কারণে তাদের প্রতি অসম ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও প্রকৃতপক্ষে তারা অসম নন। তাদের উভয়ের জন্মগতভাবে সমানাধিকার রয়েছে, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হোক বা না হোক। কিন্তু সে স্বীকৃতি যত দ্রুত দেওয়া হয়, ততই মঙ্গল। আমাদের সংবিধান এই অসমতার ব্যাপারে সচেতন এবং তা দূর করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে এটি সংবিধানের কাম্য।' উচ্চ আদালতের রায় আইনের সমতুল্য। তাই ধর্মান্ধদের পক্ষ থেকে নারীকে অধস্তন রাখার প্রচেষ্টা আমাদের সংবিধানের এবং প্রচলিত আইনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
নারী উন্নয়ন নীতি কি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? বাংলাদেশে সামাজিক মূল্যবোধ হলো ধর্মনিরপেক্ষতার, যা সংবিধান স্বীকৃত। আমাদের সংস্কৃতি হলো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার প্রতি সহমর্মিতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের। অর্থাৎ ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। তাই নারীনীতির বিরোধিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার এবং নারীদের ওপর পর্দাপ্রথা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আমাদের বিদ্যমান সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এ ছাড়াও আমাদের কাছে বোধগম্য নয়, ধর্মের অত্যন্ত রক্ষণশীল ব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীদের অধস্তন করে রেখে আমাদের সম্মানিত আলেমদের একটি অংশ কী অর্জন করতে চাচ্ছেন! এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সীমিতসংখ্যক ব্যক্তির উগ্রবাদের কারণে সারা পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা আজ চরম আক্রমণের মুখে। হান্টিংটনের মতো পশ্চিমাদের অনেকেই মুসলমান এবং অমুসলমানদের মধ্যে 'সভ্যতার সংঘাতে'র ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে অকারণে বিভক্তি ও সংঘাত সব মুসলমানের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এমনিতেই মানুষের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক অধিকার হরণের কারণে প্রায় পুরো মুসলিম বিশ্ব আজ এক ভয়াবহ প্রলয়ের মধ্যে নিপতিত। তাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ইসলামকে উদারতা, আধুনিকতা ও অন্তর্ভুক্তিকরণমূলক দৃষ্টিতে দেখা। তাই আমরা আশা করব, জঙ্গি ইসলামের প্রবক্তারা উগ্রবাদ পরিহার করবেন এবং নারীকে অধস্তন করে রাখার লক্ষ্যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকবেন; কারণ স্বয়ং আল্লাহও পবিত্র কোরআনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নারী সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বদলাবেন। এ ছাড়া আশা করব, ইসলামকে তারা শান্তি, প্রগতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবেন না। কারণ মুসলমানরা অতীতে যতদিন আধুনিকতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক ও বাহক ছিলেন, ততদিন পৃথিবীতে তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিলেন।
প্রসঙ্গত, নারীর প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনার পরিণতিও অত্যন্ত অমঙ্গলকর। উদাহরণস্বরূপ, ইউনিসেফের ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার পুষ্টিহীনতার নজিরবিহীন উচ্চহারের শিকড় এসব দেশের সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের বৈষম্যে গভীরভাবে প্রোথিত। আর বহু রোগ-ব্যাধির উৎস পুষ্টিহীনতা। এ ছাড়া পুষ্টিহীনতার কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তি লোপ পায় এবং তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। তাই নারীর প্রতি বৈষম্যের মাশুল পুরো জাতিকেই দিতে হয়।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট, নারী উন্নয়ন নীতি সম্পর্কে ইসলামী ঐক্যজোট ও ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির অবস্থান আমাদের সংবিধান, বিদ্যমান আইন, আদালতের নির্দেশ, সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়াও নারীনীতি নিয়ে তাদের সংশয় কল্পনাপ্রসূত এবং তারা বিষয়টি নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত। উপরন্তু ইসলাম সম্পর্কে তাদের মতামত একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যে দৃষ্টিভঙ্গি নারীদের মৌলিক সমতার স্বীকৃতি প্রদান করে না। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কবি নজরুল অনেক দিন আগে আমাদের সাবধান করে দিয়ে গেছেন : 'বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে/আমরা তখনও বসে/বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি/হাদিস কোরআন চষে।' এ ছাড়াও জঙ্গিবাদী ইসলামের আবির্ভাবের ফলে এবং মানুষের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের কারণে বিশ্বে পুরো মুসলিম সমাজ আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ অবস্থায় ধর্ম সম্পর্কে কট্টরতার পরিবর্তে উদারতা ও নিজেদের মধ্যে বিভাজনের পরিবর্তে একতাই হবে আমাদের জন্য উৎকৃষ্টতম পন্থা। তাই নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে বিতর্ক অহেতুক, এমনকি আত্মঘাতী। আশা করি, আমাদের আলেম-ওলামাদের যে অংশ এর বিরোধিতা করছেন, তারা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন এবং তাদের মতামত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। একই সঙ্গে সরকারও নারীনীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
৪ এপ্রি্রল ২০১১
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক সুজন_সুশাসনের জন্য নাগরিক
No comments