রাজধানীর আশপাশের ৫শ গার্মেন্টসে বেতন বোনাস হয়নি, অসন্তোষ বিক্ষোভ by রহিম শেখ

তৈরি পোশাক খাতের প্রায় সাড়ে চার হাজার প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ বেতন-বোনাস দিলেও সাব কনট্রাক্টে চলা কারখানাগুলোর শ্রমিকরা এখনও বেতন পাননি। রাজধানীর আশপাশে আরও পাঁচ শতাধিক কারখানায় এখনও শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।


বুধবার বেশকিছু কারখানায় বেতন-বোনাস না দিয়ে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম অসন্তোষ। বিক্ষিপ্তভাবে চলা এ অসন্তোষ-বিক্ষোভ যে কোন মুহূর্তে ‘বিস্ফোরণ’ হয়ে দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলো সূত্র জানিয়েছে, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ফতুল্লা, হেমায়েতপুরসহ রাজধানীর আশপাশে পাঁচ শতাধিক কারখানা এখনও শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেয়নি। বুধবার সরকারী ছুটি থাকলেও অধিকাংশ গার্মেন্টস কারখানায় কার্যদিবস শেষে চলতি মাসের অর্ধেক বেতন দিয়েছে। যদিও শ্রমিকদের দাবি ছিল পুরো মাসের বেতন। এ নিয়ে যে কোন মুহূর্তে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এদিকে গত মঙ্গলবার শেষ কার্যদিবস হলেও সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং ১৮ আগস্ট খুলনা, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার ব্যাংকগুলো খোলা রাখতে হবে বলে নির্দেশনা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্রে জানা গেছে, বেতন-বোনাসের দাবিতে মঙ্গলবার আশুলিয়ার জিরাব এলাকার ইস্ট ফ্যাশন গার্মেন্টসের শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করলে ৫০ শ্রমিক নেতাকে চাকরিচ্যুত করেছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া সাভারের হেমায়েতপুর এলাকার হলমার্ক গ্রুপের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে বুধবার শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে দুপুরে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এতে বিপাকে পড়ে গার্মেন্টসে নিয়োজিত প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক। টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জেও বেশ কয়েকটি গার্মেন্টস কারখানা বেতন-বোনাস না দিয়েই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, রাজধানীর রামপুরা এলাকার প্রায় ১০ থেকে ১৫টি কারখানায় এখনও বেতন-বোনাস দেয়নি কর্তৃপক্ষ। রামপুরা এলাকার গ্রিন ফ্যাশন, ন্যাশনাল গার্মেন্টস, রূপা সোয়েটার লিঃ, জিএনজি অ্যাপারেল, মেগাস্টার, মিম ফ্যাশনসহ বিভিন্ন কারখানায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। ভাড়া বা সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম পুঁজির মালিকরা ব্যবসা করেন এসব এলাকায়। এসব কারখানা সাধারণত সরাসরি রফতানি করে না। তারা বড় কারখানা মালিকদের সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে কাজ করেন। তাই তারা অর্থ সঙ্কটে সময়মতো বেতন দিতে পারছেন না বলে শ্রমিকদের জানিয়েছেন। শ্রমিকরা আশঙ্কা করছেন, মালিকরা শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে বন্ধ করে দিতে পারেন কারখানা।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) আশ্বাস দিয়েছিল, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানোর জন্য তারা ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তারপরও প্রতিদিনই বিভিন্ন শিল্প এলাকায় বেতন-বোনাস না দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হচ্ছে। চলতি সপ্তাহের রবি, সোম ও মঙ্গলবার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা গেছে। সোমবার আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় ফ্যাশনিস্টের কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। সকালে শ্রমিকরা এসে বিক্ষোভ করে কাজ না করেই চলে যায়। এ কারখানায় কয়েকদিন ধরেই অসন্তোষ চলছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ও শিল্প রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন জনকণ্ঠকে বলেন, বড় কারখানাগুলোর বেশিরভাগ এরই মধ্যে বেতন-বোনাস দিয়ে দিয়েছে। বাকিরা প্রক্রিয়ার মধ্যে রেখেছে। তবে বড় সমস্যা হয়েছে সাব কন্ট্রাক্টে চলা কারখানাগুলোতে। নৈতিক কারণেই বেতন-বোনাস নিয়ে টালবাহনা করা ঠিক হবে না বলেও দাবি করে তিনি জানান, শ্রমিকরা দ্রব্যমূল্য ও উর্ধমুখী বাড়ি ভাড়ার কারণে সারাবছরে কোন টাকাই জমা করতে পারে না। ঈদে বাড়িতে যেতে হলেও যাতায়াতে কয়েক হাজার টাকার প্রয়োজন হয়।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু জনকণ্ঠকে জানান, সরকারী কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য বেসিকের সমান বোনাস দেয়া হলেও গার্মেন্টস শ্রমিকদের সে পরিমাণে দেয়া হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে রোজার শুরুতে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে বেতন-বোনাস মিটিয়ে দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু মালিকপক্ষ কথা রাখেনি।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সভাপতি মোঃ সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, বেতন-ভাতা পরিশোধের চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ষড়যন্ত্র। অহেতুক কেউ যদি গ-গোল করতে চায় বা করাতে চায় সেক্ষেত্রে এর দায়ভার কে নেবে? কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেতন-ভাতা নিয়ে সমস্যা হলেও এটিই মূল কারণ নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান কাজের অভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে ছোট কারখানাগুলো চাপের মুখে পড়বে। যড়যন্ত্রকারীরা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তবে বিজিএমইএ সতর্ক রয়েছে।
প্রসঙ্গত, দেশে প্রায় পাঁচ হাজার পোশাক কারখানা ছিল। এর মধ্যে বন্ধ ও একীভূত হওয়ায় বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় ৩৮ লাখ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে ভাড়াভিত্তিক বা সাব কন্ট্রাক্টে কারখানা চলছে পাঁচ শতাধিক।
না’গঞ্জে ঘেরাও, চট্টগ্রামে অবরোধ
চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, নারায়ণগঞ্জে দুটি রফতানিমুখী পোশাক কারখানার শ্রমিকরা দুই মাসের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারর্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) কার্যালয় ঘেরাও ও বিক্ষোভ করেছে। বুধবার দুপুরে শহরের চাষাঢ়ায় অবস্থিত বিকেএমইএ কার্যালয়ের সামনে এই বিক্ষোভ করে। শ্রমিকদের অভিযোগ, ২৬ রোজা অতিবাহিত হলেও তাদের বকেয়া বেতন ও বোনাস প্রদান করা হয়নি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল জানান, ফতুল্লার কাশিপুর এলাকায় অবস্থিত রফতানিমুখী পোশাক কারখানা এক্সসিলেন্ট গার্মেন্টস ও শহরের রিভারভিউ মার্কেটে অবস্থিত অর্জন ফ্যাশন লিমিটেডের শ্রমিকদের দুই মাসের বেতন বকেয়া। ২৬ রোজা অতিবাহিত হলেও তাদের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাস দেয়া হয়নি। মালিকপক্ষ নানা টালবাহানা করছে। অবিলম্বে বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবি জানান তাঁরা। যদি কোন শ্রমিক বকেয়া বেতন ও বোনাসের কারণে ঈদ করতে না পারে সেই কারখানার মালিকদের বাড়ি ঘেরাও করে তাদের ঈদ করতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তাঁরা।
চট্টগ্রামে একটি গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকরা চার মাসের বকেয়া বেতন আদায়ের জন্য বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছে বুধবার। সকালে জামালখান এলাকার জেআর ফ্যাশন লিমিটেডের শ্রমিকরা এ বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটিয়েছে। শ্রমিকদের অভিযোগ, মালিকপক্ষ রক্ত শোষণের মতো কাজ আদায় করে নিচ্ছে। কিন্তু বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে চালায় গড়িমসি। নির্দিষ্ট সময়ে বেতন না দিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে মালিকপক্ষ। গত মাসেও বেতন প্রদানের কথা বলে প্রোডাকশন ঠিক রেখেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেতন প্রদান না করায় শ্রমিকরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে।
জেআর ফ্যাশন লিমিটেডের প্রায় দেড় শ’ শ্রমিকের বেতন বন্ধ রয়েছে চার মাস ধরে। এছাড়াও গত দু’মাস ধরে ২০-২৫ শ্রমিকের বেতন কি কারণে বন্ধ রয়েছে তা স্বীকার করছে না কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের দাবি নির্দিষ্ট সময়ে শ্রমঘণ্টা দিয়ে উপার্জনের উদ্দেশ্যেই তারা এ গার্মেন্টসে কাজ করছে। কিন্তু কর্র্তৃপক্ষ কাজ আদায়ের বেলায় রক্ত শোষার মতো পর্যবেক্ষণ করে। বেতন দেয়ার বেলায় কর্তৃপক্ষকে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রত্যেক মাসের শেষের দিকে তথা বেতন প্রদানের প্রাক্কালে মালিক ও ব্যবস্থাপকের গা-ঢাকা দেয়ার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ করেছে আন্দোলনরত শ্রমিকরা।
এ ব্যাপারে বিজিএমইএ’র এক সদস্য জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে এধরনের গার্মেন্টস মালিকদের বিপরীতে কোন ধরনের এ্যাকশন নেয়া হয় না। সদস্যরা প্রতিনিয়ত একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান ঠিক রেখেছে। সংগঠনের সভাপতি, সেক্রেটারি সকলেই মালিকপক্ষের লোক। ফলে শ্রমিকরা সংগঠনের কাছে বিচার চেয়েও কোন লাভ হয় না।

No comments

Powered by Blogger.