শিক্ষা-বিদ্যালয়ে শিখনবান্ধব পরিবেশ by মো. আবুল বাশার

শিখন-সহায়ক ভৌত পরিবেশের নিয়ামকগুলো হলো_ সব শিক্ষার্থীর শিক্ষার জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় ভবন, বিদ্যালয়ের প্রতিটি সম্পদকে শিক্ষার্থীরা আরামদায়ক ও নিরাপদ মনে করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি, সুশৃঙ্খল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শ্রেণীকক্ষ ও বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ এবং পর্যাপ্ত পাঠ্যবই


বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের শিখন পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। পরিবেশ কেবল শিক্ষার্থীদের শিখনেই প্রভাব বিস্তার করে তা নয়, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া এবং শিক্ষা চলাকালে ও শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পরের আচরণেও প্রভাব ফেলে, যা একটি এলাকা ও সমাজের মানুষের আচরণে প্রতিফলিত হয়। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যালয়ের পরিবেশ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? একটি সুশৃঙ্খল বিদ্যালয়ের পরিবেশ হচ্ছে, যেখানে বিদ্যালয়ের সব সদস্য তথা বিদ্যালয় পরিবার নিজেদের মূল্যবান ভাবতে পারে ও বিদ্যালয়ের লক্ষ্য অর্জনে নিজেদের সক্ষম মনে করে এবং সংহতিনাশ ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট উদ্বেগ থেকে মুক্ত। যেখানে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ও আন্তরিকভাবে শিখতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ সামর্থ্য বিকাশের জন্য যথাযথ সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ পরিবেশ হবে শিক্ষার্থীবান্ধব। যে পরিবেশ শিখনবান্ধব তা শিক্ষক ও অভিভাবকবান্ধব না হয়ে পারে না। বিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশের প্রধান চারটি দিক রয়েছে। এক. শিখন-সহায়ক ভৌত পরিবেশ, দুই. যোগাযোগ ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া উপযোগী সামাজিক পরিবেশ, তিন. আত্মমর্যাদা ও ইন্দ্রিয় অনুভূতি উন্নতকরণ উপযোগী আবেগিক পরিবেশ ও চার. একাডেমিক পরিবেশ, যা শিক্ষার্থীদের শিখন পরিপূর্ণ করবে।
শিখন-সহায়ক ভৌত পরিবেশের নিয়ামকগুলো হলো_ সব শিক্ষার্থীর শিক্ষার জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় ভবন, বিদ্যালয়ের প্রতিটি সম্পদকে শিক্ষার্থীরা আরামদায়ক ও নিরাপদ মনে করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি, সুশৃঙ্খল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শ্রেণীকক্ষ ও বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ এবং পর্যাপ্ত পাঠ্যবই। যোগাযোগ ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া উপযোগী সামাজিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মিথস্ক্রিয়াকে উৎসাহিত করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কার্যকর যোগাযোগ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল শিক্ষক, ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রক্রিয়ার অভিভাবকের অংশীদারিত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের অংশগ্রহণ ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মতামত প্রদানের ব্যবস্থা রাখা ইত্যাদি। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন চাহিদা পরিপূর্ণ করার উপযোগী একাডেমিক পরিবেশের উপাদানগুলো হলো, সব ধরনের বুদ্ধিমত্তা ও সামর্থ্যকে সম্মানিত ও সমর্থন করা, 'শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন উপায়ে শেখে'_ এ ধারণাকে সম্মান করা ও সে অনুযায়ী শিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা, সব শিক্ষার্থীর উচ্চ প্রত্যাশা সৃষ্টি করা, সাফল্যের জন্য কেবল এক ব্যক্তিকে নয়, সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্মানিত করা, অগ্রগতি নিয়মিত নিরীক্ষণ করা, মূল্যায়নের ফলাফল দ্রুত শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে জানানো, পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী শিক্ষণ পদ্ধতি ও পাঠের বিষয়বস্তু মূল্যায়ন ও সংস্কার করা, শিক্ষার্থীর অর্জন ও পারদর্শিতাকে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত করা, 'শিক্ষককে হতে হবে আস্থাশীল ও জ্ঞানী'_ এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান করা ইত্যাদি। উলি্লখিত দিকগুলোর একটি ছাড়া অন্যটি আলাদাভাবে কার্যকর নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোতে উলি্লখিত চার ধরনের পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় কি-না অথবা সহায়ক উপাদানগুলো কতটা বিরাজমান? এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টিতে কে ভূমিকা নেবেন? বিদ্যালয়ের কাঙ্ক্ষিত শিখনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মূলত উদ্যোগ নিতে হবে প্রধান শিক্ষককে আর তাকে সহায়তা করবেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ও ম্যানেজিং কমিটি। বিদ্যমান পরিবেশ উন্নীতকরণে যে কাজগুলো করা যেতে পারে ১. নিরাপদ ও আমন্ত্রণমূলক ভবন নির্মাণ ও অন্যান্য ভৌত অবস্থা বজায় রাখা। যেমন : শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিখন অর্জন উপযোগী আসনের ব্যবস্থা করা; ২. সবার জন্য নিরাপদ পানি ও টয়লেট সুবিধা নিশ্চিত করা এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা; ৩. যথাযথ আচরণের জন্য শিক্ষকদের পুরস্কৃত করা ও অনুপযুক্ত আচরণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া; ৪. শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আচরণ ও তা প্রদর্শনে ব্যর্থতার ফল তাদের জানিয়ে দেওয়া; ৫. শিক্ষার্থী, কর্মী ও অভিভাবকদের বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানো; ৬. বিদ্যালয় পরিবেশ ভালো করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ; ৭. ইভটিজিং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম শনাক্ত করা, শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন ও নির্যাতন প্রতিরোধমূলক দক্ষতা ও যোগাযোগ ও আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা অর্জন ও চর্চা করানো; ৮. সুশৃঙ্খলভাবে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা করা; ৯. যথাযথ পরিকল্পনার ভিত্তিতে শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম পরিচালনা করা; ১০. কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত বিধিবিধান ও নীতিমালা মেনে চলা, যেমন : শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত নীতিমালা; ১১. বিদ্যালয় মনিটরিং ও সুপারভিশনের ক্ষেত্রে বিদ্যালয় পরিবেশকে গুরুত্ব প্রদান; ১২. বিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে পরিবেশ বিষয়ক উপাদানগুলো বিবেচনা করা; ১৩. আন্তঃবিদ্যালয় পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা; ১৪. শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে বিদ্যালয়ে শিখনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা; ১৫. বিদ্যালয় পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা ইত্যাদি। যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি না কেন আমাদের সবার প্রত্যাশাই হচ্ছে বিদ্যালয় পরিবেশকে নিরাপদ, আনন্দদায়ক, আমন্ত্রণমূলক তথা শিখনবান্ধব করা। যার ফলস্বরূপ আমরা পাবো বিদ্যালয়ে একীভূত শিক্ষার পরিবেশ এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ও ইতিবাচক আচরণে সক্ষম আগামী প্রজন্ম। মাদার তেরেসা বলেছেন, I alone cannot change the world, but I can cast a stone across the waters to create many ripples.”

মো. আবুল বাশার :সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
basharnsl@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.